পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যেভাবেই প্রচার করুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তিন বছর আগে শুরু হওয়া যুদ্ধে রাশিয়াই এখন সব দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এই অবস্থায় রুশ প্রশাসনকে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে অনেকটা চাপমুক্ত মনে হচ্ছে।
Published : 21 Mar 2025, 04:45 PM
সৌদি আরবে মার্কিন মধ্যস্থতাকারী দলকে ইউক্রেইন ৩০দিনের একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব নিয়ে মার্কিন প্রতিনিধি দল রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার জন্য মস্কোতে যান। প্রতিনিধিরা যখন মস্কোয় পৌঁছান, তখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ গত বছর ইউক্রেইনের দখল করা রাশিয়ার ‘কুরস্ক অঞ্চল’ পুনরুদ্ধার হওয়ায় ওই স্থান পরিদর্শন করছিলেন। এই অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দাবি করে পুতিন ঘোষণা করেন, “সেখানে আটকে পড়া ইউক্রেইন সেনাদের হয় আত্মসমর্পন, নয়তো মৃত্যুবরণ করতে হবে।”
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যেভাবেই প্রচার করুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তিন বছর আগে শুরু হওয়া যুদ্ধে রাশিয়াই এখন সব দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। সুতরাং এই অবস্থায় রুশ প্রশাসনকে যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে অনেকটা চাপমুক্ত মনে হচ্ছে। ইউক্রেইনের পক্ষ থেকে জেদ্দায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, “যুদ্ধবিরতি নিয়ে সিদ্ধান্তের ভার এখন পুরোপুরি রাশিয়ার ওপর” একই কথা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। সুতরাং যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির বিষয়টি এখন অনেকটা রাশিয়ার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। বল আসলে রাশিয়ার কোর্টে।
পুতিনের প্রশ্ন ও যুদ্ধবিরতির শর্ত-রূপ
যুদ্ধবিরতি কীভাবে কার্যকর হবে ওই বিষয়ে পুতিন কিছু প্রশ্ন রাখেন। তিনি উল্লেখ করেন, “ত্রিশ দিনের যুদ্ধবিরতির সময়টা কীভাবে ব্যবহার করা হবে? ইউক্রেইন নিজেদের অস্ত্র দিয়ে পুনরায় সংগঠিত করবে? নতুন সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে? নাকি এর কোনোটিই নয়? যুদ্ধবিরতির বিষয়গুলোকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? যুদ্ধ শেষ করার নির্দেশ কে দেবেন? এর মূল্য কী? দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক এলাকায় কেউ যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করবে কে? এই সব কে দেখবে, ঠিক করবে? এই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের গভীর পর্যালোচনা দরকার।”
এই প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে পুতিন মূলত একটি বিস্তৃত যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভাবনা তুলে ধরেন। গত সপ্তাহে মস্কোয় এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, “ধারণাটি সঠিক এবং এটিকে আমরা সমর্থন করি, তবে এমন প্রশ্ন রয়েছে যেগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা করা দরকার। যা একটি স্থায়ী শান্তির দিকে পরিচালিত করবে এবং এই সংকটের মূল কারণগুলো দূর করবে।”
৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে জ্বালানি অবকাঠামোয় হামলা বন্ধে পুতিন সম্মত থাকলেও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি নেই। ক্রেমলিন জানিয়েছে, ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার পর পুতিন রুশ বাহিনীকে ইউক্রেইনের জ্বালানি অবকাঠামোয় হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। ইউক্রেইন দুই স্তরের একটি প্রক্রিয়া চায়— প্রথমে একটি দ্রুত যুদ্ধবিরতি এবং এরপর একটি দীর্ঘমেয়াদী নিষ্পত্তির আলোচনা। রাশিয়া বিশ্বাস করে, এই দুটি প্রক্রিয়া আলাদা করা সম্ভব নয় এবং সব সমস্যা একটি একক চুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা উচিত। এক্ষেত্রে উভয় দেশের মধ্যে মতানৈক্য লক্ষণীয়, তবে আলোচনার মাধ্যমে তাও সমাধান হতে পারে।
শান্তিচুক্তির ভিত্তি কী হবে?
