Published : 14 Apr 2020, 06:39 PM
প্রবাদ-প্রবচনে ফুটে ওঠে কোনো জাতির স্বভাব-চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যও খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রবাদ-প্রবচনে। তেমনই একটি প্রবাদ হচ্ছে: 'চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড় ধরা'। এই প্রবাদটি অন্য কোনো ভাষায় আছে বলে মনে হয় না। এটা শুধু বাংলাতেই আছে। আর একথাও কবুল করা ভাল যে, এই বিদ্যায় কোনো কোনো বাঙালির ব্যুৎপত্তি প্রশ্নাতীত। বাবার পকেটের টাকা, প্রতিবেশীর গাছের আম-জাম-পেয়ারা-লিচু দিয়ে শুরু হলেও বাঙালি পুকুরচুরিতেও পাকা। চুরির বস্তু হিসেবে পুকুরও এখন বড় কিছু নয়। খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, বনভূমি, নদী ও পাহাড় পর্যন্ত চুরি হচ্ছে। সোনাদানা তো অতি ছোটো বস্তু। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি যা চুরি হয়—তা হলো টাকা। অবশ্য চুরি না বলে একে 'হাতিয়ে নেওয়া' বলাই ভাল। এর কারণ কী? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, টাকা নেই বলেই চোর চুরি করে! তবে সব চোর যে টাকা নেই বলেই চুরি করে—তা কিন্তু নয়। অনেকেই আছে, চুরি করা যাদের স্বভাব। চুরি ছাড়া যারা থাকতে পারে না। তেমন কিছু চোরের আবির্ভাব ঘটেছে করোনাভাইরাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এরা হচ্ছে চাল চোর। অনেকেই বলাবলি করছেন যে, দেশে এখন করোনাভাইরাস রোগীর চেয়ে চাল চোর বেশি! হবেও বা!
করোনাভাইরাসের ভয়ে গোটা বিশ্ব এখন আতঙ্কগ্রস্ত। আমাদের দেশেও চলছে করোনাভীতি। ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। ইতোমধ্যে সরকারি হিসেবে মারা গেছেন প্রায় ৪০ জন। আক্রান্ত প্রায় আটশ মানুষ। সাধারণ ছুটির নামে দেশজুড়ে কার্যত লকডাউন চলছে। এই অবস্থায় দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ত্রাণ সহায়তা ও দশ টাকা কেজিতে চাল কেনার সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর এই মহামারীর সুযোগেই এক শ্রেণির অসাধু জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী তাতে হাত দিয়েছেন। কেউ চুরি করে অন্যত্র বিক্রি করছেন, কেউ আত্মসাৎ করতে গিয়ে ধরা খাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে ত্রাণ আত্মসাত ও দশ টাকা দরের চাল চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেক জনপ্রতিনিধি, চালের ডিলার ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। এদের বেশিরভাগই সরকারি দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা। এক উপজেলায় একাধিকবার চাল চুরি ও আত্মসাতের ঘটনাও ঘটেছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যারা এই সময়ে সহায়তা নিয়ে দুর্নীতি করবে তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। তাতেও থামছে না এই অপকর্ম।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহে সারাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দের ২ হাজার ১৭৪ বস্তা চুরি হওয়া চাল উদ্ধার করেছে আইনশৃ্ঙ্খলা বাহিনী। তবে এখনও হদিস মেলেনি ৫৫০ বস্তা চালের। সবচেয়ে বেশি ৬৯৫ বস্তা চুরি হওয়া চাল উদ্ধার হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে এবং সবচেয়ে কম ৩৮ বস্তা উদ্ধার হয়েছে সিলেট বিভাগ থেকে। এসব ঘটনায় সারা দেশ থেকে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এই চাল চোররা অবশ্য ছোট চোর এবং অবশ্যই ছ্যাচড়া ছোটলোক চোর। না হলে সামান্য গরিবের হক মেরে খায় কোন আহাম্মক? আমাদের দেশে এর চেয়ে অনেক বড় বড় চোর আছে। এবং বলা বাহুল্য যে, চাল চোরের মতো ছোটোলোক চোরের চেয়ে বড়লোক চোর বেশি। কারণ বড়লোকদের আছে টাকার নেশা। এই নেশায় আচ্ছন্ন হওয়ার কারণে তারা কারণে-অকারণে চুরি করে, সব সময় চুরির ধান্দাতেই তাদের সময় কাটে। তাদের কাছ থেকেই সম্ভবত এই ছোটলোক চোরেরা শিক্ষা গ্রহণ করছেন। তারা কেবল স্থান-কালটা ভুলে গেছেন।
চুরি অবশ্য আমাদের দেশে এক অধিপ্রাচীন ব্যাধি। তাইতো চোর নিয়ে এখানে অনেক প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে কিছু আছে বহুল ব্যবহৃত। যেমন: চোরের মায়ের বড়ো গলা, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, চোরের সাক্ষী মাতাল, যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ, চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনি ইত্যাদি। তবে ছিঁচকে চুরি থেকে পুকুর-সমুদ্র চুরি, যে চুরিই হোক, নিরাপদে সারতে পারাটাও বিরাট কৃতিত্ব। পুকুর চুরি অর্থাৎ বড় ধরনের চুরি- এই যেমন রাষ্ট্রীয় কোটি টাকা পাচার কিংবা লাখ টাকা ঘুষ বাবদ গ্রহণ করলে তিনি গণমাধ্যমে আলোচিত বা 'হিরো' হয়ে যান। দিনের পর দিন তাকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। আলোচনা হয়। সে তুলনায় ছোটখাট চোররা অনালোচিত থেকে যান। তাদের খোঁজ নেয় না কেউ। সাধারণ জনগণ দু একটি চড়-থাপ্পড় দিয়ে বিদায় করে দেয়। ভাগ্য খারাপ হলে হয়তো কিছুটা বেশি শাস্তিও পেতে হয়!
