Published : 07 Aug 2016, 09:06 PM
''সন্ত্রাসবাদ তো সন্ত্রাসবাদই। এর ভালো বা মন্দ বলে কিছু হয় নাকি!''
ইসলামাবাদে সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সদ্যসমাপ্ত সম্মেলনে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে এ মন্তব্যই করেছেন। চৌধুরী নিসার আলী তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে এই উক্তি করার পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও বলেছেন, ''সন্ত্রাসের ভালো-মন্দ হয় না।''
ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, নেপালসহ আরও কয়েকটি প্রতিবেশি দেশ। পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই সন্ত্রাসবাদে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ছিল ভারতবর্ষ, এখন তারা 'সন্ত্রাস-মানচিত্র'তে যুক্ত করেছে বাংলাদেশকেও।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইসলামাবাদ পৌঁছানোর পরই সেখানকার রাস্তায় জিহাদি পোশাক পরে কয়েক হাজার মানুষ তাঁর আগমনের বিরোধিতা করে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এমনকি অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করা হলেও তাঁকে না নিয়ে নিজেই গাড়ি করে চলে যান পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশে ফিরে রাজনাথ সিং সংসদে যাবতীয় ঘটনা খুলে বলেন।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, যে উদ্যোগে আটের দশকে সার্ক গঠিত হয়েছিল, এই ঘটনার পর কি আরত তার প্রয়োজন আছে? ভারতের মিডিয়া পাকিস্তানের এই ন্যাক্কারজনক আতিথেয়তার নিন্দা করে প্রতিদিন সোচ্চার হচ্ছে। ভারত তার চিরাচরিত প্রথা মেনেই দলমত নির্বিশেষে রাজনাথের পাশে দাঁড়িয়েছে; যেমন দাঁড়িয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়।
কয়েক হাজার মানুষ ইসলামাবাদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাজনাথ সিংয়ের পাকিস্তান সফরের বিরোধিতা করেছে। সেই পথ-আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা ইয়াসিন মালিকের স্ত্রী মিশাল মালিকও। এমনকি রাজনাথ সিংয়ের হোটেলের চত্বরে নিরাপত্তারক্ষীদের ভেদ করে কয়েক শ বিক্ষোভকারী জমায়েত হয়েছিল। এর পাশাপাশি রাজনাথ কেন পাকিস্তানের বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছেন সে প্রশ্ন তুলে তাঁর কুশপুতুল পুড়িয়েছেন কট্টর হিন্দুত্ববাদীরাও।
তাঁর সফরের সমস্ত প্রতিবাদ এবং বিরোধিতা অগ্রাহ্য করেই রাজনাথ সিং পাকিস্তানে গিয়ে ভারতের মতো দেশের নৈতিক উচ্চতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গেও দেখা করেন। দুদেশেই ক্রোধ এবং প্রতিহিংসার প্রেক্ষাপট তৈরি থাকলেও রাজনাথ সিং ইসলামাবাদে গিয়ে প্রকৃত কূটনৈতিক কর্তব্যই করেছেন বলে মনে করছে ভারতের রাজনৈতিক মহল।
উল্লেখ্য, কাশ্মীরের সাম্প্রতিক উত্তেজনার রেশ বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়েছে ভালোমতোই। বস্তুত, কট্টরপন্থী হিজবুল জাওহি বুরহাজ ওয়ালির মৃত্যুর ঘটনা কেন্দ্র করে ওই রাজ্যটিতে বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাস চলছে রাজনাথ সিং ফিরে আসার পরও।
ভূস্বর্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে এর আগেও আন্তর্জাতিক স্তর ও ঘরোয়া রাজনীতিতে একাধিকবার অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কিন্তু ইসলামাবাদে সার্ক দেশগুলোর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকটি হাতিয়ার করে সেই ক্ষত অনেকটাই মেরামত করতে পেরেছেন রাজনাথ সিং। এর পাশাপাশি অাসামের কোকরাঝাড়েও সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
এবার একটু নেপথ্যের ঘটনায় দিকে তাকানো যাক। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর দেশীয় রাজ্যগুলো ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর সেই সময় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং জওহরলাল নেহরুকে চিঠি দিয়ে ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেয়। ভারত সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রস্তাব মেনে নেয়। জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ব্রিটিশদের পরামর্শে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পাঠিয়ে কাশ্মীর দখল করার চেষ্টা করলে হরি সিং ফের চিঠি লিখে নেহরুকে বলেন, 'পাকিস্তানের হাত থেকে আমাদের বাঁচান। আমরা আক্রান্ত।'
হিন্দু রাজা হরি সিং তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ আবদুল্লাহকে নিয়োগ করেন। তাঁর পুত্র ফারুখ আবদুল্লাহ এবং পৌত্র ওমর আববদুল্লাহ ওই রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে আটবার নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়েছে জম্মু-কাশ্মীরে। হানাদার বাহিনী পাঠিয়ে ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে নিয়ে মূল ভূখণ্ড কাশ্মীরের ১৪টি জেলা দখল করে নেয়, যা এখনও 'আজাদ কাশ্মীর' নামে পরিচিত।
