১৯৭৫ সালের অগাস্ট ট্রাজেডির পরে বছরের পর বছর ধরে জনপরিসরে যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে তা হলো, এই হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রতিবাদ হয়নি। অথচ ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা।
Published : 15 Aug 2024, 11:24 AM
১৯৭৫ সালের অগাস্ট ট্রাজেডির পরে বছরের পর বছর ধরে জনপরিসরে যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে তা হলো, এই হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রতিবাদ হয়নি। অথচ ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই এই হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেছেন; যাদের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটিরও কয়েকজন সদস্য ছিলেন। সেরকম কয়েকটি প্রতিবাদের ঘটনা নিয়ে এই আয়োজন।
সিরাজুল হক: বন্দুকের নলের মুখে মোশতাককে চ্যালেঞ্জ
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে বঙ্গভবন দখল করেন। তার চারপাশ ঘিরে তখন খুনিচক্র। চারিদিকে থমথমে অবস্থা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ চার নেতাও কারাগারে। অনেকে আত্মগোপনে। অনেকে যোগ দিয়েছেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের বৈঠক ডাকেন খন্দকার মোশতাক। ওই বৈঠকে যোগ দেন সিরাজুল হক। বঙ্গভবনের দরবার হলে বৈঠকে যোগ দেন অন্য সংসদ সদস্যরাও। সবাই নিরব-নিশ্চুপ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিদের আশ্রয়ে খন্দকার মোশতাক বিনা প্রতিবাদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করলেও সংসদীয় দলের বৈঠকে বঙ্গভবনে তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন সিরাজুল হক। স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, তিনি খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানেন না। মোশতাককে তিনি ‘অবৈধ প্রেসিডেন্ট’ বলে আখ্যা দেন। এ নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। মোশতাককে ঘিরে রাখা খুনিচক্র রাইফেল তাক করে সিরাজুল হককে গুলি করার জন্য। কিন্তু তিনি থামেননি।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ লিখেছেন: খন্দকার মোশতাক তার ক্ষমতা দখলকে জাতীয় সংসদ কর্তৃক বৈধতাদানের অভিপ্রায়ে অধিবেশন আহ্বানের পরিকল্পনা করেন। প্রয়োজনবোধে তাদের হাত করার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ বঙ্গভবনে সাংসদদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু নগণ্যসংখ্যক সদস্য উপস্থিত হওয়ায় সভার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। ১৬ অক্টোবর বঙ্গভবনে পুনরায় সভা আহ্বান করা হয়। এদিন বেলা দশটায় একশোর বেশি এমপি সেখানে উপস্থিত হন। তবে আওয়ামী লীগের প্রথম কাতারের কোনো নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। বঙ্গভবনে না যাওয়ার পক্ষে আমরা দল বেঁধে প্রকাশ্য লবিং শুরু করি। শুরু হয় চরম উত্তেজনা। সিরাজুল হক সাহেব আমাদের কথা দেন, তিনি ছোট একটি প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখবেন এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়টি উপস্থাপন করবেন। তিনি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে ‘মোশতাক ভাই’ সম্বোধন করেন। বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সম্বোধন করতে পারি না। কোন আইনের বলে আপনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তা জানি না। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাদের সাথে আপনি বঙ্গভবনে আশ্রয় নিয়েছেন এবং আমাদেরকে বলেছেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নিতে। আপনি যদি সত্যিই রাষ্ট্রপতি থাকতে চান, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা আমাদের জানাতে হবে। আইনানুযায়ী আপনাকে ‘বৈধ রাষ্ট্রপতি’ বলা যায় না। (অধ্যাপক আবু সায়িদ, তোমার আলোকে রহিব জাগিয়া, অনন্যা/২০২০, পৃষ্ঠা ১৭৫)।