চুরি আসলে এক 'চমৎকার' আর্ট। কমবেশি অনেকেই এ বিদ্যা চর্চা করে। কিন্তু ধরা পড়ে খুব কম জনই। আর এর সুবিধা হলো, ধরা না পড়া পর্যন্ত কাউকে চোর বলাও যায় না! চুরিটা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এমনভাবে মিশে গেছে, এ নিয়ে কেউ তেমন আর মাথা ঘামায় না। তবে মাঝেমধ্যে দু একটি বড় চুরির ঘটনা ধরা পড়ে বা উদ্ঘাটিত হয়। তখন আমরা খানিকটা হইচই করি। ধর্মের বাণী স্মরণ করি। ব্যস। তারপর যেই লাউ সেই কদু। আমরা আবার চুরির মওকা খুঁজি। চুরি বিদ্যার চর্চা অব্যাহত রাখি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ নানা দিক থেকেই অনন্য, অসাধারণ। চুরি করে বড়লোক হওয়ার মতো এমন সুন্দর অনুকূল পরিবেশ পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না। তাইতো এখানে কমবেশি সবাই বড়োলোক হবার বাসনায় চুরি করেন। ঘুষ খান, দুর্নীতি করেন।
অবৈধ পন্থায় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আমাদের দেশে টাকা উপার্জন অনেকেই করেন। শত শত হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তাদের মধ্যে ধরা পড়ে কজন? ঢাকা শহরের এমন অনেক আলিশান বাড়ি ও দামি গাড়ির মালিকদের খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের এ অর্জন অবৈধ পন্থায় ঘুষ-দুর্নীতির টাকায়। এরটা মেরে, ওরটা কেড়ে, ঠকিয়ে-প্রতারণা করে, বিপদের সুযোগ নিয়ে, ফাঁসিয়ে দিয়ে কিংবা ঘুষ-দুর্নীতির চোরাপথ ছাড়া এদেশে বড় ধনী হওয়া যায় না। আর সেটা সবাই পারেও না। আসলে টাকা উপার্জন করাটা যেমন একটা আর্ট, উপার্জিত টাকা সকলের অগোচরে 'সংরক্ষণ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ' করতে পারাটাও একটা আর্ট। এই আর্ট সবাই রপ্ত করতে পারে না। এর জন্য সাধনা লাগে। দক্ষতা অর্জন করতে হয়। ম্যানেজ করতে জানতে হয়। পুকুর চুরি করে সেই পুকুর আড়াল করে রাখা বা গায়েব করে দেওয়াটা সহজ বিদ্যা নয় মোটেই। অনেকেই সেটা পারেন এবং করেন। কিন্তু আমাদের সমাজে কিছু কিছু আনাড়ি চোরও আছে। যেমন এই চাল চোরগণ। 'আড়াল করবার বিদ্যা' অর্জন ছাড়াই যেভাবে চাল চোররা ধরা পড়ছেন, তাতে লোকগুলোর প্রতি তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। সামান্য কয়েক বস্তা চাল যারা 'গোপন' বা 'হজম' করতে পারে না, ম্যানেজ করতে পারে না, তাদের আসলেই কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত! হাত-পা ভেঙে তিন রাস্তার মোড়ে খাঁচায় ভরে রাখা উচিত! যাতে তাদের দেখে অন্যসব শিক্ষানবিস চোর শিখতে পারে যে, চুরি করলেই কেবল হবে না, চোরাই মাল 'হাপিস' করে দেবার দক্ষতা আগে অর্জন করতে হবে।
এইসব আনাড়ি চোরের কারণে দেশ এবং সরকারের ভাবমূর্তির বারোটা বাজছে। অথচ যারা কঠিন-কঠোর মানি লন্ডারিং আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সরকার-প্রশাসন-গোয়েন্দা-গণমাধ্যমকে ভেড়া বানিয়ে অত্যন্ত কৌশলে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে, বিভিন্ন দেশে দোকান-বাড়ি-জায়গা জমি কিনছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লেখাপড়ার নামে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তারা কিন্তু চিহ্নিত হচ্ছে না। এতে দেশের ভাবমূর্তিরও কোনো রকমফের হচ্ছে না! এদের কাছে শেখার আছে অনেক কিছু। কিন্তু এই আনাড়ি চাল চোরেরা কিছু শিখেছে বলে মনে হয় না। তা না হলে এই ঘোর করোনাকালে সামান্য কয়েক বস্তা চাল কেউ বলদের মতো চুরি করতে যায়?
কিসের রবীন্দ্রনাথ, কিসের পিকাসো, আমাদের দেশে অধরা অনির্ণীত বড় বড় চোরেরাই প্রকৃত 'আর্টিস্ট'। প্রকৃত শিল্পীসত্তা। অসম্ভব শিল্পিত কায়দায় যারা ব্যাংক থেকে, শেয়ার বাজার থেকে, বিদ্যুৎ থেকে, আমদানি-রপ্তানির নামে সকলের অজান্তে শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছেন, রাষ্ট্রের চেয়েও যারা বেশি ক্ষমতাবান, আসলে তারাই মানুষ তারাই দেবতা! আসুন দল বেঁধে সবাই আজ 'গাহি তাহাদের গান!'