‘শুধু মৌলিক অধিকার দিলেই হয় না, তাকে বলবৎ করার জন্য রক্ষাকবচ দরকার’
Published : 28 Dec 2023, 04:22 PM
সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে যে কয়টি বিষয়ে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংবিধানের মূলনীতি ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’। বঙ্গবন্ধু তো বটেই, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদেরও অনেকে এর নানামাত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সিরাজুল হক সমাজতন্ত্রকে হ্যাটের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, আমরা সমস্ত নাগরিককে আইনের চোখে সমান করেছি এবং তাদের যে অর্থনৈতিক চেষ্টা এবং অর্থনীতিতে তাদের যে অধিকার, সেটাকে আমরা গ্যারান্টি দিতে চেষ্টা করেছি।
সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে উল্লেখ করে সিরাজুল হক বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির এই মৌলিক অধিকার হরণ করলে বা হরণ করবার চেষ্টা করলে সে যত ক্ষুদ্রই হোক—হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের সামনে গিয়ে ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দরখাস্ত করতে পারবে এবং সেখানে সরকারের এমন কেউ থাকবে না, যে সেই ‘ডাইরেকশন’ অর্থাৎ নির্দেশ অমান্য করতে পারে। তেমন কোনো ক্ষমতা রাষ্ট্রের কাউকে দেওয়া হয়নি।’
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখার বাইরেও ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার কারণে বেশি আলোচিত সিরাজুল হক। কেননা যে গল্পটি বছরের পর বছর দেশের রাজনীতি ও জনপরিসরে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করা হয়েছে সেটি হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে এর কোনো প্রতিবাদ হয়নি। কিন্তু ইতিহাস বলছে, প্রতিবাদ হয়েছে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান খলনায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদ, যিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি, তাকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন একজন সংসদ সদস্য—যিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। তাঁর নাম সিরাজুল হক। বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে যিনি খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, তিনি তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মানেন না।
সিরাজুল হক ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। জীবন সায়াহ্নে যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই আইনজীবী ছিলেন সিরাজুল হক।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য ৩৪ সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়, সিরাজুল হক শুধু ওই কমিটির একজন সদস্যই ছিলেন না, বরং খসড়া সংবিধানের ওপর গণপরিষদে যে বিতর্ক হয়েছে, সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০২২ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সিরাজুল হক বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা।
জন্ম ও শিক্ষা
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের জীবনবৃত্তান্তসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টে সিরাজুল হকের জন্ম তারিখ ১৯২৫ সালের পয়লা আগস্ট। তবে তাঁর ছেলে আনিসুল হক জন্ম তারিখ বলছেন ১৯২৫ সালের ২৫ চৈত্র। বাংলা চৈত্র মাসের শেষ অংশটি ইংরেজি এপ্রিল মাসে পড়ে। সেক্ষেত্রে পয়লা অগাস্ট সম্ভবত তাঁর সার্টিফিকেটের জন্মতারিখ। প্রকৃত জন্ম তারিখ এপ্রিল মাসের কোনো একদিন—যেটি বাংলায় ২৫ চৈত্র।
সিরাজুল হকের বাবা নুরুল হুদা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার পানিয়ারূপ গ্রামে। তাঁর বাড়িটি ‘দারোগা বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। সিরাজুল হকের মা জাহেদা খানম। নুরুল হুদা চাকরির সুবাদে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে বসবাস করেছেন। সিরাজুল হকের জন্ম সাতক্ষীরা জেলায় এবং তাঁর শৈশব কেটেছে ওই অঞ্চলে।
তিনি খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। আই.এ পাস করার পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। তিনি ভালো ক্রিকেট ও ফুটবল খেলতেন। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভালো স্পোর্টস টিম ছিল না। সেজন্য প্রেসিডেন্সি কলেজ কর্তৃপক্ষ সিরাজুল হককে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি করে। ইংরেজি বিভাগে। তিনি ক্রিকেট ও ফুটবল দুটিতেই পারদর্শী হলেও বেশি আগ্রহ ছিল ফুটবলে। তিনি এতই ভালো খেলতেন যে ক্রিকেট ও ফুটবল—দুটিতেই ‘প্রেসিডেন্সি ব্লু’ (খেলোয়াড়দের বিশেষ খেতাব) অর্জন করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ঊনিশশো সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চপদস্থ কাস্টমস অফিসার পদে যোগ দেন। তবে তিনি সরকারি চাকরি করতে চাননি। তাঁর স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হবেন। কিন্তু বাবার অনুরোধে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।
