Published : 07 May 2024, 10:04 PM
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ’জমি দখল’ করে সরকারি টাকায় নিজের খামারের জন্য সড়ক বানানোর অভিযোগ উঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।
চেয়ারম্যানের ভয়ে অনেকে মুখ না খুললেও প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ওই সড়কে ৩০ শতাংশ জমি হারিয়ে অভিযোগ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে হয়রান এক প্রবাসী; কিন্তু পাচ্ছেন না কোনো সমাধান।
সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া-হাসনাবাদ সড়কের পরানপুর থেকে বিপুলাসার ইউনিয়নের বাকরা গ্রাম পর্যন্ত একটি মাটির রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।
আঁকাবাঁকা সড়কটির শেষ প্রান্তে আছে মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেনের গরু ও মাছের খামার।
ফসলি জমির মধ্য দিয়ে ২০২১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে নির্মিত ওই রাস্তার দুই পাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। খামারের চারপাশেও নেই অন্য কারও বসত। ফলে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রে রাস্তাটি কোনো প্রয়োজনীয়তা এখনও নেই।
দেখেই বোঝা যায়, শুধু জাকির হোসেনের মালিকানাধীন খামারের জন্যই সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি খরচে নির্মিত ওই রাস্তার সুফল ভোগকারী একমাত্র ওই খামারে যাতায়াতকারীরাই।
অভিযোগ উঠেছে, যাদের জমির উপর দিয়ে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে, তাদের কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ তো দেওয়া হয়ইনি, এমনকি তাদের অনুমতিও নেওয়া হয়নি।
চেয়ারম্যান জাকির নিজেও সরকারি অর্থে এ সড়ক নির্মাণ করার কথা বলেছেন। তার দাবি জনগণের উপকারের জন্যই এটি করা হয়েছে।
তবে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ না পেয়ে জমি হারানোর প্রতিকার চেয়ে সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ফল পাচ্ছেন না। তাদের অনেকে বলছেন, চেয়ারম্যানের ক্ষমতা ও ‘পেটুয়া বাহিনীর’ ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি দীর্ঘদিন। তবে বর্তমানে উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের মধ্যে সৌদি আরব প্রবাসী মিজানুরের অভিযোগ, এ ঘটনায় ২০২২ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে আসছেন। কিন্তু জাকিরের ক্ষমতার কারণে তিনি কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
উপজেলার পরানপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে মিজানুর মোবাইল ফোনে বলেন, “আমার ২২-২৩ বছরের কষ্টার্জিত আয়-উপার্জনের টাকা দিয়ে নাথেরপেটুয়া-হাসনাবাদ সড়কের পাশে সাড়ে ৪০ শতক জায়গা ক্রয় করি।
“কিন্তু আমাকে না জানিয়েই আমার জমির উপর দিয়ে ১৪ ফুট প্রশস্ত ‘এল’ আকৃতি করে রাস্তা তৈরি করেন জাকির হোসেন। এতে আমার প্রায় ৩০ শতক জায়গা রাস্তার ভিতর পড়ে যায়। আর বাকি অংশ গর্ত করে মাটি নিয়ে গেছেন তিনি।”
কথাগুলো বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন সৌদি প্রবাসী মিজানুর।
তিনি বলেন, “তিনি জনগণের টাকা অপচয় করে নিজের জন্য এই দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ করেছেন। আমি প্রবাসে থাকার কারণে বহু লোককে বিভিন্নভাবে বিষয়টি জানালেও জাকিরের পেটুয়া বাহিনীর ভয়ে কেউ রাস্তার কাজ বন্ধ করতে পারেনি।”
সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জাকির হোসেনের বিচার দাবি করে মিজানুর বলেন, “আমি বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, কুমিল্লা জেলা প্রশাসক, কুমিল্লা পুলিশ সুপার, মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, সৌদি আরব অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন মহলে জানিয়েছি।”
তবে ক্ষতিপূরণ বা বিচারের বদলে পেয়েছেন হুমকি- জানিয়ে এই প্রবাসী বলেন, “বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবাদ করার কারণে জাকির এবং তার পেটুয়া বাহিনীর বিভিন্ন সদস্য আমার পরিবারের সব সদস্যকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছে।
“ফলে প্রায় ২ বছর ধরে জাকির ও তার পেটুয়া বাহিনীর ভয়ে আমার পরিবারের সদস্যরা গ্রামে থাকতে পারছে না।”
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষতিগ্রস্ত আরেক জমির মালিক বলেন, “আমার পৈত্রিক সম্পত্তির ওপর দিয়ে জাকির তার নিজ খামারে যাতায়াতের জন্য রাস্তাটি নির্মাণ করেছেন। এত দীর্ঘ রাস্তা হলো আমাদের জমির উপর দিয়ে; কিন্তু ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা আমাদেরকে জিজ্ঞেসও করেননি তিনি।
“নিজের সুবিধার জন্য সরকারের পুরো টাকাটা অপচয় করেছেন তিনি। কিন্তু তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না। এজন্য আমরা চুপ করে আছি।”
এ প্রসঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন বলেন, “সরকারি বরাদ্দে ওই রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে জনগণের স্বার্থে। এ রাস্তার কারণে শত শত মানুষ উপকৃত হয়েছে। শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি ছাড়া এ রাস্তা নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই।
“বর্তমানে রাস্তার বিষয়টি নিয়ে আদালতে একটি মামলা চলছে বলে আমি জানি। তাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই না।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজালা রানী চাকমা বলেন, “যে সময় রাস্তাটি নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে- সে সময় আমি এখানে ছিলাম না। আমি যোগদানের পর বিষয়টি নিয়ে কেউ আমাকে অভিযোগ করেনি। তবে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।”