এর অর্থ এই নয় যে, ইংরেজি শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই বা হুট করে শিক্ষা থেকে ইংরেজি তুলে দিতে হবে। প্রয়োজন আছে তো অবশ্যই। শুধু ইংরেজি কেন, যে কোনো বিদেশি ভাষা শিক্ষারই মূল্য আছে। একাধিক ভাষা জানা নিঃসন্দেহে একটি ভালো গুণ।
Published : 23 Jan 2025, 03:30 PM
বৈষম্যবিরোধিতা ও সংস্কার দুই-ই অত্যন্ত গভীর বিষয়, যা কেবল চিন্তাশীল মানুষের হাতেই মঙ্গলজনক। চিকিৎসকের হাতের ছুরি যেমন ভুল মানুষের হাতে বিপজ্জনক। এতসবের মাঝে শিক্ষাক্ষেত্রেও সংস্কারের কথা বলে কেবল পুরনো শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরে যাওয়াতেই কাজ শেষ। আর হয়েছে কিছু বিতর্ক সৃষ্টিমূলক পরিবর্তন।
বিপ্লব শব্দটার সঙ্গে যথেচ্ছ পানি মেশাতে মেশাতে এখন একে একেবারেই পানসে করে ফেলা হয়েছে। আসলে বিপ্লব সফল করতে চাইলে বিপ্লব যেসব বিরাট পরিবর্তন দাবি করে আর তা থেকে বিপ্লবীদের শ্রেণিগোষ্ঠীর কত মানুষ সুবিধা হারাবে তা জানা থাকতে ও মানতে হয়। যারা সংস্কার নিয়ে সোচ্চার তাদের কাউকেই এমন কোনো মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলতে শোনা যাচ্ছে না যা সুবিধাভোগীদের জন্য বিপজ্জনক। বরং সুবিধাভোগী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর যৌক্তিক-অযৌক্তিক বিভিন্ন দাবি-দাওয়াকে মেনে নেয়া হচ্ছে বাছবিচার ছাড়াই এবং সুবিধাবঞ্চিত ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মতামতের তোয়াক্কা না করেই, অনেকক্ষেত্রে নাজেহাল করে। শিক্ষাক্ষেত্রে এমন একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রসঙ্গ আজ উল্লেখ করব যাকে সংস্কার নিয়ে বিপ্লবীপনার লিটমাস টেস্ট বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশে শিক্ষায় ইংরেজি বাধ্যতামূলক। কিন্তু কেন? ইংরেজি কি বাংলাদেশের কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা? বাংলা ছাড়াও বাংলাদেশে মানুষ আরও কিছু ভাষায় কথা বলে, সেগুলোর কোনোটা নয়, অথচ ইংরেজি! আবার বিদেশি আরও কয়েক ডজন উন্নত ভাষার কোনোটা নয়, শুধু ইংরেজি। চিরদাস যেমন তার শৃঙ্খলকে অলঙ্কার হিসেবে পরে থাকতে ভালবাসে, ইংরেজিও তেমনি আমাদের ঔপনিবেশিক অলঙ্কার, অহংকার ও গৌরব! লেখক-চিন্তক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’ গ্রন্থে শিক্ষা নিয়ে লিখেছেন, “শিক্ষার উদ্দেশ্যই ছিল বিজাতীয় মানুষ তৈরি করা; চীনকে ইংরেজ আফিম খাইয়েছে, বাঙালীকে খাইয়েছে শিক্ষা ...।” কী সেই শিক্ষা যা চীনকে খাওয়ানো আফিমের সমতুল্য বা তার চেয়েও বিষাক্ত?