তিন বছরেরও বেশি সময়ের যুদ্ধে এই প্রথম রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র উভয়পক্ষ অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের শত্রুতার মনোভাব থেকে সন্ধির জায়গায় এসেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে মস্কোর মনোভাব যা জানা যায়, তা হচ্ছে;
(১) ইউক্রেইনকে ন্যাটোর সদস্যপদের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করতে হবে শুধু ইউক্রেইন এই অঙ্গীকার করলে হবে না, ন্যাটোকেও ওই অঙ্গীকার করতে হবে।
(২) রাশিয়ার দখলীকৃত ভূমির ওপর তাদের দাবি ছাড়তে হবে। ইতোমধ্যে তারা ইউক্রেইনের চারটি (লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিসা ও খেরসন) প্রদেশের দখল নিয়ে গণভোটের মাধ্যমে প্রদেশগুলোকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
(৩) বিশেষ বাহিনী গঠনের মাধ্যমে ইউক্রেইনে নাৎসিবাদের যে চর্চাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে তা বন্ধ করা।
(৪) ইউক্রেইনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী হবে সেটাও শান্তি প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং তিনি ইতিবাচকত অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেছেন।
বহুমুখী সংকটে দুর্বল জেলেনস্কি
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি, শান্তিচুক্তি ও বোঝাপড়া নিয়ে জেলেনস্কি বহুমুখী সংকটে আছেন। প্রথমত; মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুই ধরনের চাপ আছে, এক) রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া, দুই) তাদের খনিজ সম্পদের ওপর মার্কিন মালিকানা বিষয়ক চুক্তি সম্পাদন করা। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেইনকে হয়তো রাশিয়ার শর্তেই অনেক ছাড় দিয়ে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তিতে আসতে হবে। তৃতীয়ত, তার ইউরোপীয় মিত্রদেরও চাপ আছে, অন্যদিকে তিনি মার্কিন স্বার্থ ও চাওয়াকে অবজ্ঞা করতে পারছেন না। চতুর্থত, রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেইনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পঞ্চমত, ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর ইউক্রেইনের ভেতরে জেলেনস্কিবিরোধী তৎপরতা এখন প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে, মার্কিন প্রশাসন নির্বাচনের মাধ্যমে রেজিম চেঞ্জের কথা বলছে, এটাও জেলেনস্ক্রির জন্য বড় চাপ। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব গভমেন্ট এফিসিয়েন্সির দায়িত্বপ্রাপ্ত ইলন মাস্ক তার এক এক্স পোস্টে বলেছেন, জেলেনস্কি নিজেকে ইউক্রেইনের প্রতিনিধি দাবি করতে পারেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করছেন এবং নির্বাচনের ব্যবস্থা না করছেন। এই সব বিষয় রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়ায় মার্কিন চাপ ও রাশিয়ার চাওয়ার মূল্যকেও গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।
ইউক্রেইন শান্তি প্রক্রিয়ার লাভ-ক্ষতি ও দূরভিসন্ধি
ট্রাম্প নগদে বিশ্বাসী, তিনি কোনো অনিশ্চয়তায় যেতে চান না। তিনি বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন, এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে রাশিয়া হয়তো একদিন ইউক্রেইন দখল করে নেবে। সেক্ষেত্রে হয়তো ইউক্রেইন থেকে তাদের পাওয়ার কিছুই থাকবে না। কেননা তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে ইউক্রেইনের কোনো অর্জন নেই। রাশিয়া নানা দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তারা ইউক্রেইনের ২০ ভাগ ভূমি দখলে নিয়েছে; তার মধ্যে আছে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ ও শিল্পও।
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রাশিয়া বিশেষজ্ঞ নাইজেল গোল্ড-ডেভিস মনে করেন, “পুতিন, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে লাভজনক ব্যবসায়িক চুক্তির সম্ভাবনাও দেখিয়েছেন, এটি ওয়াশিংটনকে ন্যাটো মিত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা।” বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেইন সংকটকে ঘিরে পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও ইউরোপকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে কাজ করছেন এবং তিনি ওই লক্ষ্যে অনেক দূর এগিয়েছেন।
এই যুদ্ধ অসম ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু পুরো বিশ্ব তো ইউক্রেইনকে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে। রাশিয়াকে একঘরে করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অবরোধ তৈরি করা হয়েছে, তাও তো মানতে হবে। পুতিনের শর্ত মেনে যদি যুদ্ধবিরতি ও শান্তি চুক্তি সম্পাদন হয়, তাহলে তা নিশ্চয়ই ন্যাটো, পশ্চিমা শক্তি তথা ইউরোপের জন্য বড় ধরনের আঘাত। মার্কিনীদের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তাদের এই অপমান হজম করতে হচ্ছে। একজন রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিক হিসেবে ট্রাম্পের অনেক সমালোচনা আছে। কিন্তু ইউক্রেইন যুদ্ধ বন্ধে তার উদ্যোগকে প্রশংসা করতে হয়। আবার অন্যদিকে ওই ট্রাম্পই আবার ইসরায়েলকে উসকানি দিচ্ছেন গাজাকে ধূলিসাৎ করতে। ইয়েমেনের হুতিদের ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিচ্ছেন। তাহলে তার এই ইউক্রেইন যুদ্ধ বন্ধের কৌশল কি অন্য কোনো অঞ্চলে যুদ্ধ জোরাল করার সংকেত? ওই ভাবনাও বিশ্ব সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রবল।
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রুশ ও ইউক্রেইন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বলেছেন। উভয় নেতার সঙ্গে কথা বলার পর তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শান্তিচুক্তির বিষয়ে তাদের অবস্থান ও বক্তব্য ইতিবাচক। এই বিষয়ে ডনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেছেন, সম্ভবত ‘কয়েক সপ্তাহের মধ্যে’ রাশিয়া-ইউক্রেইনের পূর্ণ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।