প্রধানমন্ত্রীর চায়ের দাওয়াত, গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং প্রশ্নবিদ্ধ সুশাসন

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অবস্থান এখন বিপরীতমুখী হলেও এ দুই দলের মুখোমুখি আলোচনার টেবিলে বসার কি কোনও সম্ভাবনা আছে? সেটি নিয়ে লিখেছেন বিভুরঞ্জন সরকার।

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 28 July 2022, 02:07 PM
Updated : 28 July 2022, 02:14 PM

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অবস্থান এখন বিপরীতমুখী হলেও এ দুই দলের মুখোমুখি আলোচনার টেবিলে বসার কি কোনো সম্ভাবনা আছে? আমাদের দেশে রাজনৈতিক সুবিধাবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে একটি কথা চালু করা হয়েছে যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আদর্শমুখী রাজনীতিতে শেষ কথা অবশ্যই আছে।

সব দলেরই কিছু কিছু মৌলিক বিশ্বাসের জায়গা আছে, যেখান থেকে তাদের পিছু হঠার কথা নয়। কিন্তু আজকাল কেউ আর আদর্শের সীমারেখা মানতে চায় না। প্রকাশ্যে গরম গরম কথা বলে গোপনে সমঝোতার পথ খোঁজার কারণেই রাজনীতি নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ বাণী করা কঠিন।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কিছুটা কৌতূহল তৈরি হয়েছে। ২৩ জুলাই আওয়ামী লীগের এক যৌথ সভায় বিএনপি যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণ করে তাহলে ‘বাধা দেওয়া হবে না’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলামোটরে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার যে রীতি চালু হয়েছে, সেটার বিপরীতে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, “আসুক না হেঁটে হেঁটে যত দূর আসতে পারে। কোনো আপত্তি নেই। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো বাধা নেই।” প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় পর্যন্ত বিএনপি নেতারা গেলে তাদের বসিয়ে চা খাওয়াবেন বলেও উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি কথা বলতে চাইলে তিনি তা শুনবেনও। তবে তিনি এাটও বলেছেন, বোমাবাজি ও ভাঙচুর করলে ‘বাধা দেবো এবং উপযুক্ত জবাব পাবে। এটাই বাস্তবতা।’

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য স্পষ্ট ও পরিষ্কার। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলে বাধা নেই, অশান্তি করার চেষ্টা বাধা ও উপযুক্ত জবাব। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করার অঙ্গীকার বিএনপির পক্ষে করা সম্ভব নয়। বিএনপি আগে প্রমাণ করেছে বোমাবাজি, ভাঙচুর, আগুন -এসব ছাড়া তারা আন্দোলনের কথা ভাবতেও পারে না। শ্রীলঙ্কায় যে সম্প্রতি অভূতপূর্ব জনজাগরণ দেখা গেল সেখানে কি একজন আন্দোলনকারীকেও বোমা এমনকি কোনো স্থাপনা লক্ষ করে একটি ঢিলও ছুঁড়তে দেখা গেছে?

যাহোক, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে রাজনীতির কোনও কোনও পর্যবেক্ষক অবশ্য কিছুটা ইতিবাচক ইংগিত লক্ষ্য করছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দরোজা খোলা রাখার কৌশল হয়তো নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ এমনও মনে করছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে চা খাওয়ানোর কথা ভেবেচিন্তেই বলেছেন। কারণ তিনি জানেন, বিএনপি তার চায়ের দাওয়াত কবুল করবে না। বিএনপি জানে, শেখ হাসিনার চা খেতে গেলে দাবি আদায়ের আশা আর থাকবে না।

বিএনপি আর যাই করুক, শেখ হাসিনার কোনো প্রস্তাবে রাজি হবে না। বিএনপি হয়তো এতদিনে এটা বুঝতে পেরেছে যে রাজনৈতিক কৌশলে তারা আওয়ামী লীগের থেকে পিছিয়েই আছে। গত কয় বছরে, বিশেষ করে ২০১৪-১৫ সালে আওয়ামী লীগকে জাপটে ধরার কম কোশেশ তারা করেনি। কিন্তু ব্যাপক জ্বালাওপোড়াও করেও সফল হতে পারেনি। বিএনপির বজ্রআঁটুনিকে ফস্কা গেড়ো বানিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।

সেজন্যই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার পরিবর্তে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “আগে আপনি (প্রধানমন্ত্রী) বলে দেন, আমি কেয়ারটেকার সিস্টেম মেনে নিচ্ছি; ঘোষণা করুন যে- আপনি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা মেনে নেবেন। তাহলে চা-টা খাওয়া যাবে অসুবিধা নেই।”

অর্থাৎ বিএনপির কাছে সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার'। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি এতটাই অকূল পাথারে পড়েছে যে, নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার আগেই পরাজয় মেনে বিএনপির কাছে ক্ষমতা ছে্ড়ে বিদায় নিতে হবে? বিএনপি যদি মনে করে তাদের শক্তি ও আন্তর্জাতিক কানেকশন আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি, তাহলে সরকারের কাছে আবদার না করে নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করে দেখাক তাদের দৌড় ও দম কত লম্বা !

আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যকে আগামী নির্বাচনের জন্য দলের প্রস্তুতির একটি অংশ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, চা খাওয়ানোর কথা বলে প্রধানমন্ত্রী কার্যত বিরোধী দলের সঙ্গে আলাপ শুরুর পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছেন।

লেখার এই পর্যায়ে আসার পর টেলিফোন করলেন সাংবাদিক বন্ধু মাহবুব কামাল। দেশ ও রাজনীতি শুধু নয়, যেকোনো বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে তিনি ওস্তাদ ব্যক্তি। তার কাছে জানতে চাই, দেশের রাজনীতি কোন পথে এগোবে?

তিনি অবশ্য আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আগে বলেন, এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প কে বাংলাদেশে?”

আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলি, “বিকল্প তো তৈরি হয় সাধারণত সংকটকালে উত্তরণের পথ বাতলে দেওয়ার মতো বিচক্ষণ মানুষদের নিয়ে। বিশ্বব্যাপী এখন যে গভীর অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, যার তাপ থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়, তা থেকে উত্তরণের উপায় বাতলানোর মতো একজন বা একদল মানুষ তো দেখছি না।”

মাহবুব কামাল উত্তেজিত কণ্ঠে জবাব দেন, “আরে, বিশ্ব সমস্যা বাদ দেন, বিশ্বে এখন বিশ্বমাপের নেতৃত্ব নেই বললেই চলে। কিন্তু আমার কাছে লিখে নেন, বাংলাদেশে আপাতত শেখ হাসিনার বিকল্প নেই এবং আগামী নির্বাচনেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই জিতবে এবং সরকার গঠন করবে।”

আমি বলি, “বিএনপি ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীরা তো বলছেন, সুষ্ঠু ভোট হলে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটবে। মানুষের মুখে মুখেও তো অনেকটা এমন কথাই শুনি। আওয়ামী লীগের সামনে ঘোরতর বিপদ।”

মাহবুব কামাল বলেন, “আওয়ামী লীগের সামনে কোনো কাঁটা নেই, তা আমি বলবো না। তবে তারচেয়ে বেশি কাঁটা ছড়ানো বিএনপির পথে।”

আমি বলি, “টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় এখন মানুষ স্বাদ বদলে আগ্রহী হয়ে উঠছে নাকি? তাছাড়া ‘বেশি উন্নয়ন, কম গণতন্ত্র’ বলে যে বক্তব্য আওয়ামী লীগের কেউ কেউ দিয়ে থাকেন, তা নিয়েও তো এখন প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত বিদ্যুৎ সমস্যা আবার ফিরে আসায় সরকারের উন্নয়ন কতটা টেকসই তা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠছে। বিএনপি রীতিমতো ব্যঙ্গবিদ্রুপ করছে।”

মাহবুব কামাল বলেন, “আমাদের দেশে গণতন্ত্র নিয়ে যারা মুখে ফেনা তুলছেন তাদের শক্তভাবে বিরোধিতা করা উচিত। এমনকি আমাদের তো এখন অবাধ নির্বাচনের দাবি থেকেও সরে আসা উচিত। রাজনৈতিকভাবে সচেতনতার অভাব যে সমাজে প্রবল, সেখানে অবাধ গণতন্ত্র কায়েম করা সহজ নয়। এই যে বিদ্যুতের সংকট এটা তো জ্বালানি বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণের ঘাটতির কারণে হচ্ছে। জ্বালানি তো আমাদের আমদানি করতে হয়। তাছাড়া বিদ্যুৎ তো এমন পণ্য নয়, যা উৎপাদন করে মজুদ রাখা যায়। বিএনপি আমলে যে সংকট তৈরি করা হয়েছিল, তা থেকে তো আমরা মুক্ত হয়েছিলাম। লোডশেডিং তো প্রায় বিদায় নিয়েছিল। এখন বৈশ্বিক সমস্যার কারণে আবার সাময়িকভাবে লোডশেডিং হওয়ায় যারা সব গেল সব গেল বলে রব তুলেছেন, তারা আসলে বিচারবিবেচনাহীন মানুষ।”

আমি বলি, “দেশের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব তো রাজনৈতিক দলেরই। আওয়ামী লীগ এত বছর ক্ষমতায় থেকে কী করলো? উন্নয়ন মানে কি শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন? মানুষের মূল্যবোধ, চিন্তাচেতনার উন্নতি কোথায়?”

