পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সমতলেও

এতদিন ধরে নেওয়া হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিটি বাস্তবায়নের দাবি শুধু জুম পাহাড়ের মানুষদের বিষয়। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে গড়ে তোলা একটি প্ল্যাটফর্ম অনুধাবন করতে পেরেছে জুম পাহাড়ের মতো দেশের অপরাপর মানুষের অধিকারও একই সুতোয় গাঁথা।

দীপায়ন খীসাদীপায়ন খীসা
Published : 20 Nov 2023, 02:13 PM
Updated : 20 Nov 2023, 02:13 PM

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংঘাতের অবসানে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক এই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়।

২৫ বছর পেরিয়ে ২৬ বছরের দ্বারপ্রান্তে চুক্তির বয়স। বাস্তবতা হলো, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনও বাস্তবায়িত হয়নি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে তার অনন্য বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও বিকাশের কাজটি এখনো অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে এখনো ঔপনিবেশিক কায়দায় পাহাড়ি মানুষের ওপর সামরিক-বেসামরিক শাসন ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে।

এমতাবস্থায় গত ২ ডিসেম্বর চুক্তির ২৫ বছর উপলক্ষে দেশের সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের সম্মিলিত প্রয়াসে ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ বাস্তবায়নে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়। এই প্ল্যাটফর্মটি চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রামকে এক নতুন মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছে। এতদিন যাবৎ ধরেই নেওয়া হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিটি শুধুমাত্র জুম পাহাড়ের মানুষদের বিষয়। সুতরাং চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য শুধু জুমিয়া মানুষই লড়াই চালাবে। দেশের অন্যান্য অংশের লোকজন পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মিছিল, সমাবেশে গিয়ে সংহতি জ্ঞাপন করবে। এটাই আমরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যক্ষ করে আসছিলাম।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন নামক প্ল্যাটফর্মটি সেই প্রচলিত খোলস থেকে বেরিয়ে এসে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সমর্থন নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সংগ্রামকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার এক নতুনতর দিক সংযোজন করেছে। প্ল্যাটফর্মটির দুই যুগ্ম সমন্বয়কারী মানবাধিকারকর্মী জাকির হোসেন ও অধ্যাপক ড. খায়রুল চৌধুরী জানাচ্ছেন, রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ এবং সিলেট বিভাগে তারা সংহতি সমাবেশ ও গণমিছিল সম্পন্ন করেছেন। প্রতিটি সমাবেশে দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং তাদের গণসংগঠনগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্ব স্ব ব্যানারে মিছিল সহকারে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছিল বলে প্ল্যাটফর্মটির সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের দুই সমন্বয়কারী জানিয়েছেন প্ল্যাটফর্মটির উদ্যোগে বিভিন্ন পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়, প্রগতিশীল ছাত্র-যুবাদের সমাবেশ ইত্যাদি নানান কর্মসূচি সম্পন্ন করা হয়েছে।

অতি সম্প্রতি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ চুক্তি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একটি খোলা চিঠি দিয়েছে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফের ডটকমসহ দেশের গণমাধ্যমসমূহ বেশ গুরুত্বসহকারে এই চিঠি প্রদানের সংবাদটি প্রকাশ করে। খোলা চিঠিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন কর্তৃক উত্থাপিত ৭ দফা বাস্তবায়নে অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে আহ্বান জানানো হয়।

তাদের ৭ দফা হচ্ছে: ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে এই চুক্তির দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করা; খ) পাহাড়ে সামরিক কর্তৃত্ব ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের স্থায়ী অবসান; গ) আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিকীকরণ ও স্থানীয় শাসন নিশ্চিতকরণে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক যথাযথভাবে ক্ষমতায়িত করা; ঘ) পার্বত্য ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত থেকে প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের পুনর্বাসন করে তাঁদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা; ঙ) দেশের মূলধারার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা; চ) ইউনিয়ন পরিষদসহ সকল স্তরের স্থানীয় সরকারে সমতলের আদিবাসীদের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ ও আদিবাসী জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং ছ) সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা।

খোলা চিঠিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, “দেশের এক দশমাংশ ভূখণ্ডকে ক্রমাগত ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসনের মধ্যে রাখা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের প্রিয় দেশমাতৃকার মূল চেতনা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের পরিপন্থি। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে সেখানকার জুম্ম আদিবাসী জনগণের ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়িয়ে উক্ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিতকল্পে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

“রাজনীতিবিদরাই সমাজকে পথ দেখিয়েছেন, নীতির ভিত্তিতে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমরা আশা করি দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের স্ব স্ব দল ও অবস্থান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের পন্থা হিসেবে ১৯৯৭ সালে যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতি চাপ সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।”

সবশেষে খোলা চিঠিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ৪ দফা আহ্বান রাখা হয়। প্ল্যাটফর্মটির ৪ দফা আহ্বানগুলো হচ্ছে, ১. সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের পক্ষে উত্থাপিত ৭ দফা দাবিনামার আলোকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণা করা; ২. প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের উত্থাপিত সাত (৭) দফা দাবিসমূহ গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্ত করা; ৩. রাজনৈতিক দল ও তার সহযোগী সংগঠনসমূহে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আদিবাসী জনগণের বিষয়ে একজন মুখপাত্র ও সাংগঠনিকভাবে সম্পাদকীয় পদ তৈরি করা; ৪. জাতীয় সংসদসহ স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহের সকল স্তরে আদিবাসীদের দলীয় মনোনয়ন প্রদান করা।

দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর অতিক্রম করার প্রাক্কালে এই খোলা চিঠি নিশ্চয়ই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটির নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন খোলা চিঠিটি ইতোমধ্যেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং নিবন্ধিত আন্যান্য দলগুলোর দলীয় কার্যালয়ে পোঁছানো হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে খোলা চিঠির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট দফা সম্বলিত আহ্বান রেখেছে।

এই বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকেরা আদৌ আমলে নেবেন কি? আমাদের প্রত্যশা দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতৃবৃন্দ খোলা চিঠিটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেবেন। খোলা চিঠির আলোকে রাজনৈতিক দলসমূহ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুক। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন দেশের জনগণকে চুক্তির সপক্ষে অধিকতর সচেতন এবং সক্রিয় করতে সহায়ক প্রচেষ্টা চলমান রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা পুরো দেশেরই সমস্যা। স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হলে পার্বত্য সমস্যার নিষ্পত্তি হবে না— এটাই ধ্রুব সত্য। শরীরের কোনো অংশে সামান্য পরিমাণ ক্ষত থাকলেই পুরো শরীরে সেই ক্ষত অনুভূত হয়। তদ্রুপ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা জিইয়ে রেখে, চুক্তি বাস্তবায়ন না করলে সেটা সমগ্র দেশের জন্য সুখকর বলে বিবেচিত হবে না।

দেশের সামগ্রিক স্বার্থেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টগণ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন জুম পাহাড়ের মানুষের অধিকার এবং দেশের অপরাপর মানুষের অধিকার একই সুতোয় গাঁথা। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য তারা দেশব্যাপী কর্মসূচি পালন করছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন হোক। এই দাবি এখন শুধু পার্বত্য জনপদের বাসিন্দাদের নয়, এই চাওয়া সমগ্র দেশবাসীর। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন জুম পাহাড়ের লড়াইয়ের সঙ্গে পুরো দেশবাসীকে একাত্ম করার উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে। জুম পাহাড়ের আন্দোলনের ঢেউ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের মাধ্যমে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ুক। পাহাড়ের সীমানা ছাড়িয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াইয়ে সামিল থাকুক সমতল জনপদের আপামর জনতা।