ডেমোক্র্যাটদের একাংশের বক্তব্য, কালবিলম্ব না করে জো বাইডেনের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হোক কমলা হ্যারিসকে।
Published : 13 Jul 2024, 09:11 PM
২০২৪ সালকে দুনিয়াজুড়ে নির্বাচনের বছর বলা হচ্ছে। শুরু হয়েছে বাংলাদেশকে দিয়ে এবং শেষ হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত নেটো সম্মেলনে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ‘পুতিন’ ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে ‘ট্রাম্প’ সম্বোধন করে খবরের শিরোনাম হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টে জো বাইডেনে। শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠছে, বাইডেনের বেফাঁস মন্তব্য ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের ধাক্কা সামলানোর বিষয় নিয়ে। বাইডেন কি পারবেন পুনরায় নির্বাচিত হতে? নাকি বার্ধক্যের খাতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন?
গত ২৭ জুন প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে ডেমোক্র্যাট নেতা ও বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে রিপাবলিকান নেতা ডনাল্ড ট্রাম্প মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নিয়েছিলেন। এতে ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন জো বাইডেন। ওইদিন কার্যত কাহিল অবস্থায় ছিলেন তিনি। ইতোমধ্যেই বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রবীণতম রাষ্ট্রপতি হিসাবে পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছেন। ডনাল্ড ট্রাম্পের সামনে বিতর্কে বাইডেনের নড়বড়ে অবস্থান হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে বয়সের ভারেই কী তবে তিনি আর পেরে উঠছেন না? এই অবস্থায় দ্বিতীয় দফার জন্য নির্বাচনে নামাটা কতদূর যুক্তিযুক্ত হবে তা নিয়ে তার নিজ দলের অন্দরেই সন্দেহের ডালপালা মেলছে। বাইডেন ও ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কটি সম্প্রচার করেছে প্রভাবশালী গণমাধ্যম সিএনএন। প্রায় পাঁচ কোটি দর্শক সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় বির্তকটি উপভোগ করেছেন।
অন্যদিকে এই বির্তকের রেশ কাটতে না কাটতে ফিলাডেলফিয়ার রেডিও স্টেশনে এক সাক্ষাৎকার চলাকালে মুখ ফসকে বাইডেন নিজেকে ‘কৃষ্ণাঙ্গ নারী’ বলে দাবি করেছেন। এমন মন্তব্যের জেরে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। আটলান্টা এবং রেডিও স্টেশনের বিতর্কে বাইডেনের ভয়াবহ পারফরম্যান্সের পর নতুন করে বাইডেনের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। বাইডেনের বয়স এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তার যোগ্যতা নিয়ে নিজ দলের মধ্যেই শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আলোচিত হচ্ছে তাকে অপসারণ করার মতো দাবিও। যদিও দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানা অদ্ভুত, অসংলগ্ন কাজের মধ্য দিয়ে বারবার আলোচনায় থেকেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই ৮১ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট। সিঁড়িতে হোঁচট খাওয়া থেকে শুরু করে বক্তৃতায় হোঁচট, এলোমেলো কথা বা অসময়ে ঝিমিয়ে পড়া— এসব আচরণ যেন বাইডেনের ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা নির্বাচনের মাঠে বাইডেনকে অনেক অস্বস্তিতে রেখেছে।
জো বাইডেনের পার্কিনসন রোগের বিতর্কের বিষয়টি নিয়েও মুখ খুলতে হয়েছে হোয়াইট হাউস কর্তৃপক্ষকে। তারা নিশ্চিত করেছে, এই রোগে আক্রান্ত নন তিনি। যদিও তাদের এই দাবি নিয়ে নানা মহলে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বাইডেন যদি সত্যিই পার্কিনসন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে নির্বাচন থেকে নাম প্রত্যাহার করার এখনই উত্তম সময় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এবিসি নিউজ বাইডেনকে প্রশ্ন করেছিল, তিনি স্বাস্থ্য এবং নির্বাচনে জয়লাভের জন্য আত্মবিশ্বাসী কিনা। জবাবে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য কেউ তার চেয়ে বেশি যোগ্য এমনটা মনে করেন না বলে জানান বাইডেন। অবশ্য কর্মক্ষমতার ব্যাপারে নিজের উপর সবসময় ষোলোআনা বিশ্বাসই রেখেছেন তিনি।
সাম্প্রতিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলোকে বাইডেনের জন্য বড় বিপর্যয় বলে মনে করছে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো। রিপাবলিকান দলের সাধারণ ভোটাররা বাইডেনের এই অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা। এই অবস্থায় দ্বিতীয়বারের জন্য ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে ডেমোক্র্যাট দলের অন্দরে জোর চেষ্টা চলছে। দাবি উঠছে, অবিলম্বে বাইডেনের বদলে অন্য কাউকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করার। এখন সংশয় জাগছে আসলেই কি জো বাইডেন একটু বেশিই বুড়িয়ে গেছেন?