আনিসুল হক জানান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ওই সার্টিফিকেটকে আমলে নেয়নি। অর্থাৎ দেশে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ইংরেজিতে যে এম.এ পাস করেছেন, তার স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। কারণ তিনি শিক্ষকতা করতে চাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় সিরাজুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ১২ এবং ইংরেজির ৪টিসহ মোট ১৬ পেপার পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হন। অর্থাৎ তিনি ডাবল মাস্টার্স করেন। এরপর তিনি কায়েদে আজম কলেজ, জগন্নাথ, হলিক্রস কলেজসহ ঢাকার প্রায় সবগুলো নামকরা কলেজে পড়িয়েছেন। তবে তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল আইনজীবী হওয়া। ১৯৫৭ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে পুরোপুরি আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন।
রাজনৈতিক জীবন: বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রায় সব মামলার আইনজীবী
ফরিদপুর জেলা হলেও তখন গোপালগঞ্জ খুলনার আওতাভুক্ত। মাঝখানে মধুমতি নদী। এপারে শেখ মুজিবুর রহমান, ওপারে সিরাজুল হক। এপার-ওপার করে পরস্পরের গভীর সান্নিধ্যে আসেন তাঁরা। দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
বিরতির পর কলকাতায় আবার দুই বন্ধুর দেখা। শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজে, আর সিরাজুল হক প্রেসিডেন্সি কলেজে। তবে দুজনই একসঙ্গে থাকতেন বেকার হোস্টেলে।
আনিসুল হকের ভাষায়, “সিরাজুল হক পড়াশোনায় মগ্ন হয়ে রইলেন। শেখ মুজিব (তখনো বঙ্গবন্ধু হননি) শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। দেশ ভাগ হলো। শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে জেলজুলুম খেটে রাজনীতির চূড়ায় উঠছেন। বন্ধু সিরাজুল হক তখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চপদস্থ কাস্টমস অফিসার। তবে স্বাধীনচেতা সিরাজুল হক সরকারি চাকরিতে মানিয়ে নিতে পারলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করে ওকালতি পেশায় যোগ দিলেন। দুজন দুই মেরুতে থাকলেও তাদের যোগাযোগ বা বন্ধুত্ব সব সময়ই অটুট ছিল।” (আনিসুল হক, আমার পিতা সিরাজুল হক, সংবিধান ও বিচার বিভাগের ৪০ বছর/২০১৩, পৃষ্ঠা ১২৯)।
১৯৫৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, তার বেশির ভাগেরই আইনজীবী ছিলেন সিরাজুল হক। তিনি ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে তালিকাভুক্ত হন। আইন পেশায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক বন্ধন গড়ে ওঠে। সেই বন্ধুত্বের মায়ায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামিপক্ষে যোগ দেন অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক।
আনিসুল হক জানান, পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে তাঁর বাবার উদ্যোগে কসবা আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। তিনি আওয়ামী লীগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৪ সালে কপের (কম্পাইনড অপজিশন পার্টি) অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি বিডি মেম্বার নির্বাচিত হন। এর পরের বছর ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির অধীনে সাধারণ নির্বাচনে কসবা-নবীনগর-মুরাদনগর ও বাঞ্ছারামপুর এলাকা নিয়ে গঠিত আসন থেকে আইন পরিষদের নির্বাচন করে হেরে তিনি যান।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি কুমিল্লা-৪ (জাতীয় পরিষদ ১৩৪) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯৭০ সালে কুমিল্লা-৪ আসনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার ২০৮। সিরাজুল হক পেয়েছিলেন ৬১ হাজার ২৭৮ ভোট, যা প্রাপ্ত ভোটের ৬২.৪৪ শতাংশ। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের আগে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সিরাজুল হক দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য যুদ্ধে নেমে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধ: বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য লিফলেট আকারে বিলি
বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে সিরাজুল হক আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য এবং স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি লিফলেট আকারে বিলি করেন।
আনিসুল হক জানান, ১৯৭১ সালের ১৭-১৮ মার্চ তাঁর বাবাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি আর্মিরা। তবে সন্ধ্যায় ছেড়ে দেয়। পরদিন ভোরে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে যান। আনিসুল হক বলেন, “৭ মার্চের ভাষণের পরপরই মা, ছোট ভাই, দুই চাচাতো বোন আর দাদিকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। তখন আমার বড় বোন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে বলে ঢাকায় ছিল, সে কারণে আমিও ঢাকায় থেকে গেছি।”
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি ভারতে যান এবং সেই থেকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে বাংলাদেশের যে প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করেন, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন সিরাজুল হক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে তিনি ইউরোপও সফর করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর সিরাজুল হক নিজের এলাকায় ফিরে আসেন এবং বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দেন। যদিও তিনি এলাকায় বেশিদিন অবস্থান করতে পারেননি। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য গঠিত কমিটিতে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গণপরিষদে সিরাজুল হক: বাঙালি হিসেবে সম্বোধিত হওয়ার চেয়ে গর্বের কিছু নেই