ওই বইটিতেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, “... মেকেওলে, ভরসা করেছেন শিক্ষার ওপর। শিক্ষার সাহায্যে উৎপাটিত মানুষ তৈরী করতে পারলে আর সমস্যা থাকবে না, তাদের সাহায্যে সাম্রাজ্যকে চিরস্থায়ী করা যাবে। সাম্রাজ্য আজ চলে গেছে কিন্তু তার সাংস্কৃতিক আধিপত্য নিশ্চিহ্ন হয়নি। ... বৃটিশের আইন, সামরিক-অসামরিক আমলাতন্ত্র, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ইংরেজী ভাষা সবই রয়ে গেছে।” তার মতে, মেকেওলে চেয়েছিলেন ইংরেজের ‘দালাল’ তৈরি করতে, ‘মানুষ চান নি।’ সন্দেহ নেই যে, ব্যতিক্রম হিসেবে অনেক মনীষী এবং বিদ্রোহীও তৈরি হয়েছেন আবার এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছিল কিছুটা ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত এমন একটি শ্রেণি তৈরি করা যারা “খেয়াল করার সুযোগ পায়নি যে, যে-সুধা নিরবধি পান করার অধিকার তারা পেয়েছে তাতে বিষও ছিল, আত্মসমপর্ণের বিষ।”
আত্মসমর্পণে অনেকেরই অনেক সুখ, ওই সুখে আমরাও মজে আছি। কিন্তু সকলেরই সুখ হয় না, তাই এ দেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, ছাত্র-জনতা রাস্তায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে মাতৃভাষার সম্মান ও অধিকার রক্ষার জন্য। ওই চেতনার জোয়ার একসময় বাঙালিকে পৌঁছে দিয়েছে মুক্তির দ্বারপ্রান্তে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়ে যাই একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়। কিন্তু বিরাটসংখ্যক খেটেখাওয়া সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ পেল কি? আর স্বাধীন হলো কি তাদের মুখের ভাষা— বাংলা? বরং ইংরেজ নিজে বাঙালির কাছে যেটুকু ইংরেজি জ্ঞান দাবি করত, স্বাধীন বাংলাদেশে তাও স্বৈরাচারী রূপ নিল।
ইংরেজি ছাড়া এখন জাতীয় পর্যায়ের প্রায় কিছুই চলে না। ইংরেজি ছাড়া যাওবা চলে বাংরেজি ছাড়া মোটেও কিছু চলে না। যে ইংরেজি শিক্ষা বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে চলে তাকে বাংরেজি বলাই শ্রেয়। অথচ এই বাংরেজিতে পাশ না করলে পুরাই ফেল; এমন অকৃতকার্য ‘গোবরমাথা’র শিক্ষার্থীকে কোনো শ্রেণির চৌকাঠই পার হতে দেয়া হবে না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও একটি অভিজাত মনোভাবাপন্ন শ্রেণি তৈরির উদ্দেশ্যে যেমন আছে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, তেমনি কয়েক বছর হলো বাংলা মাধ্যমের পাশাপাশি চলছে ইংলিশ ভার্সন বা বাংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা। বিশেষায়িত ও বিশেষ দক্ষতামূলক বিষয়ে শিক্ষা ইংরেজি ছাড়া অচল, উচ্চশিক্ষাটাও এখন ইংরেজি ছাড়া না চলার মতো করেই চলে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাংলাদেশে ইংরেজি কার্যত দ্বিতীয় ভাষা কিন্তু সুবিধাপ্রাপ্তিতে আবার শীর্ষে। এ দেশে একটি জনগোষ্ঠীও আছে যাদের কাছে ইংরেজি পিতৃভাষা আর বাংলা বিমাতার ভাষাতুল্য। সভাসমাবেশে আবার তাদেরই শীর্ষ আসন আর তাই ভাষার মাসে মাতৃভাষার জন্য তাদের কান্নায় বক্তৃতামঞ্চ সিক্ত হয়ে ওঠে। এই ইংরেজিভাষী গোষ্ঠীই রাষ্ট্রের বেশিরভাগ সুবিধা লুটে নিয়ে থাকে। সুতরাং দেশ এখন আর ইংরেজশাসিত না হলেও ইংরেজ আমলের চেয়েও বেশি ইংরেজিশাসিত। কার্যত ভিন্নভাষা শাসিত একটি রাষ্ট্র স্বদেশের স্বভাষী জনগণের কমই উপকারে আসে। দেশে বিভাজন, বৈষম্য, মানুষে মানুষে দূরত্ব তাই ভয়ঙ্কররূপে বেড়েছে ও প্রতিদিনই বাড়ছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে এই “শিক্ষা খুব বেশী বেশী পরিমাণে যা তৈরী করেছে তা হলো শ্রেণী-বিভাজন।” চব্বিশের ভাষায় বলতে হয়— বৈষম্য। এই হচ্ছে এ বিষবৃক্ষের ফল।
আমাদের শিক্ষায় ও জাতীয় জীবনে ইংরেজির দৌরাত্ম্যের এই কুফল নিয়ে বাংলার অনেক মনীষীই বলে আসছেন। অক্ষয়কুমার দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ মুজতবা আলী, কাজী মোতাহার হোসেন থেকে বর্তমান কালের সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আনু মুহাম্মদ, শহিদুল ইসলামসহ কে না বলেছেন ও লিখেছেন এ নিয়ে। তবু দেখা যায়, শিক্ষানীতি প্রণেতাগণ মনীষীদের বিনাপয়সার কথায় কান দেন না, তাদের পূর্ণ আস্থা বিদেশি পরামর্শকদের ডলারে কেনা উপদেশে।