সত্যিই যদি বাইডেনকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয় তাহলে তার পরিবর্তে প্রার্থী হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন বর্তমান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। তবে প্রশ্ন উঠছে, কমলা হ্যারিস প্রার্থী হলে নভেম্বরের নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্পকে হারাতে পারবেন কি? অথবা, কমলা হ্যারিস কী আদৌ জো বাইডেনের চেয়ে যোগ্য প্রার্থী? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি সমীক্ষা হয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জো বাইডেনের চেয়ে কমলা হ্যারিস তুলনামূলক ভালো ফল করতে পারবেন, কিন্তু তাকে যথেষ্ট শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে। অন্য একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাইডেনের ওপর থেকে ভোটারদের আস্থা সরছে পাশাপাশি জনপ্রিয় হচ্ছেন কমলা হ্যারিস। এমতাবস্থায় ডেমোক্র্যাটদের একাংশের বক্তব্য, কালবিলম্ব না করে জো বাইডেনের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হোক কমলা হ্যারিসকে।
গত ২ জুলাই একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ ভোটার বাইডেনের পক্ষে থাকলেও ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন ৪৯ শতাংশ ভোটার। কিন্তু পরে প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিসের নাম আনা হলে দেখা গিয়েছে দল নিরপেক্ষ ভোটারদের ৪৩ শতাংশ কমলা হ্যারিসকে এবং ৪০ শতাংশ ডনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন। এছাড়া মধ্যপন্থী ভোটাররা কমলা হ্যারিসকে ৫১ শতাংশ এবং ডনাল্ড ট্রাম্পকে ৩৯ শতাংশ সমর্থন করেছেন। একই রকম ফলাফল দেখিয়েছে রয়টার্সের একটি সমীক্ষা। দেখা যাচ্ছে, বাইডেনের বক্তৃতা-বিপর্যয়ের পরে ট্রাম্প ও কমলার সমর্থন প্রায় সমান হয়ে গিয়েছে। ট্রাম্পের ৪৩ শতাংশ সমর্থনের সঙ্গে ৪২ শতাংশ সমর্থন নিয়ে রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছেন হ্যারিস। আমেরিকার বণিকমহলের কর্তারা অনেকেই বলছেন, এখনও সময় আছে, ডেমোক্র্যাটরা যদি যেচে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে না চায়, তাদের উচিত অবিলম্বে কমলাকে প্রার্থী করা।
যাকে নিয়ে এত কথা, সেই কমলা হ্যারিস অবশ্য এসব আলোচনাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। বিতর্কের পরেও আগাগোড়া জো বাইডেনের পাশে থেকেছেন। একবারের জন্যও হোয়াইট হাউসের প্রতি তার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেননি। বরং স্পষ্ট বলেছেন, ‘দেখুন, আমাদের প্রার্থী জো বাইডেন। আমরা ট্রাম্পকে একবার হারিয়েছি। আরও একবার হারাতে চলেছি। ব্যাস।’ সঙ্গে যোগ করেছেন, ‘আমি জো বাইডেনের সহযোগী হিসেবেই গর্বিত।’
আমেরিকার ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত কোনো নারীকে প্রেসিডেন্টের আসনে দেখা যায়নি। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, কমলাকে যদি প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেওয়া হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন ইতিহাস তৈরি হবে। যদিও বাইডেন নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর গুজবে অনেকের নাম চর্চায় চলে এসেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাক্তন সিনেটর ও অ্যাটর্নি জেনারেল হ্যারিসের নামও আছে এই তালিকায়। তালিকায় আরও আছে প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার নাম। তবে তিনি কখনোই নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহ দেখাননি।