১৯৭০ সালের নির্বাচনের বিজয়ীদের নিয়ে ১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠন করা হয়। তাঁদের মধ্য থেকে ৩৪ জনকে নিয়ে গঠন করা হয় সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। যে কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন সিরাজুল হক। এরই মধ্যে তিনি আইনজীবী হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর প্রায় সকল মামলায় তাঁর আইনজীবী হিসেবে সিরাজুল হকের একটা আলাদা গুরুত্ব তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আকৈশোর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও এখানে হয়তো কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। সিরাজুল হক ইংরেজি ভাষায় ছিলেন দক্ষ। ফলে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তাঁর মতো ভালো ইংরেজি জানা লোকের গুরুত্ব ছিল।
১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর গণপরিষদে সংবিধান-আলোচনায় অংশ নেন সিরাজুল হক। বলেন, আজকের এই শুভক্ষণটি তাঁর জীবনের এক চরম মুহূর্ত। “আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম যে, বাংলাদেশ কবে স্বাধীন হবে এবং তারপর জাতিকে কবে একটা সংবিধান দিতে পারব। আজ এই মুহূর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছে সেই সব বীর শহীদের কথা, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসাবে বিশ্বের ইতিহাসে পরিচিত হতে পেরেছি।” (ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম, বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৪৪৯)।
সংবিধানকে একটা ‘গাইডলাইন’ উল্লেখ করে সিরাজুল হক বলেন, “কোনো সংবিধানেই সব আইন লেখা থাকে না, সব কথা লেখা থাকে না। সুতরাং আমাদের সামাজিক, পারিবারিক কার্যক্রম কী পদ্ধতিতে চলবে, তার একটা রূপরেখা সংবিধানে দেওয়া থাকবে, আর একটা ইঙ্গিত সংবিধানে পাওয়া যাবে।”
সিরাজুল হক বলেন, “খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আমি একজন সদস্য হিসাবে এই কথা বলতে পারি যে, আমরা এখানে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি যে, বাঙালি জাতি চব্বিশ বৎসর ধরে কিসের পেছনে এত সব আন্দোলন করছে। তাঁরা চেয়েছেন তাঁদের একটু বাঁচার অধিকার। তাছাড়া, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সমাজতান্ত্রিক অধিকার যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তারই জন্য এই সংবিধান এবং তারই জন্য তাঁরা আন্দোলন করেছিলেন। আমাদের দেখতে হবে যে, এই সংবিধানের মধ্যে সেই গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি কি না।”
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের কারণে দেশের বাইরে প্রথম বারের মতো ‘বাঙালি’ বলে সম্বোধিত হয়েছেন উল্লেখ করে সিরাজুল হক বলেন, “এর থেকে বড় গর্ব আমার আর কিছু হতে পারে না।”
এই প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনা উল্লেখ করেন বলেন, “আমি যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একটি পার্কে ঘুরছিলাম। সেখানে দশটি ছেলে অন্য দশটি ছেলেকে আক্রমণ করছে। তারা খেলা করছিল। একদল বলছে অন্য দলকে যে, তোমরা পাকিস্তানী সৈন্য আর আমরা বাঙালি গেরিলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই কে পাকিস্তানী সৈন্য আর কে বাঙালি গেরিলা হবে এই নিয়ে তাদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল এবং সেটা সত্যিকারের মারামারি। আমি দাঁড়িয়েছিলাম। আমার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল যে, আজকে তারা বাঙালি জাতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমার বঙ্গবন্ধুকে আমার বাঙালি জাতিকে তারা স্বীকৃতি দিয়েছে। একটি নতুন ইতিহাস পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে। সেই গর্ব আমার পরিষদের সামনে প্রকাশ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি।”
সংবিধানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের সামনে গিয়ে ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দরখাস্ত করতে পারার সুযোগের ব্যাপারে এই বিজ্ঞ আইনজীবী বলেন, “শুধু মৌলিক অধিকার দিলেই হয় না, তাকে বলবৎ করার জন্য যে ‘মেশিনারি, যে রক্ষাকবচ দরকার, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।”
সংবিধানের মূলনীতিতে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ কেন রাখা হলো, তারও ব্যাখ্যা দেন সিরাজুল হক। বলেন, “সমাজতন্ত্র এমন একটি জিনিস, ‘হ্যাটের সঙ্গে যার তুলনা করা যায়। It is like a hat which has been used by everybody and it has lost its shape. এটা এমন একটা হ্যাট যা সবাই মাথায় দিতে চায়, কিন্তু জিনিসটা দেখতে কেমন, তা কেউ জানে না। তবে আমরা চেষ্টা করেছি লিপিবদ্ধ করতে। ১৯ অনুচ্ছেদ আপনারা দেখুন, ২০ অনুচ্ছেদ আপনারা দেখুন। তাতে বলে দিয়েছি সমাজতন্ত্র বলতে আমরা কী বুঝি। ১৯ ও ২০ অনুচ্ছেদ আপনারা দেখুন। আমরা সমস্ত নাগরিককে আইনের চোখে সমান করেছি এবং তাদের যে অর্থনৈতিক চেষ্টা এবং অর্থনীতিতে তাদের যে অধিকার, সেটাকে আমরা গ্যারান্টি দিতে চেষ্টা করেছি। এবং আমরা কতকগুলো ‘গাইডলাইন’ দিয়েছি। সেগুলো রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে রয়েছে। This is an ideal. This is not a part of the law, but this is an ideal to be achieved by the people that will come late through the process of law. It is a process of law.”
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠন করার অধিকার প্রশ্নের বিতর্ক উঠলে সিরাজুল হক বলেন, “বাইরে বা গ্যালারিতে বসে সংবিধান গঠন করা যায় না। বাঙালির আশা, বাঙালির আকাঙ্ক্ষা, বাঙালির স্বপ্নকে আমরা এর মাধ্যমে প্রস্ফূটিত করবার চেষ্টা করেছি। তা সত্ত্বেও এই সংবিধানের যদি কারও সমালোচনা করার ইচ্ছা থাকে, তাহলে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এ সম্বন্ধে কথা বলা উচিত।”
পয়লা নভেম্বরের বৈঠকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা গণিকাবৃত্তি উচ্ছেদের পাশাপাশি গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত নারীদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার বিধান সংবিধানে যুক্ত করার প্রস্তাব করলে এ বিষয়ে বক্তব্য দেন সিরাজুল হক। বলেন, “আমরা প্রথমেই বলেছি যে, এটা আমাদের কোনো আইন নয় এবং এটা আসলে মূলনীতিতে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র চেষ্টা করবে কেমন করে এই গণিকাবৃত্তি ধীরে ধীরে সমাজ থেকে দূর করা যায়। তবে এখনই গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত নারীদের প্রতিষ্ঠিত করা অত্যন্ত জটিল ব্যাপার। সংবিধানের সৎ উদ্দেশ্য হচ্ছে ধীরে ধীরে গণিকাবৃত্তি তুলে দেওয়া। আজকে যদি আমরা গণিকাবৃত্তি তুলে দিই, তাহলে হয়তো সরকার দুই দিনের মধ্যে সমাজে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। তাই আমরা চাচ্ছি যে, সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যদি আমরা তা ধীরে ধীরে আইনের মাধ্যমে আনতে পারি, তাহলেই ভালো হয়। তা না হলে আমার মনে হয়, তারা সমাজকে কলুষিত করে তুলতে পারে।”
এদিনের বৈঠকে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠন করার অধিকারের প্রশ্নে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কিছু প্রশ্ন তুললে এবং সংশোধনী প্রস্তাব আনলে সিরাজুল হককে ফ্লোর দেন স্পিকার। তিনি বলেন, “সংঘ বা সংগঠন গঠন করার অধিকার যে সমস্ত আইনে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ধর্মঘটের কথাও আছে এবং সম্মেলনের কথাও রয়েছে। পৃথিবীর এমন কোনো সংবিধান নেই যেখানে এইসব ন্যায্য আইনকে অস্বীকার করা হয়েছে। এখানে ধর্মঘটের অধিকারের কথা আলাদা করে বলতে গেলে তা সম্পূর্ণ ‘রিডান্ডেন্ট’ হবে। যেখানে ইউনিয়নের অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেখানে তার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মঘটের অধিকার আপনা আপনিই থেকে যায়।” ধর্মঘটকে আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ করার প্রয়োজন নেই বলেও মনে করেন সিরাজুল হক।
পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর ধরে বাঙালি তথা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীরা অনেক ষড়যন্ত্র করেছে উল্লেখ করে সিরাজুল হক বলেন, “তাদেরকে কেটে পরিষ্কার করে একটা নূতন কর্মচারি-সার্ভিস আমরা চালু করতে যাচ্ছি। এটা কারও অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়, কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্যও নয়।”
বাহাত্তর-পরবর্তী জীবন: রাজনীতিতে বেশিদিন সক্রিয় ছিলেন না
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কুমিল্লা-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। এই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৭ জন। সিরাজুল হক পেয়েছেন ৬০ হাজার ৩৮৭ (৮৭.৬৫ শতাংশ) ভোট।
১৯৭৩ সালে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদায় বিশেষ প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন।
১৯৭৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগ মিজান গ্রুপে যোগ দিয়ে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৪ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান।
১৯৭৯ সালে দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী এম.এ.জি ওসমানীর পক্ষে প্রচারে সক্রিয় ছিলেন সিরাজুল হক। নির্বাচনে ওসমানী হেরে গেলে তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নীরব ছিলেন এবং নিজের আইন ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। যদিও সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ১৯৮২ সালের ১০ অক্টোবর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিনি ১৭ দিন তিনি জেল খাটেন। (বাসস ২৭ অক্টোবর ২০২২)।
১৯৮২-৮৩ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশেনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। প্রসঙ্গত, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরও চারজন সদস্য বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশেনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা হলেন আছাদুজ্জামান খান (১৯৭০-৭২), ড. কামাল হোসেন (১৯৯০-৯১), শওকত আলী খান (১৯৯৬-৯৭) এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম (২০০৬-০৭)।
অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক পুনরায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। এই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৩। সিরাজুল হক পেয়েছেন ১৫ হাজার ৭৬১ ভোট। তিনি ছিলেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। এই আসনে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির লিয়াকত আলী। তিনি পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৪৪৬ ভোট।
