বাড়িটি যেখানে ছিল, সেখানে কেবল ভাঙা ইট আর কংক্রিটের স্তূপ পড়ে আছে; ঘরবাড়ির চিহ্নমাত্র নেই।
Published : 14 Aug 2024, 07:26 PM
কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের রাজশাহী মিয়াপাড়ায় পৈতৃক বাড়ি ভাঙার চেষ্টার অভিযোগ ছিল বহুদিন ধরেই, চলচ্চিত্রকর্মীদের জোড়ালো অবস্থানের কারণেই এতদিন সেটি টিকে ছিল। তবে সরকার পতনের পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে বাড়িটিকে আর রক্ষা করা গেল না।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুর ও দখলের মধ্যে ঋত্বিক ঘটকের সেই বাড়িটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মঙ্গলবার রাতে জানতে পারেন স্থানীয় ফিল্ম সোসাইটির সদস্যরা।
বাড়িটি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এখন কেবল ভাঙা ইট আর কংক্রিটের স্তূপ পড়ে আছে। বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই।
ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সদস্যদের অভিযোগ, ক্ষমতার পালাবদলে স্থানীয় হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বাড়িটি ভেঙে ফেলেছে। এর আগেও বাড়িটি ভেঙে ফেলার চেষ্টার অভিযোগ ছিল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
যদিও ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি ভাঙার অভিযোগ অস্বীকার করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাদের ভাষ্য, সরকার পতনের পর সহিংসতার মধ্যে ‘কিছু লোক’ বাড়িটি ভেঙে ফেলেছে।
এ ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করেছে রাজশাহীর জেলা প্রশাসন। আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। এরপর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
রাজশাহীর ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হোসেন মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কলেজ কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরেই বাড়িটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল। তবে নানা সময় চলচ্চিত্রকর্মীদের আন্দোলনের কারণে সেটি করতে পারেনি।
“এবার দেশজুড়ে চলা সহিংসতার সুযোগ নিয়ে তারা বাড়িটি ভেঙে ফেলেছে। আমরা জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি। আমরা দোষীদের শাস্তি চাই।”
ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন বলেন, “রাজশাহীতে সক্রিয় চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের কাছ থেকে জানলাম, রাজশাহীতে থাকা ঋত্বিক কুমার ঘটকদের আদি বসতবাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে৷ এই বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য রাজশাহীতে সক্রিয় চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ দীর্ঘদিন বহু আন্দোলন করেছে৷ কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।”
“এই বাড়িটির মধ্যেই হোমিওপ্যাথি কলেজটি রয়েছে জানিয়ে মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কলেজ কর্তৃপক্ষ অনেকদিন ধরেই বাড়িটি ভেঙে ফেলার চেষ্টায় ছিল৷ এখন দেশের একটি বিশেষ অবস্থায় বাড়িটি ধ্বংস করে ফেলল। মুছে দিল বাংলার একটি অসাধারণ পরিবারের শেষ স্মৃতি।”
এই বাড়িটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে ঋত্বিক কুমার ঘটককে এবার চূড়ান্ত অর্থেই তার জন্মভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করা হল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমরা আমাদের ধিক্কার জানাই।”
স্থানীয় হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে এ কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, “সরকার পতনের পর কিছুলোক বাড়িটি ভাঙে, এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। পরে বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ আমরা পরিষ্কার করি। আমাদের দিক থেকে জেলা প্রশাসনকে ব্যাখ্যা দিয়েছি।”
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হোমিওপ্যাথি কলেজ এবং ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি এসেছিল। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) তদন্ত করে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছি।
“কমিটির তদন্ত রিপোর্ট আসার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাড়িটির যা অবশিষ্ট আছে তা সংরক্ষণ করা হবে।”
‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর মত অসামান্য সৃষ্টিকর্মের সুবাদে বাংলা চলচ্চিত্রে অমর হয়ে আছেন ঋত্বিক ঘটক।
রাজশাহী কলেজের ছাত্র ঋত্বিক ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা চলে যান পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। দেশভাগের সেই বেদনা কখনো ভুলতে পারেননি তিনি। তার সৃষ্টিকর্মে ফিরে ফিরে এসেছে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বাস্তুহারা মানুষের অসহনীয় কষ্টের দৃশ্য।
বাংলা চলচ্চিত্রের এক অবিস্মরণীয় এ ব্যক্তিত্বের পৈতৃক ভিটা এভাবে নিশ্চিহ্ন করাকে ‘জন্মভূমি থেকে একেবারে বাস্তুচ্যুত’ করার সঙ্গে তুলনা করছেন চলচ্চিত্রকর্মীরা।
ভেঙে ফেলার চেষ্টা ছিল আগেও
ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির উত্তরে রয়েছে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের আধুনিক ভবন। বাড়িটি ভেঙে ফেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ জায়গাটি অন্য কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বলে অভিযোগ ছিল স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের।
বাড়িটি ভেঙে ফেলার খবরের পর সেখানে যান ফিল্ম সোসাইটির সদস্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। পরে তারা জেলা প্রশাসকের কাছেও যান।
সাংস্কৃতিককর্মীদের অভিযোগ, আগেও বাড়িটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। বারবার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন সাংস্কৃতিককর্মীরা। ২০২০ সালে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ হয়। মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এবং বরেন্দ্র ফিল্ম সোসাইটি।
ওই ঘটনায় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ ১১ জন নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে বিবৃতি দেন। এরপর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের মতামত চায়। পরে করণীয় নির্ধারণে জেলা প্রশাসন একটি কমিটিও করে। সেই কমিটির সদস্যরা বাড়িটি পরিদর্শন করে ঋত্বিক ঘটকের পরিবারের ব্যবহৃত বাড়ির অক্ষত অংশ এবং একটি কুয়া চিহ্নিত করেন।
জেলা প্রশাসন পুরনো বাড়িটি আগের অবস্থায় সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে এর মধ্যে সেই বাড়িটি গুড়িয়ে দেওয়া হল।
বাড়ি ভাঙার খবরে বুধবার দুপুরে রাজশাহীর সাংস্কৃতিককর্মীরা বাড়িটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত দেওয়া কাগজপত্র নিয়ে সেখানে যান। এসময় কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের হট্টগোল শুরু হয়। পরে অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বেরিয়ে সাংস্কৃতিককর্মীরা জেলা প্রশাসকের কাছে যান।
অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, “গত ৬ অগাস্ট ‘কিছু ছাত্র’ এসে প্রথমে বাড়িটি ভাঙতে শুরু করে। তারা নিজেদের শ্রমিক পরিচয় দিয়ে জানান, ‘কিছু ছেলে’ তাদের টাকা দিয়েছেন সেটা ভাঙার জন্য।”
জায়গাটি নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা থাকলেও বাড়ি ভাঙার অভিযোগ অস্বীকার করেন অধ্যক্ষ।
আন্নাবা কবির নামে স্থানীয় এক সাংস্কৃতিককর্মী বলেন, “অধ্যক্ষ এখন ছাত্রদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। ছাত্ররা ভাঙলে কলেজের নতুন ভবনেও ভাঙচুর চালাতেন। সেখানকার একটি জানালার কাঁচও ভাঙেনি।
“অথচ ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির পুরোটাই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কী করে সম্ভব। ছাত্ররা ভাঙলে সবকিছুতেই ভাঙচুর করতেন।’
পুরনো খবর-