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরীও ওই ঘটনার সাক্ষী। লিখেছেন: ‘সম্ভবত অক্টোবরের ১৬ তারিখে সংসদ সদস্যদের এক সভা বঙ্গভবনে ডাকা হয়। সভাস্থলের চারপাশে এবং গেটে ১৫ অগাস্টের খুনিদের নেতৃত্বে সশস্ত্র সৈন্যরা অবস্থান নিয়ে প্রহরা দিতে থাকে। স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। এতে অনেকেই ভীতসন্ত্রস্তভাবে অত্যন্ত সংযত বক্তব্য রাখেন, যাতে মোশতাকের বিরাগভাজন হতে না হয়। কিন্তু কালিগঞ্জের ময়েজ উদ্দিন আহমদ, কালিয়াকৈরের শামসুল হক ও অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। মনে পড়ে, আমার বক্তব্যে আমি বলেছিলাম, ১৫ অগাস্ট প্রত্যুষে ৩২ নম্বরে রাজনীতির যে নিষ্ঠুর মর্মান্তিক পরিণতি দেখেছি, তাতে রাজনীতি করার আর শখ নেই।’(মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিনকাল, অনন্যা/২০০৩, পৃষ্ঠা ১৭০)।
অধ্যাপক আলী আশরাফ তখন সংসদ সদস্য (কুমিল্লা-১১)। স্মৃতিচারণ করে বলেন, ওই দিনের বৈঠকের স্থান ছিল বঙ্গভবনের দরবার হলে। কিন্তু অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক লোকজন চারপাশ ঘিরে থাকায় দরবার হলকে মনে হচ্ছিল অবরুদ্ধ কোনো কম্পার্টমেন্ট। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল বিধায় তিনি ভয় পাচ্ছিলেন খুনিরা হয়তো গোলাগুলি শুরু করবে। তিনি বলেন, আমি সিরাজুল হকের বাহু আঁকড়ে ধরে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসি। কারণ তখন সবাই পালাচ্ছিলো। (ভোরের কাগজ, ২৯ অক্টোবর ২০২২)।
প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মুসা তখন নোয়াখালী-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। বলছেন, ‘সিরাজুল হক সরাসরি খন্দকার মোশতাককে প্রশ্ন করলেন, আপনি কেন মুজিবকে হত্যা করেছেন? মোশতাক বললেন, এই হত্যাকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা কী ছিল, তা জনগণ যথাসময়ে উপলব্ধি করতে পারবে। সিরাজুল হক তখন বললেন, প্রয়োজনীয়তাটা কী ছিল তা জানতে আমি অপেক্ষা করবো। তা না জানা পর্যন্ত আমরা আপনাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি না।
প্রতিবাদে সোচ্চার শামসুদ্দীন মোল্লা
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য শামসুদ্দীন মোল্লা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ও সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা উভয়েই কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়েছেন এবং বেকার হোস্টেলে থেকেছেন। উভয়ের বাড়িই ছিল বৃহত্তর ফরিদপুরে। ডায়েরিতে শামসুদ্দীন মোল্লা লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলতেন Mollah is my oldest colleague & closest friend।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে এবং বিদেশে নেতৃত্ব দেন শামসুদ্দীন মোল্লা। ওই নৃশংস হতাকাণ্ডের পরে অনেকেই নানা দিকে চলে গেলেও নিজের আদর্শ থেকে সরেননি বঙ্গবন্ধুর এই ক্লোজেস্ট ফ্রেন্ড। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা শহরে প্রথম প্রতিবাদ মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের দ্বিতীয় দফা সেনা অভ্যুত্থানের পরের দিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়েছিল ওই মিছিল।
শামসুদ্দীন মোল্লার ভগ্নিপতি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের বাসায় গোপন বৈঠক হয় ওই মিছিল আয়োজনের। সব বৈঠকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইসমত কাদির গামাসহ ছাত্রনেতারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ৭ নভেম্বরের তৃতীয় দফা সেনা অভ্যুত্থানের পর জিয়া সরকার শামসুদ্দীন মোল্লাকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিলে তিনি ভারতে গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যতদিন জীবিত ছিলেন, শামসুদ্দীন মোল্লা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার আদর্শের প্রতি অনুগত ছিলেন। (লায়েকুজ্জামান, কালের কণ্ঠ, ১০ জুলাই ২০২১)।
কী করেছিলেন ড. কামাল?
বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেভভাজন এবং সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট যুগোস্লাভিয়ায় অবস্থান করছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে অনেকেই তার ১৫ অগাস্টের ভূমিকার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি নিজে কী বলছেন? কামাল হোসেন বলছেন: ‘১৫ অগাস্ট আমি যুগোস্লাভিয়ায় ছিলাম। সকালবেলা খবর পেলাম যে সাংঘাতিক খারাপ ঘটনা ঘটেছে। একটি ক্যু সংঘটিত হয়েছে এবং শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তখনই বনে (জার্মানির শহর) চলে গেলাম। কারণ, শেখ মুজিবের কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তখন সেখানে ছিলেন, তার স্বামী সেই সময় বনে গবেষণারত ছিলেন। যদিও আমি ঢাকায় ফিরে আসব বলে ঠিক করেছিলাম, তারপর ভাবলাম, আমার বনে গিয়ে সেখানকার অবস্থা দেখে আসা উচিত। আমি সেখানে গেলাম এবং সারাটা দিন শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে কাটালাম। তারা বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আমাদের এখানে রেখে ফিরে যাবেন না? আমি বললাম, না, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যে আমি সেটা করব না। তবে আমি লন্ডনে যাচ্ছি। কারণ, সেখানে আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। যদি আমাকে ফিরে যেতেই হয়, আমি অবশ্যই দেখব যেন আপনারা নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে ফিরে যেতে পারেন এবং সেটা নিশ্চিত না করে আমি কখনোই ফিরে যাব না।’
ড. কামাল বলছেন, ‘১৫ অগাস্ট ঘটনাটা ঘটল, ১৬ তারিখ আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করলাম এবং ১৭ তারিখে আমি লন্ডনে গেলাম। বাংলাদেশ দূতাবাসে আমি আমার কূটনৈতিক পাসপোর্ট জমা দিয়ে বললাম, যে সরকার ক্ষমতা দখল করেছে, তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বলল, না, সে প্রশ্নই ওঠে না।…সেই সময়টায় অনেকটা দৈব ঘটনার মতোই অক্সফোর্ড থেকে একটা ফোন এল এবং আমাকে একটি গবেষণা ফেলোশিপের আমন্ত্রণ জানানো হলো।’ (ড. কামাল হোসেন সম্মাননা গ্রন্থ, প্রথমা/২০২৪, পৃ. ৮০)।
অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ ছাড়লেন ফকির সাহাবউদ্দীন
বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হন, তখন বাংলাদেশেরর অ্যাটর্নি জেনালের দায়িত্বে ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফকির সাহাবউদ্দীন আহমদ। তার মেয়ে তাহমিনা জাকারিয়া বলেন: ‘১৫ অগাস্টের ঘটনার প্রতিবাদে আব্বা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৬ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে পদত্যাগপত্র লেখেন।’
ফকির সাহাবউদ্দীন আহমদের আরেক মেয়ে মেরিনা আহমেদ জানান, ১৫ অগাস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরপরই অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ফকির সাহাবউদ্দীন। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছিলেন, তিনি যে এই পদে থাকতে চান না, সেটি আগেই রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে তার কথা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন—যেখানে অনুরোধ করা হয় যে, পয়লা এপ্রিল থেকে যেন তার পদত্যাগ কার্যকর হয়, যদি এর আগে সম্ভব না হয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ফকির সাহাবউদ্দীন আহমদ ১৯৭৬ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন। তার মানে পয়লা এপ্রিলের আগেই তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। তাহমিনা জাকারিয়া বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হন তার বাবা। তাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে, তাদের অধীনে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চাননি।
বিচার দাবিতে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন খোরশেদ আলম
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ট্র্যাজেডির পরে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক খোরশেদ আলম আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে পাড়া, মহল্লা ও থানায় থানায় কর্মীসভা করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য জনমত সৃষ্টি করেন। রামঘাটে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আলোচনা, মিলাদ মাহফিল ও কাঙালিভোজের আয়োজন করেন। সহযোদ্ধা আবদুল আজিজ খান, অ্যাডভোকেট আহমেদ আলী, মীর হোসেন চৌধুরী, অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার, অলি আহমদ, আবদুল মতিন খসরু, মুজিবুল হক মুজিব, অধ্যক্ষ আবদুর রউফ, অধ্যক্ষ আফজল খান, জসিম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, মফিজুর রহমান বাবলু, আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারসহ অন্যদের নিয়ে প্রতিকুল পরিবেশে দলকে সংগঠিত রাখার চেষ্টা করেন। খোরশেদ আলমও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন।
প্রতিকূল সময়ে কাঙালি ভোজ দিতেন লুৎফর রহমান
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে খন্দকার মোশতাক নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকেন। কিন্তু তার ডাকে সাড়া দিয়ে যারা ওই বৈঠকে যাননি, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য লুৎফর রহমান তাদের অন্যতম। ১৯৭৬-৭৭ সালের বিরুদ্ধ সময়ে তিনি ১৫ অগাস্ট উপলক্ষ্যে গাইবান্ধা শহরে কাঙালিভোজের আয়োজন করেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার দলীয় লোকজন তা গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর তিনি শহরের পূর্ব প্রান্তে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সরকারি দলে লোকেরা সেখানেও হামলা চালায়। এরপর বাধ্য হয়ে তিনি নিজের বাড়ি সংলগ্ন স্কুলে কাঙালিভোজের ব্যবস্থা করেন। একপর্যায়ে খুনী চক্রের হাত থেকে বাঁচার জন্য অন্য আরও অনেকের মতো আত্মগোপন চলে যান লুৎফর রহমান। আত্মগোপনে থেকেই জোহরা তাজউদ্দিন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীসহ অন্যদের সঙ্গে দল পুনর্গঠনে অংশ নেন।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ না দেয়া একমাত্র প্রতিমন্ত্রী