সিরাজুল হক ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মনোনীত হন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনেও তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। এখানে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ১৬১ জন। সিরাজুল হক পেয়েছেন ২৬ হাজার ৮৬৭ ভোট। এখানে বিজয়ী হন বিএনপির মিয়া আব্দুল্লাহ ওয়াজেদ। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ৩৭ হাজার ৩২৮।
সিরাজুল হক ১৯৯১ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের পক্ষে আইনজীবী নিযুক্ত হন এবং এ কারণে দল থেকে অব্যাহতি নেন।
অগাস্ট ট্র্যাজেডির প্রতিক্রিয়া: বন্দুকের নলের মুখে মোশতাককে চ্যালেঞ্জ
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মূল হোতা খন্দকার মোশতাক আহমদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে বঙ্গভবন দখল করেন। তার চারপাশ ঘিরে তখন খুনিচক্র। চারিদিকে থমথমে অবস্থা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ চার নেতাও কারাগারে। অনেকে আত্মগোপনে। অনেকে যোগ দিয়েছেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের বৈঠক ডাকেন খন্দকার মোশতাক। সেই বৈঠকে যোগ দেন সিরাজুল হক। বঙ্গভবনের দরবার হলে বৈঠকে যোগ দেন অন্য সংসদ সদস্যরাও। সবাই নিরব-নিশ্চুপ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিদের আশ্রয়ে খন্দকার মোশতাক বিনা প্রতিবাদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করলেও সংসদীয় দলের বৈঠকে বঙ্গভবনে তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন সিরাজুল হক। স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, তিনি খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানেন না। মোশতাককে তিনি ‘অবৈধ প্রেসিডেন্ট’ বলে আখ্যা দেন। এ নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। মোশতাককে ঘিরে রাখা খুনিচক্র রাইফেল তাক করে সিরাজুল হককে গুলি করার জন্য। কিন্তু তিনি থামেননি।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ লিখেছেন: “খন্দকার মোশতাক তার ক্ষমতা দখলকে জাতীয় সংসদ কর্তৃক বৈধতাদানের অভিপ্রায়ে অধিবেশন আহ্বানের পরিকল্পনা করেন। প্রয়োজনবোধে তাদের হাত করার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু নগণ্যসংখ্যক সদস্য উপস্থিত হওয়ায় সভার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। ১৬ অক্টোবরে বঙ্গভবনে পুনরায় সভা আহ্বান করা হয়। এদিন বেলা দশটায় একশোর বেশি এমপি সেখানে উপস্থিত হন। তবে আওয়ামী লীগের প্রথম কাতারের কোনো নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। বঙ্গভবনে না যাওয়ার পক্ষে আমরা দল বেঁধে প্রকাশ্য লবিং শুরু করি। শুরু হয় চরম উত্তেজনা। সিরাজুল হক সাহেব আমাদের কথা দেন, তিনি ছোট একটি প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখবেন এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়টি উপস্থাপন করবেন। তিনি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে ‘মোশতাক ভাই’ সম্বোধন করেন। বলেছিলেন, ‘আমি আপনাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সম্বোধন করতে পারি না। কোন আইনের বলে আপনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তা জানি না। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাদের সাথে আপনি বঙ্গভবনে আশ্রয় নিয়েছেন এবং আমাদেরকে বলেছেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নিতে। আপনি যদি সত্যিই রাষ্ট্রপতি থাকতে চান, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা আমাদের জানাতে হবে। আইনানুযায়ী আপনাকে ‘বৈধ রাষ্ট্রপতি’ বলা যায় না।” (অধ্যাপক আবু সায়িদ, তোমার আলোকে রহিব জাগিয়া, অনন্যা/২০২০, পৃষ্ঠা ১৭৫)।
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরীও ওই ঘটনার সাক্ষী। লিখেছেন: “সম্ভবত অক্টোবরের ১৬ তারিখে সংসদ সদস্যদের এক সভা বঙ্গভবনে ডাকা হয়। সভাস্থলের চারপাশে এবং গেটে ১৫ অগাস্টের খুনিদের নেতৃত্বে সশস্ত্র সৈন্যরা অবস্থান নিয়ে প্রহরা দিতে থাকে। স্পিকার আবদুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। এতে অনেকেই ভীতসন্ত্রস্তভাবে অত্যন্ত সংযত বক্তব্য রাখেন, যাতে মুশতাকের বিরাগভাজন হতে না হয়। কিন্তু কালিগঞ্জের ময়েজ উদ্দিন আহমদ, কালিয়াকৈরের শামসুল হক ও অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। মনে পড়ে, আমার বক্তব্যে আমি বলেছিলাম, ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ৩২ নম্বরে রাজনীতির যে নিষ্ঠুর মর্মান্তিক পরিণতি দেখেছি, তাতে রাজনীতি করার আর শখ নেই।” (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিনকাল, অনন্যা/২০০৩, পৃষ্ঠা ১৭০)।
সিরাজুল হকের ছেলে আনিসুল হক জানিয়েছেন, তাঁর বাবা সিরাজুল হক ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সঙ্গে মোশতাকের ২৭ বছরের ঘনিষ্ঠতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এমনকি তাঁরা এক থালার খাবারও ভাগাভাগি করে খেয়েছেন। তখন তিনি (মোশতাক) কখনই বঙ্গবন্ধুর কোনো সিদ্ধান্তের সমালোচনা কিংবা কোনো অভিযোগ করেননি। সিরাজুল হক বলেন: ‘আজ আপনি বলছেন বঙ্গবন্ধু চোর, আপনি ভালো মানুষ, আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখব? আপনি বলছেন আমাকে তা দেখতে? কতো বড় সাহস আপনার!’
আনিসুল হক বলেন, “ওই সময়ে ঘটনাস্থলে অভ্যুত্থানকারীদের একজন সিরাজুল হককে লক্ষ্য করে বন্দুক তাক করলে তাঁকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘মেজর, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি না। আমি তার (মোশতাকের) সঙ্গে কথা বলছি। কারণ, তিনি আমাদেরই একজন ছিলেন। আপনি আমাকে হত্যা করতে চাইলে পাঁচ মিনিট পরে করুন। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা আমাকে শেষ করতে দিন।”
আনিসুল হক জানালেন, তাঁর বাবার কাছ থেকে তিনি শুনেছেন যে, তিনি চুপচাপ থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মোশতাক ধীরে ধীরে দুজন আইনপ্রণেতাকে তীব্র অবমাননা করতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন নারী যিনি তার পিতাকে সমর্থনের চেষ্টা করছিলেন। কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুর আসনের আইনপ্রণেতা ড. আবদুল হক প্রথমে ভদ্রভাবে সিরাজুল হকের পক্ষে বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি মোশতাকের তীব্র তিরস্কারের মুখে পড়েন। এরপর প্রফেসর মমতাজ বেগম যিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে এমপি হয়েছিলেন তিনি সিরাজুল হকের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিলে মোশতাক তাকে বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করে থামিয়ে দেন। তাঁদেরকে অবমাননা করতে দেখে সিরাজুল হক উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে। আপনি (মোশতাক) সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে কথা বলছেন। আপনি বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসুন। আমি আপনার গালে চড় মারব।’
আনিসুল হক বলেন, “ওই রাতে বাড়ি ফিরে বাবা বলেছিলেন, ‘বঙ্গভবনে আমি যা বলেছি, ঠিকই বলেছি। আমি পরিণামের পরোয়া করি না।” (বাসস, ২৭ অক্টোবর ২০২০)।
অধ্যাপক আলী আশরাফও তখন সংসদ সদস্য (কুমিল্লা-১১)। স্মৃতিচারণ করে বলেন, “ওই দিনের বৈঠকের স্থান ছিল বঙ্গভবনের দরবার হলে। কিন্তু অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক লোকজন চারপাশ ঘিরে থাকায় দরবার হলকে মনে হচ্ছিল অবরুদ্ধ কোনো কম্পার্টমেন্ট। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল বিধায় তিনি ভয় পাচ্ছিলেন খুনিরা হয়তো গোলাগুলি শুরু করবে। তিনি বলেন, আমি সিরাজুল হকের বাহু আঁকড়ে ধরে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসি। কারণ তখন সবাই পালাচ্ছিলো।” (ভোরের কাগজ, ২৯ অক্টোবর ২০২২)।
প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মুসাও সিরাজুল হকের ওই বক্তব্য নিয়ে জানিয়েছিলেন। তিনি তখন নোয়াখালী-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। বলছেন, “সিরাজুল হক সরাসরি খন্দকার মোশতাককে প্রশ্ন করলে, আপনি কেন মুজিবকে হত্যা করেছেন? মোশতাক বললেন, এই হত্যাকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা কী ছিল, তা জনগণ যথাসময়ে উপলব্ধি করতে পারবে। সিরাজুল হক তখন বললেন, প্রয়োজনীয়তাটা কী ছিল তা জানতে আমি অপেক্ষা করবো। তা না জানা পর্যন্ত আমরা আপনাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি না।”
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক: তুই তো ফি নিবি না…
ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল সিরাজুল হকের। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ আরও বিভিন্ন মামলায় বঙ্গবন্ধুকে হয়রানি করে। সিরাজুল হক ওইসব মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের স্মৃতির ঘটনা উল্লেখ করে সিরাজুল হকের ছেলে আনিসুল হক বলেন, “১৯৬৯ সাল। তখন বয়স আমার সাড়ে ১৩ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মোহাম্মদপুরের বাসায় এলেন। মনটা আমার উৎফুল্ল হয়ে গেল। আসার হেতু, আমার পিতা তাঁর বন্ধু ও আইনজীবী। সেদিন বা তার দুই-একদিন আগে পাকিস্তান সরকারের একটি মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নির্দোষ প্রমাণিত করে কোর্ট খালাস দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু একটি টয়োটা গাড়িতে করে আমাদের বাড়ি পৌঁছলেন। আমার পিতার সঙ্গে কোলাকুলি করার পর একটি মিষ্টির প্যাকেট হাতে দিয়ে বললেন—‘উকিলের বাসায় খালি হাতে আসা উচিত নয়। তুই তো ফি নিবি না, এক প্যাকেট মিষ্টি এনেছি।’ তিনি ভেতরে গিয়ে বসলেন। তারপর যখন চা এলো। চায়ের সঙ্গে গুড়ের সন্দেশও উনার জন্য দেওয়া হলো। আমি উনার পাশেই ছিলাম। উনি সন্দেশের বাটিটা হাতে নিয়ে আমাকে বললেন—‘তুই নে।’ আমি বললাম, আগে আপনি নেন। জবাবে আমাকে বললেন, ‘তুই যদি না নিস, তাহলে পুরো বাটিটা মাটিতে ফেলে দেবো।’ তখন তাড়াতাড়ি করে আমি একটা সন্দেশ নিলাম। উনিও একটা নিলেন। যাওয়ার সময় পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘সাংবাদিক এবিএম মুসার বাড়ি নাকি তোর বাড়ির কাছেই? আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমার ছদ্মনাম ছিল পরশ। ওর ছেলের নামও নাকি পরশ রেখেছে। তাকে একটু দেখে যাবো’।” (দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ নভেম্বর ২০২০)।
ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে সিরাজুল হক এর কড়া প্রতিবাদ করেন, যে প্রতিবাদের কারণে ওই সময়ে তাঁর নিজের জীবনও বিপন্ন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে তিনি রাজনীতিতে খুব সক্রিয় ছিলেন না। বরং নিজের পেশাগত কাজে মনোনিবেশ করেন। জীবন-সায়াহ্নে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুরু হলে তিনি এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেলহত্যা মামলাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। এছাড়া আরও অসংখ্য চাঞ্চল্যকর মামলার সফল কৌঁসুলি তিনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা: বন্ধুত্বের ঋণ শোধের চেষ্টা
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন, তখনই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা রুজুর পরিকল্পনা নেন। যে মুহূর্তে পরিকল্পনা করেন তখন থেকেই এই মামলা পরিচালনার জন্য সিরাজুল হককে দায়িত্ব দেন। ফৌজদারি মামলায় তাঁর অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে বিশেষ আস্থায় নিয়েেছিলেন। পরে তাঁকে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ পিপি নিয়োগ করা হয়। জেল হত্যা মামলার দায়িত্বও সিরাজুল হককে নিতে হয়েছিল। যে কারণে তিনি ব্যক্তিগত মামলা পরিচালনা কমিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সব ধ্যান-জ্ঞান ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। জীবনের শেষপ্রান্তে বন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনার সুযোগ পেয়ে তিনি গর্বিত বোধ করতেন।
যদিও বঙ্গবন্ধুর বন্ধু হওয়ায় এ মামলা পরিচালনায় তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তুলেছিল আসামি পক্ষ। পরে আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে বলেছিলেন, “জনাব সিরাজুল হক এই মামলার প্রধান আইনজীবী হইলেও মামলা চলাকালে কখনও তাহার আচরণ/কথাবার্তায় কোনো পক্ষ অবলম্বনের চেষ্টা আদালতের গোচরীভূত হয় নাই। এমনকি কোনো আসামিপক্ষের তরফেও এই জাতীয় আপত্তি উপস্থাপন করা হয় নাই। বরং আসামিপক্ষ এবং তাহাদের পক্ষের নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবীদেরকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি উদার সমর্থন জানাইয়াছেন এবং শেষ পর্যন্ত মামলাটিতে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর হিসাবে তাঁহার ভূমিকা পালন করিয়াছেন বলিয়া আদালত মনে করে। সুতরাং তাঁহার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত অভিযোগটি নাকচ করা হইলো।” (সংবিধান ও বিচার বিভাগের ৪০ বছর/২০১৩, পৃষ্ঠা ১৩০)।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম আইনজীবী থাকাকালীন রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলা পরিচালনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, “হেয়ার রোডের মন্ত্রিপাড়ার ৩৫ নম্বর বাড়িটি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আদালতের কার্যক্রম শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা হাজির হতাম ওই ৩৫ নম্বর বাড়ির চেম্বারে। যেখানে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ও আইনি জটিলতা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হতো। জনাব সিরাজুল হক সাহেব ছিলেন স্বনামধন্য একজন বড় মাপের আইনজীবী। তাঁর অভিজ্ঞতা ও মেধা আমাদের মুগ্ধ করত। উনার একটি গুণ ছিল তিনি সর্বকনিষ্ঠ আইনজীবীর মতামতও গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করতেন। তাঁকে কখনও আদালতে রাগ করতে দেখিনি। তিনি রাগান্বিত স্বরে কখনও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতেন না। অত্যন্ত সহজ-সরল ইংরেজি ভাষায় তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। তিনি বলতেন, জজ সাহেবদের রাগিয়ে কিংবা চাপ প্রয়োগ করে ভালো আদেশ আদায় করা যায় না।" জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের ভাষায়: “সিরাজুল হকের যুক্তিতর্ক ছিল ঐতিহাসিক। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি যে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলেন, তা ছিল বেদনাবিধুর। তাঁর সর্বশেষ উপস্থাপনা এতই করুণ ছিল যে, আদালতে উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।” (জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা: কিছু স্মৃতিকথা, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১)।
আনিসুল হক তাঁর বাবার জীবদ্দশায় এই মামলার অন্যতম এবং বাবার মৃত্যুর পরে প্রধান আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। লিখেছেন: “বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনার সময় দেখেছি আবেগের উর্ধ্বে উঠে পেশাদারী মনোভাব নিয়ে আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করে খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের জন্য তাঁর (সিরাজুল হক) প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার দায়রা ও জেলা জজ কাজী গোলাম রসুল ফায়ারিং স্কোয়াডে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেন। রায়ের দিন আব্বার চোখে পানি দেখেছি। তিনি বলেছিলেন, এ রায়ে অন্ততপক্ষে বাংলাদেশের আইনের শাসনের দিকে ফিরে আসার সুযোগ হলো।” (আনিসুল হক, প্রাগুক্ত)।
নানা চড়াই উৎরায় পেরিয়ে ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিলের রায়ের পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আসামিদের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ওইদিন মধ্য রাতেই বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়। আনিসুল হক বলছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যেমন স্বজন হারানোর ব্যথা রয়েছে, তেমনি আমার পিতা তাঁর বন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার বিচার দেখে যেতে পারেননি। আপিলের রায়ের পরে আমি আমার পাশে আব্বাকে খুঁজছিলাম। আব্বা বেঁচে থাকলে যে কী খুশি হতেন, তা বলে বোঝানো যাবে না।”
ব্যক্তি সিরাজুল হক: ভালোবাসতেন শেক্সপিয়র, গোলাপ ও লেবু
সিরাজুল হক গাড়ি চালাতে পছন্দ করতেন। ছবি তুলতে পছন্দ করতেন। নিজের ক্যামেরা ছিল। বাগান করতে ভালোবাসতেন। পছন্দ করতেন গোলাপ ফুল ও লেবু গাছ। বিশেষ করে সুগন্ধী লেবু। যেখানেই যেতেন, সুগন্ধী লেবু পেলে নিয়ে আসতেন। এমনকি লেবুর গাছ। বই পড়তে ভালোবাসতেন। তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন শেক্সপিয়র। এমনকি আদালতের শুনানি ও সংসদে বক্তৃতায়ও তিনি শেক্সপিয়রের উধ্বৃতি ব্যবহার করতেন।
স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কসবার সাবেক আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম লিখেছেন, “১৯৬৫ সাল থেকে আমি সিরাজুল হকের কর্মকাণ্ড দেখার সুযোগ পেয়েছি। আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে দেশের দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে নির্বাচনি অভিযান পরিচালনার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা একজন মেধাবী আইনজীবীর পক্ষেই সম্ভব।”
তিনি লিখেছেন, “১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু কসবায় যান। কসবা হাইস্কুলের মাঠে জনসভার আয়োজন করা হয় এবং মঞ্চ তৈরি থেকে ভলান্টিয়ার পরিচালনার দায়িত্ব পান সিরাজুল হক। বঙ্গবন্ধু আসেন দুপুর প্রায় ১২টায়। স্কুল মাঠে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ। গঙ্গাসাগরের গোলাম রফিক, আখাউড়ার নিলু মিয়া, নাদির হোসেন ও বুড়িচংয়ের অনেক নেতাকর্মী সভায় উপস্থিত হন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সিরাজুল হক মঞ্চে উঠে প্রথমে যে বক্তব্য রাখেন, তাতে এত বড় জনসমাগমেও পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল।’”
সিরাজুল হকের সঙ্গে ব্যক্তিগত্য সখ্যের কথা উল্লেখ করে আবদুল কাইয়ুম লিখেছেন, “আমি তাঁর সুপ্রিম কোর্ট বার চেম্বারে অনেকবার দেখা করেছি। অনেক আলাপ-আলোচনা করেছি। ধর্মনিরপেক্ষ ও আকাশচুম্বী প্রতিভার অধিকারী এই মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য আমাদের জীবনকে মহীয়ান করেছে, তা আমরা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি।” (সমকাল, ২৯ অক্টোবর ২০১৫)।
সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী সমীর চক্রবর্তী জানান, সিরাজুল হককে কাছ থেকে দেখেছেন এরকম বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। এর মধ্যে বৃহত্তর কুমিল্লা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বাবুল জানান, ১৯৮৮-৮৯ সালে বৃহত্তর সিলেট আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক সমাবেশ উপলক্ষ্যে বিরাট আয়োজন করা হয়। এই আয়োজন সফল করতে কুমিল্লার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। ওই সম্মেলন সফল করতে সিরাজুল হক তখন ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সদ্যপ্রয়াত আল মামুন সরকার জানান, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি জেলে ছিলেন। সিরাজুল হক তখন খ্যাতিমান আইনজীবী। জেলখানায় বসে তাঁকে একটা চিরকুট লেখেন। এরপর তিনি আইনি লড়াই করে আল মামুনকে জেল থেকে বের করে নিয়ে আসেন। মামুন বলেন, ‘শুধু আমি একা নই। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে তিনি আইনি লড়াই করে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। এ জন্য তিনি কেনো ফি নিতেন না।’
আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, সিরাজুল হক আদালতে প্রবেশের আগেই আইনজীবীরা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন তাঁর হিয়ারিং শোনার জন্য।
কুমিল্লার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ (১৯৪৭-২০২১) জানান, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাকে ‘কারচুপি’ করে হারানো হয়েছিল। আলী আশরাফ এর বিরুদ্ধে মামলা করেন। সিরাজুল হক সেই মামলা লড়েছিলেন কোনো ফি ছাড়া। তিনি বলেন, ‘আমার দুঃসময়ে সিরাজুল হকের স্ত্রীও যেভাবে আমাকে আর্থিক সহায়তা করেছেন, সেই ঋণ শোধ করবার নয়।’
পরিবার, মৃত্যু ও দাফন
সিরাজুল হক ১৯৫২ সালে জাহানারা হককে বিয়ে করেন। তাঁর শ্বশুর আবদুস সামাদ ১৯২৭ সালে লিডস ইউনিভার্সিটি থেকে এম.এ পাস করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। সিরাজুল হকের শাশুড়ি সালেহা বেগম।
সিরাজুল হক ও জাহানারা হক দুজনই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সিরাজুল হক ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর শিকদার মেডিকেলে মৃত্যুবরণ করেন। বার্ধক্যজনিত সমস্যার বাইরেও তাঁর প্রধানত কিডনির সমস্যা ছিল। রাজধানীর বনানী মসজিদে জানাজা শেষে তাঁকে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
তাঁর স্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহানারা হক ৮৬ বছর বয়সে ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে আনিসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী। বাবার আসন থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি জয়ী হন।
আনিসুল হকও পিতার মতো একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। বাবার মৃত্যুর পরে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বিডিআর বিদ্রোহ ও দুদকের মামলাসহ রাষ্ট্রীয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করেছেন আনিসুল হক। বিয়ের কয়েক বছর পরে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রী নূর আমাতুল্লাহ্ রিনা হক মারা যান। এরপর আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি আনিসুল হক।
সিরাজুল হকের বড় মেয়ে সায়মা ইসলাম ৬৫ বছর বয়সে ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরদিন মন্ত্রিসভায় একটি শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
এর আগের বছর ২০১৭ সালের ১০ মার্চ মারা যান ছোট ছেলে আরিফুল হক রনি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।