মাহবুব কামাল বলেন, “আমরা উদাহরণ দেই, নিজের সুবিধা অনুযায়ী। আমাদের অনেকের যুক্তি আসলে কুযুক্তিতে ভরা। আমি নিজে এখন মনে করি, আমরা যাকে গণতন্ত্র বলি, সেটা আসলে উচ্ছৃঙ্খলতা। গণতন্ত্র নিয়ে বড়াই করা মোড়ল দেশ আমেরিকায় ট্রাম্প সমর্থকরা গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সেই উচ্ছৃখলতার নজির দেখিয়েছে। আমরা আর বেশিদিন বর্তমান ধারার গণতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখতে পাবো বলে মনে হয় না। গণতন্ত্রের ধরন পাল্টাতেই হবে আমাদের।”

আমি জানতে চাই, “আমরা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কি তবে একনায়কতন্ত্র অথবা সীমিত গণতন্ত্রেরই উপযুক্ত?”

মাহবুব কামালের উত্তর, “শেখ হাসিনাকে এই প্রশ্নটি করলে তিনি হয়তো বলবেন- ঠিক তাই। আর বেগম খালেদা জিয়া বলবেন- ঠিক আছে, তবে আমার টার্ম শুরু হওয়ার পর থেকে। মুশকিল হচ্ছে, একনায়কতন্ত্র বলি আর সীমিত গণতন্ত্র- শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়া, যার টার্ম থেকেই শুরু করা যাক না কেন, তাতে কি খুববেশি যায় আসবে?”

আমি জানতে চাই, “শেখ হাসিনা তো খালেদা জিয়ার চেয়ে ভালো শাসক হওয়ার প্রমাণ রেখেছেন। সিঙ্গাপুরের লি কুয়ানের মতো হুবহু এক রকম না হলেও তিনি তো খালেদা জিয়ার চেয়ে ভিশনারি আউটলুক অর্থাৎ দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন।”

মাহবুব কামাল বলেন, “বিনেভোলেন্ট ডিক্টেটর (জনহিতৈষী একনায়ক) হওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশে সবচেয়ে বড় বাধা বাঙালির স্বভাব। এই স্বভাব গর্ব করার মতো, কোনোকিছু মনের বিরুদ্ধে গেলে তা মানতে চায় না বাঙালি। মালয়েশিয়া, সিংগাপুর অথবা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের ওপর যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা সেটাই মেনে নিয়েছে। বাঙালির ট্র্যাক রেকর্ড তেমন নয়। বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকার সীমিত গণতন্ত্রের চর্চা করে দেখছেন, এটা ফলপ্রসূ হয় কি-না। এটা সফল হবে যদি তিনি সুশাসন নিশ্চিত করতে পারবেন। এটা পারা এখনো তার পক্ষেই সম্ভব। কারণ তিনিই শুধু বলতে পারেন যে ‘আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই।”

আমাদের আলোচনাটি শেষ হয় এই উপসংহারে এসে যে: শেখ হাসিনা তার সীমিত গণতন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পজিটিভ রেজাল্ট বের করে আনতে পারবেন, যদি তিনি লি কুয়ানের মতো সুশাসন দিতে সক্ষম হন। সুশাসন নেই, গণতন্ত্রও অর্ধেক- এটা নিয়ে সমালোচনা হবেই। আসলে গণতন্ত্রের বিকল্প শুধু উন্নয়ন নয়, গণতন্ত্রের বিকল্প অবশ্যই সুশাসন। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে সুশাসনও দিতে হবে। মানুষ ন্যায়বিচার বঞ্চিত থাকলে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকলে, লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ না হলে, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির লাগাম টেনে না ধরতে পারলে মানুষের মুখ বন্ধ রাখা যাবে না। সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর যথাযথ কার্যকারিতাও নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে বিবেচনা করে শুধু নির্বাচন কমিশনের প্রতি সব মনোযোগ নিবদ্ধ রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠুটোঁ জগন্নাথ বানানো কাঙ্ক্ষিত নয়।

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ এমন কিছু বিষয়কে সম্ভব করেছেন, যেগুলো অসম্ভব বলেই ভাবা হয়েছিল। তাই সুশাসনের বিষয়টিও তার পক্ষেই সম্ভব করা সম্ভব।