এবার প্রশ্ন করি, আমাদের ছেলেমেয়েকে স্কুল-কলেজে এই যে ১২ থেকে ১৬/১৭ বছর একটানা ইংরেজির ঘানি টানতে হয়, এর সুফল কী? প্রায় শূন্য বা তার চেয়েও খারাপ। ইংরেজির এই ঘানি টানার সংকটটি যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি জাতীয় ও ঐতিহাসিক। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার উল্লিখিত বইতে আরেক স্থানে লিখেছেন, “বাঙালী মধ্যবিত্তের জন্য ভাষার প্রশ্নটি খুবই জরুরী। ইংরেজী শিখে সে তার মধ্যবিত্তের অবস্থানের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। ভাষা একটা বোঝাও ছিল বৈকি। বিস্তর সময় গেছে ঐ ভাষা শিখতে, যার ফলে অন্য কিছু শেখা কঠিন হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাধা পেয়েছে।”
স্কুল-কলেজে দশ-বারো বছর ধরে যা শেখানো হচ্ছে তা কতখানি ইংরেজি আর কতখানি বাংরেজি অর্থাৎ কতটা মানসম্মত তা বাঙালি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে শোনা যাক। তিনি ও এস্থার দুফলো তাদের বিশ্বখ্যাত ‘পুওর ইকোনোমিকস’ বইতে লিখেছেন, “সন্তানকে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বাবা-মায়ের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু অ-ইংরেজিভাষী বাবা-মায়ের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে, শিক্ষক ইংরেজি শেখাতে পারছেন কি না।” সত্য হচ্ছে, আসলে বেশিরভাগই তারা পারেন না।
এর অর্থ এই নয় যে, ইংরেজি শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই বা হুট করে শিক্ষা থেকে ইংরেজি তুলে দিতে হবে। প্রয়োজন আছে তো অবশ্যই। শুধু ইংরেজি কেন, যে কোনো বিদেশি ভাষা শিক্ষারই মূল্য আছে। একাধিক ভাষা জানা নিঃসন্দেহে একটি ভালো গুণ। আর আজকাল একটি দেশে যত বেশি মানুষ বিভিন্ন ভাষা জানবে ওই দেশের তত মঙ্গল, কারণ তাদের তত বেশি আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির সম্ভাবনা। কিন্তু ওই ভাষা শিক্ষাটা হতে হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছানির্ভর, বাধ্যতামূলক নয়। প্রয়োজন আন্তরিক কার্যকর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
বাংলা একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে বিশেষায়িত ও উচ্চশিক্ষার সমস্ত ইংরেজি বইগুলো বাংলায় অনুবাদের। শিক্ষকদের পদোন্নতি থেকে পিএইচডি লাভ পর্যন্ত জরুরি ইংরেজি বই বাংলায় অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে। দেশে ইতিমধ্যে অনেক অনুবাদশিল্পী তৈরি হয়েছেন। তাদেরকে উচ্চসম্মানি দিয়ে উচ্চশিক্ষার বইগুলোকে বাংলা করে নিতে হবে। কাজটা একদিনের, একমাসের বা একবছরের না, কমপক্ষে একদশকের। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাংলাভাষাভিত্তিক করার জন্য এরকম একটি দশকব্যাপী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
এতে ইংরেজি শিক্ষা দেশ থেকে একচুলও কমবে না, বরং বাড়বে— আর তা বাংরেজি না হয়ে ইংরেজিই হবে। ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক, সরকারি ও বেসরকারি নানাভাবে চলবে ইংরেজি শিক্ষা— সরকার সহযোগিতা করলে এ থেকে দশ-বারো বছরের ঘানি না টেনেও যাদের প্রয়োজন তারা অনেক কম সময়ে অনেক ভালো ইংরেজি শিখবে। স্কুল-কলেজে ইংরেজিতে কেবল ১০০ নাম্বার নয়, ৫০০ বা ১০০০ নাম্বারের পরীক্ষা হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু তা অবশ্যই ঐচ্ছিক হতে হবে, কোনোভাবেই এখনকার মতো বাধ্যতামূলক না। রাষ্ট্রভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানার ও না শেখার সম্পূর্ণ অধিকার স্বাধীন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের আছে, ওই ভাষিক অধিকার লংঘন করতে পারবে না রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থাও। অতএব শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মৌলিক সংস্কার চাইলে আজই ঔপনিবেশিক অলঙ্কারটি ছুঁড়ে ফেলে ইংরেজি পড়াকে বাধ্যতামূলক থেকে ঐচ্ছিক করুন। সংস্কারকরা কাজটি করবেন কি?