শুরুতে কমলা হ্যারিস তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে। বাইডেনের ছায়ায় কিছুটা অন্তরালেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। তার বর্তমান দায়িত্বের সময়ে বড় রকমের কোনো নীতিতেও বদল আসেনি। উল্টো মধ্য আমেরিকা থেকে আসা শরণার্থী নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে তাকে। কিন্তু সম্প্রতি গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে বিখ্যাত ‘রো বনাম ওয়েড’ রায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিতেই রাতারাতি নারীদের অধিকার নিয়ে সরব হয়েছেন হ্যারিস। এতেই অল্পবয়সীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে দ্বিগুণ। তাই তো তাকে নিয়ে এত বেশি আলোচনা হচ্ছে এখন।
অনেকেই মনে করেন বয়সজনিত কারণেই নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত জো বাইডেনের। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত বৃদ্ধরা দুর্বল হতে পারে তবে তাদের অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার কারণে তারা অনেকদূর এগিয়েও যেতে পারে। বয়স শুধু একটা সংখ্যা মাত্র। মনোবল ও কর্ম চাহিদা মানুষকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রেই বুড়োদের শাসন চলছে, তা নয়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনেরও বয়স ৭১ বছর, ভারতের নরেন্দ্র মোদীর বয়স ৭৩ বছর, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বয়স ৭৪ বছর, ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসের বয়স ৮৮ বছর, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বয়স ৮৫ বছর। এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক বিশ্বনেতা ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়ার বয়সও ৯১ বছর। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বয়স ৭৬ বছর। শুধু যে বয়সের কারণে কেউ দেশ পরিচালনায় অক্ষম– এই কথা কিন্তু ঢালাওভাবে প্রচার করাও অমূলক।
এটা ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এখন বাইডেনের পরিপূরক অন্য কাউকে চাচ্ছে। কমলা হতে পারেন তাদের অন্যতম চাওয়ার নাম। যদিও নির্বাচন থেকে বাইডেন এখনই সরে যাচ্ছেন এমনটি বলার সময় আসেনি। বাইডেন বরাবরই ভোটারদের আশ্বস্ত করে যাচ্ছেন একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া অন্য কেউ তাকে সরাতে পারবে না। তার এই খামখেয়ালিপনার জন্য কি চরম মূল্য দিতে হবে ডেমোক্র্যাটদের? যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা হয়তো তাদের রায়ে সেটি বুঝিয়ে দেবেন ভালোভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস বেশ জোরেসোরেই বাইডেনকে এই মুহূর্তেই সরে দাঁড়ানোর জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। যদিও এই সংবাদপত্রটি ডেমোক্র্যাটদেরই দীর্ঘদিন ধরে সহযোগিতা করে আসছে নানাভাবে। তারা বারংবার বার্তা দিচ্ছে, বাইডেন সরে না দাঁড়ালে ভয়াবহ ফলাফল বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ডেমোক্র্যাটরা। বিজয় সুনিশ্চিত হবে ডনাল্ড ট্রাম্পের। এটা ঠিক ডেমোক্র্যাটদের হাতে তেমন একটা সময়ও নেই এখন। সামনে আর মাত্র কয়েকদিন। খুব দ্রুতই চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনীত করতে হবে তাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কি কমলাই হতে পারবেন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট? সময় হয়তো উত্তর দেবে এ প্রশ্নের। বাইডেন যে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর লোক না, এটা তার দলের সকলেরই জানা। এখন প্রশ্ন ডেমোক্র্যাটরা কি বাইডেনকে রাজি করাতে পারবে? তবে এটা ঠিক বাইডেন যদি সরে দাঁড়ায় তাহলে আরেকটি ইতিহাস তৈরি হবে।
ডেমোক্র্যাট দলের মাথারাও এখন সবদিক খতিয়ে দেখছেন আসলে কী করা যায়। তারাও জানেন, কমলা হ্যারিসের ভাবমূর্তি আগে এতটা ভালো ছিল না। সেক্ষেত্রে রাতারাতি প্রার্থী বদল হলে জনমানসে ভুল বার্তা যেতে পারে কিনা সেটাও এখন দেখার বিষয়। অবশ্য রাজনীতিতে তো কিছুই অসম্ভব নয়! যেকোনো কিছু যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে।