দেশভাগের ক্ষত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেও, যে দেশের মাটিকে ঋত্বিক ঘটক মায়ের সঙ্গে তুলনা করতেন, সেই বাংলার মানুষই তার স্মৃতিচিহ্নটুকু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল। অথচ তার গোটা জীবনের যুক্তি তক্কো আর গপ্পোর ভেতরে বাংলাদেশ উপস্থিত হয়েছে এক প্রত্নমায়ের অবয়ব নিয়ে।
Published : 19 Aug 2024, 10:56 PM
একটি সফল ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর স্বৈরশাসক যখন উৎখাত হলো এবং তৎপরবর্তী টালমাটাল পরিস্থিতি সামাল দিতে যখন হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, ঠিক তখনই কাজে নেমে যায় কিছু সুযোগসন্ধানী, অত্যন্ত নিচুশ্রেণির লোক। গেল ১৪ অগাস্ট তারাই রাজশাহীর ঘোড়ামারা মহল্লার মিয়াপাড়ায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়িটি। কাণ্ডটির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। ১৯৮৯ সালে বাড়িসহ ৩৪ শতাংশ জমিটি তাদের ইজারা দিয়েছিল এরশাদ সরকার। এক স্বৈরাচারের ইজারা দেওয়া ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি, আরেক স্বৈরাচারের বিদায়ের অব্যবহিত পরই ভেঙে ফেলা হলো। এবং এটি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।
কাজটি যারা করেছেন তাদের সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের পর লুটপাট চালানো, চুরি-ছিনতাই করা, ডাকাতিতে যুক্ত থাকা সুযোগ সন্ধানী লোকেদের কোনো পার্থক্য নেই। বরং এরা আরো ভয়ঙ্কর! জ্ঞানপাপী। ঋত্বিক ঘটক কে সেটা তাদের আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তারপরও তারা ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিয়েছে জমি, নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে স্মৃতি স্মারক। এই গোষ্ঠী না বোঝে ইতিহাস, না বোঝে ঐতিহ্য, এরা ভূমিখেকো, বর্বর। মিয়াপাড়ার বাড়িটির গুরুত্ব শুধু একবার ভেবে দেখুন। এই বাড়িতে থেকে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন ঋত্বিক ঘটক। নাট্যচর্চা করেছেন। এই বাড়িতে থেকেই ‘অভিধারা’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ঋত্বিক ছাড়াও এই বাড়িতে থেকেছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী, তিনি ঋত্বিক ঘটকের ভাইয়ের মেয়ে।
কাজেই এই বাড়ির কি মূল্য সেটা বিবেকসম্পন্ন মানুষকে আর বুঝিয়ে দিতে হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জর্মন ফ্যাসিস্টরাও শিল্পকর্ম ধ্বংস করেনি। তারা ‘কুনস্টশুটজ’ (শিল্পের সুরক্ষা) বলে একটি নীতি গ্রহণ করেছিল, যার মাধ্যমে সশস্ত্র সংঘাত চলাকালে শত্রুর শিল্পকর্মকে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তো হিটলারের দেশও শিল্পকর্মকে রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করতে পারে, তাও শত্রু দেশের। আর আমরা? এক স্বৈরাচার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে, আরেক স্বৈরাচারী কায়দায় আমরা দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ভাস্কর শামীম শিকদারের করা ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলা হলো। শিশু একাডেমির ভেতর শিল্পী সুলতানুল ইসলামের ভাস্কর্য ‘দুরন্ত’কে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। দিনাজপুরে শিল্পী প্রদ্যোত কুমার ও মানবেন্দ্র ঘোষের ‘সিধু কানুর ভাস্কর্য’ ভেঙে ফেলা হলো। কুমিল্লার প্রাচীন পাঠাগার বীরচন্দ্র গ্রন্থাগারে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হলো অনেক দুষ্প্রাপ্য বই। আরো ভাঙা হলো ময়মনসিংহের শশীলজ জাদুঘরের সামনে থাকা অমূল্য শিল্পকর্ম ভেনাসের মূর্তি।
ধানমন্ডি ৩২-এ থাকা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে নির্মিত জাদুঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হলো। সংসদ ভবনের ভেতরে গিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল নষ্ট ও লুট করা হলো। দেখা যাচ্ছে আমরা চরম মাত্রায় ‘আত্মঘাতী’। একটি একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলের দেড় দশকে অনেক গুম-খুন-লুট-দুর্নীতি হয়েছে। সেটার ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক। তো সেই ক্ষোভ কেন শিল্পকর্ম ও জাদুঘরে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক দলিলের উপর দিয়ে যাবে? এই প্রশ্নে অনেকে আবার ক্ষিপ্ত হতে পারেন। তো পনেরো বছর ধরে অন্যায়-জুলুম হয়েছে বলে, তাকে বিতাড়নের উদযাপনে ফের যদি একই কাজ হয়,সেটা নিয়ে কি কথা বলা যাবে না? ১৫ অগাস্ট যা হলো সেটা কি ঠিক হলো? লোকজনের কাপড় টেনে ছিড়ে উলঙ্গ করে ফেলা, মোবাইল ফোন ঘেটে ব্যক্তিগত পরিসরকে লঙ্ঘন করা এবং বত্রিশ নম্বরে সারারাত হিন্দি গানের সঙ্গে নাচা। পঁচাত্তরের হত্যা যেমন আমাদের শোকের, চব্বিশে শতশত তরুণের প্রাণহানিও সমান শোকের। দুই শোককেই আমাদের মর্যাদা দিতে হবে। নাকি অভ্যুত্থান পরবর্তী বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে আরো পনের বছর অপেক্ষা করতে হবে? অটোক্রেসি থেকে ডেমোক্রেসিতে যাওয়ার পথে আমরা যদি মবোক্রেসির খপ্পরে পড়ি, সেটাও আমাদের চিহ্নিত করে সমাধান খুঁজে সামনে এগুতে হবে।
আমার ধারণা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রজনতা নয়, শিল্পকর্ম ধ্বংসের কাণ্ডটি জনতার সঙ্গে মিশে ঘটিয়েছে একটি বিশেষ গোষ্ঠী। রাজনৈতিক ডামাডোলের ভেতর একদল লোক থাকে, যারা সুযোগ সন্ধানী ও মৌলবাদী। ওই একই মানসিকতার লোকজনই ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। অপকর্মটি করার পর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছে ওই ক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার উপর। হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি ঘটনার দিন এসে নাকি শোনেন শ্রমিকদের টাকা দিয়ে বাড়িটি ভাঙতে বলেছেন ছাত্ররা! দেশের মানুষ অত বোকা নয়। আর ছাত্রজনতা, যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমার বিশ্বাস তারা শিল্পকর্ম, জাদুঘর, পাঠাগার ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানের মর্ম বোঝেন।
ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি আসলে ২০১৯ সালেই ভাঙা হয়ে যেত। তারা শুরুও করেছিল। বাড়িটির একাংশ ভেঙে সাইকেল রাখার ছাউনি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তখন শিল্পী ও সংস্কৃতমনারাদের বাধার মুখে ভাঙার কাজ বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ। সচেতন নাগরিদের প্রতিবাদের তোড়েই ২০২০ সালে বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় রাজশাহী প্রশাসন। সেসময় ভূমি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে তারা আবেদন করেছিল যেন ইজারা থেকে অবমুক্ত করে বাড়িটি ঋত্বিক ঘটকের নামে দেয়া হয়। সেই চিঠি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।
কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা না করে সুযোগ বুঝে, অস্থির এক সময়ে হোমিওপ্যাথিক কর্তৃপক্ষ পুরো বাড়িটিই গুঁড়িয়ে ফেলল। এবং কেন এটা হলো জিজ্ঞেস করলে, তারা দোষ চাপাল বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের উপর। সেই ছাত্রদের দেখা মেলেনি কোথাও। ঘটনাস্থলে দেখা গেছে ঠিকাদার ও শ্রমিকদের। ঠিকাদার জানিয়েছেন, ভাঙার আদেশ তাদের কর্তৃপক্ষই দিয়েছে। এসব কথা থেকে বুঝতে সমস্যা হয় না, কাজটি কারা করেছেন। গোটা দেশ যখন সরকার পতন ও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন নিয়ে ব্যস্ত, দেশ সংস্কার নিয়ে চিন্তিত, ঠিক তখনই তারা চোরের মতো এত বড় অপরাধটি সংগঠন করে।
ঋত্বিক ঘটকের জন্ম ১৯২৫ সালে এই মিয়াপাড়াতে। আগামী বছরই হতে যাচ্ছে তার জন্মশতবর্ষ। আমরা এই মহাত্মার জন্মশতবর্ষের আগে উদযাপন প্রস্তুতি তো দূরে থাক, বাংলাদেশে তার স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃকবাড়িটি ভেঙে ফেললাম। অথচ আমরা কত অপ্রয়োজনীয় খাতে শতশত কোটি টাকা খরচ হতে দেখেছি। হরিলুট হতে দেখেছি। কিন্তু যে ঋত্বিক ঘটক গোটা উপমহাদেশের গৌরব, যার চলচ্চিত্র ক্রাইটেরিয়নের মতো বিখ্যাত মার্কিন প্রতিষ্ঠান ধ্রুপদী চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত করে পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করছে,বিশ্ব চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, সেই মাপের পরিচালকের বাড়িটি আমরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলাম। শ্রদ্ধা নিবেদন তো বহুদূরের বিষয়।
যে বাংলার জলকাদার জন্য ঋত্বিক ঘটক সারাজীবন ভালোবাসার টান অনুভব করেছেন, দেশভাগের ক্ষত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেও, যে দেশের মাটিকে তিনি মায়ের সঙ্গে তুলনা করতেন, সেই বাংলার মানুষই তার স্মৃতিচিহ্নটুকু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল। অথচ তার গোটা জীবনের যুক্তি তক্কো আর গপ্পোর ভেতরে বাংলাদেশ উপস্থিত হয়েছে এক প্রত্নমায়ের অবয়ব নিয়ে। এই মায়ের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি বানিয়ে ফেলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’,অথবা দেশভাগের যন্ত্রণাকে মিশিয়ে দেন মাতৃবিয়োগের শোকের সঙ্গে, এবং তার শৈল্পিক সংশ্লেষ ঘটান ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’র মতো চলচ্চিত্রে।
ইউরোপে যদি এমন আন্তর্জাতিক মানের কোনো নির্মাতার পৈতৃক বাড়ি অবশিষ্ট থাকত, আর যদি সামনেই জন্মশতবর্ষ দ্বারে কড়া নাড়ত, তাহলে সেই বাড়িটির জন্য তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করার পাশাপাশি বছরব্যাপী এমনসব কর্মসূচি হাতে নিতেন, যাতে সারা দুনিয়া থেকে বড় বড় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্রপ্রেমীরা বাড়িটি দেখতে আসতেন। বাড়িটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তর করে সেখানে শিল্পীর সৃষ্টিকর্মের মূলভাব নিয়ে এমন সব আয়োজন করতেন, যা দেখে আগত দর্শনার্থীরা সেই শিল্পীর সৃজনশীলতা ও দর্শনকে অনুধাবন করতে পারতেন।
ফ্রান্সে ক্লদ মনের বাড়ি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ছবির মতো করে সংরক্ষণ করা সেই বাড়িতে ঢুকতে হলে টিকিট কাটতে হয়। এই অর্থ বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণেই ব্যয় হয়। আমরাও পারতাম রাজশাহীতে ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটিকে একটি দর্শনীয় ও অনুপ্রেরণা পাওয়ার স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু দুর্ভাগা জাতি আমরা, সেই বাড়ির আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রতিটি ইট খুলে ফেলা হয়েছে। এখন ওখানে হোমিওপ্যাথির দোকান হবে। বর্বরতা আর কাকে বলে!