জোর করে ওই ১৪টি জেলা দখল করে রাখার প্রতিবাদে গোটা ভারতবর্ষ এবং বিশ্বের জনমত এমনকি আমেরিকাও নিন্দা করে চলেছে। এরপরও ১৯৬৫ সালে আবার কাশ্মীর আক্রমণ করেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। সেবারও তিনি পরাজিত হন। এরপর এল সেই ঐতিহাসিকক সময়– ১৯৭১ সাল। সে বছর ২/৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করে। তখন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনে 'বাঙালিরা' জয়লাভ করে। তখন আইয়ুব খান পদত্যাগ করে তাঁর আরেক ঘনিষ্ঠ ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা তুলে দেন। শুরু হয় অত্যাচারের নতুন 'ধারাবাহিক'।
বাঙালি জাতির জনক এবং জননায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর দেশবাসীকে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জনান। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তাদের পাশে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এসব তো ইতিহাস।
সেই মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নামা বাঙালিদের মধ্যে ৩০ লাখকে হত্যা করে পদ্মা-মেঘনার জল রক্তাক্ত করা হয়। এই ইতিহাস থেকে এখনও শিক্ষা নেয়নি পাকিস্তান। সেদিনের হানাদারদের বর্তমান প্রতিনিধিরাই সন্ত্রাসবাদী। তাদের একনিষ্ঠভাবে মদত দিয়ে চলেছে পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। একই সঙ্গে তারা মদত দিয়ে চলেছে বাংলাদেশের মাটিতে থাকা সন্ত্রাসবাদীদেরও।
আইএসআই কাশ্মীর দখল করা এবং ভারতবিরোধী যে দীর্ঘ কর্মসূচি নিয়েছে তার 'মুখ ও মুখোশ' রাজনাথ সিং ইসলামাবাদে দাঁড়িয়ে খুলে দিয়েছেন। এতেই ক্ষুদ্ধ হয়ে লস্কর-এ-তৈয়বা, জইশ-এ-মোহাম্মাদসহ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো রাস্তায় নামে। এর ফলে আরও বেশি সংখ্যক জঙ্গিকে যে কাশ্মীরে পাঠানো হবে তাতে সন্দেহ নেই। কাশ্মীরে সম্পূর্ণ অরাজকতা সৃষ্টি করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
এখানে উল্লেখ্য, একাত্তরের যুদ্ধের পরেই ১৯৭৭ সালে জনতা সরকারের বিদেশমন্ত্রী হয়ে অটল বিহারী বাজপেয়ী কূটনৈতিক সম্পর্ক ফের শুরু করতে ইসলামাবাদে যান। পাকিস্তান সহযোগিতা না করায় তাঁর সেই দূতিয়ালি ব্যর্থ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই শতকের গোড়ায় বাস নিয়ে লাহোরে গিয়েছিলেন বাজপেয়ী। সে সময়ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এই নওয়াজ শরীফই।
বাজপেয়ী উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। সে সময় আগ্রহ দেখিয়েছিলেন নওয়াজ শরীফও। নওয়াজ শরীফ ও বাজপেয়ীর এই উদ্যোগ তখন ভালোভাবে নিতে পারেননি পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশাররফ। বাজপেয়ী ফিরে আসার সাত দিনের মধ্যেই মুশাররফ কাশ্মীরের কারগিলে হামলা চালান। ভারতীয় সেনাদের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে দেশের মধ্যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। মুশাররফই হন সর্বেসর্বা। এবার তিনি দিল্লির কাছে প্রস্তাব পাঠালেন, তিনি দিল্লিতে ক্রিকেট খেলা দেখতে চান। তখন দিল্লিরও ক্ষমতা বদল হয়ে গেছে। দিল্লির মসনদে মনমোহন সিং।
প্রায় দুই বছর ধরে চলে কূটনৈতিক পর্যায়ের আলোচনা। স্থির হয় মনমোহন সিং যখন নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের বৈঠকে যোগ দিতে যাবেন, পারভেজ মুশাররফ তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন। ভারত তাতে রাজি হয়ে যায়। তখন আমেরিকায় জর্জ বুশের রাজত্ব। নিউ ইয়র্কে বৈঠকের পর মুশাররফ সোজা চলে যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎজা রাইসের কাছে। রাইস একদিন পরই মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে যান।
রিপোর্টার হিসেবে আমিও সেখানে ছিলাম। প্রধামন্ত্রীর প্রচার সচিব খবর দিলেন, 'আপনারা চলে আসুন, রাইস আবার আসছেন।' হোটেলের লবিতে বসে দেখলাম, রাইস সরাসরি লিফট ধরে উপরে চলে গেলেন। প্রচার সচিব জানালেন, মুশাররফ তাঁকে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। মুশাররফ চান ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে চার কিলোমিটার সরে যাক ভারতীয় বাহিনী।
মনমোহন সিং পত্রপাঠ সে প্রস্তাব খারিজ করে কন্ডোলিৎজা রাইসকে ফেরত পাঠিয়ে দেন। এরপরও হাল ছাড়েননি মুশাররফ। তাদের পরবর্তী বৈঠকটি হয়েছিল কিউবার রাজধানী হাভানায়। সেখানেও প্রায় চার ঘণ্টার আলোচনায় মুশাররফ কাশ্মীর নিয়ে আলোচনার দাবি জানাতে থাকেন। মনমোহন সিং মুশাররফকে স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, 'আপনি তো সামরিক ডিক্টেটর। যদি কোনো ইস্যু নিয়ে কথা বলতেই হয়, তাহলে আমরা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই বলব। আর কয়েক মাসের মধ্যেই আপনাদের দেশে নির্বাচন।'
তখন মনমোহনের পাশে বসা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন একটি উক্তি করেছিলেন, 'মোশাররফ কি বেনজিরকে ক্ষমতায় আসতে দেবেন?'
গুজব শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং আইএসআই আবার নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চলেছে। তাই তিনি নতুন করে ভারতবিরোধী জিগির তুলতে শুরু করে দিয়েছেন। যার মুখবন্ধটা তিনি করে রাখলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সফরের সময়।
বর্তমান পরিস্থিতি কোন দিক নির্দেশ করছে? পাকিস্তান যতই চেষ্টা করুক না কেন, তারা যে কোনো মতেই সফল হবে না, তা এখনই বলে দেওয়া যেতে পারে।