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আব্দুল মমিন তালুকদার বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি ‘বাকশাল’ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি। প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ১৬ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১০ জন এবং প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে আব্দুল মমিন তালুকদার ছাড়া বাকি সবাই মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যারা যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন ৫ জন। তারা হলেন ১. আবদুল মমিন, ২. আসাদুজ্জামান খান, ৩. নুরুল ইসলাম মনজুর, ৪. নুরুল ইসলাম চৌধুরী এবং ৫. ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল। বলা হয়, তারা প্রত্যেকে বন্দুকে নলের মুখে কিংবা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে বাধ্য হন। তবে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়ায় মমিন তালুকদারকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আব্দুল মমিন তালুকদার। ‘প্রক্লেমেশন অব পলিটিক্যাল পার্টিস রেগুলেশন ১৯৭৬’ অনুযায়ী দলীয় গঠনতন্ত্র জমাদানের আদেশ প্রদান করা হয়। এই আইন বলে দলীয় গঠনতন্ত্রে মৃত ব্যক্তির নাম বা আদর্শে দল পরিচালনা নিষিদ্ধ করা হয়। এই সময় মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাড়িতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দলীয় গঠনতন্ত্রে শেখ মুজিবর রহমানের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ না রাখার প্রতিবাদ করায় এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের স্মরণে শোকদিবস পালনের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস উদযাপন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘদিন পর তিনি হাইকোর্টের আদেশে মুক্তিলাভ করেন। এরপর আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সংগঠিত করতে প্রায় প্রতিটি জেলায় জনসংযোগ করেন এবং দলকে পুনর্গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
শোকে হাইকু লিখলেন জাপানের এমপি
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যদিও সিলেট আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির টানাপোড়েনের কারণে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। এ নিয়ে তার (বঙ্গবন্ধু) মনে আক্ষেপ ছিল। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও সুদর্শন মুন্তাকীম চৌধুরীর জন্য রাষ্ট্রদূতের কাজ অবধারিত ছিল এবং তিনি এই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি মুন্তাকীম চৌধুরী। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে মেয়ের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান।
মুন্তাকীম চৌধুরীর জামাতা খ্যাতিমান বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী জানাচ্ছেন, জাপানের সংসদ সদস্য হায়াকাওয়ার সঙ্গে মুন্তাকীম চৌধুরীর সুসম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার সংবাদ শোনার পরে মি. হায়াকাওয়া ভীষণ মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিবেদন করে একটি হাইকু (একধরনের জাপানি কবিতা) লিখে সেটি পড়েন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন।
রাজনীতি ছেড়ে আধ্যাত্ম্যবাদের পথে হুমায়ুন খালিদ
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদের প্রতিবাদের ধরনটা ছিল ভিন্ন। তিনি অগাস্ট ট্র্যাজেডির পরে রাজনীতি থেকেই সরে দাঁড়ান এবং আধ্যাত্মবাদের পথ বেছে নেন। তার ছেলে খালিদ মুরাদুজ্জামান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হলে আব্বা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। শুধু তাই নয় তিনি আমাদের ভাইবোনদেরকেও রাজনীতিতে যুক্ত না হওয়ার নির্দেশ দেন।’
হুমায়ুন খালিদের রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার প্রসঙ্গে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শাজাহান সিরাজ লিখেছেন: আসলে হুমায়ুন খালিদের মধ্যে যে রাজনীতি ছিল— ‘শুধু তার মধ্যে কেন, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলাম, আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আসলে স্বাধীনতার পর সেই লক্ষ্য বিচ্যুৎ হয়ে গেল এবং এই কারণে অনেকেই রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ যে আদর্শ নিয়ে, যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা রাজনীতি করতাম, তার কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।’ (অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ স্মারকগ্রন্থ, লে. কর্নেল আবদুস সালাম মিয়া (অব.) সম্পাদিত/জানুয়ারি ২০০৯, পৃ. ৩৭।)।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালেও বিভিন্ন সময়ে হুমায়ুন খালিদকে পদ-পদবী এমনকি মন্ত্রিত্বেরও অফার দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি নীতির সঙ্গে আপোস করতে রাজি হননি এবং দলীয় আদর্শও পরিবর্তন করতে চাননি।