মেরুদণ্ড ‘নাই’ হয়ে যাবার কারণ ও অজানা কিছু নয়। সহজ জীবন আর উচ্চ চিন্তার বাঙালি বিলুপ্তপ্রায়।
Published : 26 Jul 2023, 11:46 PM
মানদণ্ড ও মেরুদণ্ড—এ দুয়ের ভেতর সম্পর্ক নিবিড়। ব্যক্তি থেকে সমাজ সর্বত্র মানদণ্ড নির্ভর করে সে মানুষটি বা জাতির মেরুদণ্ডের ওপর। কিউবা নামের যে দেশটি দুনিয়ায় সগর্বে টিকে আছে, মাঝে মাঝে অনেক দেশকে টিকে থাকার প্রেরণা জোগায় তার ভিত্তি তাদের মেরুদণ্ড। আমেরিকা আর ইউরোপ সামান্য ধমক দিলেই আমাদের দেশের রাজনীতির কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। অথচ আমেরিকা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে পেছনে লেগে থেকেও কিউবা বা কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। কারণ তাদের নেতা ও জনতা রাজনীতি যতটা বোঝে, তার অধিক বোঝে দেশ।
গবেষকরা মনে করেন, কিউবার খবর জানতে আমাদের পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কিউবার কোনো বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পাওয়া কঠিন। গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকা কিউবা সংগ্রামের ভুল ছবি দিয়ে সংবাদ করে। এটা নিয়ে ভুল স্বীকার করলেও তাকে নিরীহ কোনো ঘটনা বলা যায় না। বিগত কয়েক দশক ধরেই তাদের প্রধান কাজ কিউবার বিপ্লব, শাসনব্যবস্থার ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ছড়ানো। তাদের দৃষ্টিতে কিউবার কোনো সাফল্য ও অর্জন নেই, কোনো ইতিবাচকতা নেই।
আমি শুধু একটি দিকে আলোকপাত করবো। বর্তমানে দেশটিতে শিশু সাক্ষরতার যে হার তা লাতিন দেশগুলোয় অভাবনীয়। কিউবার সরকার মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের ব্যাপারে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। সকল শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষার সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ, স্কুলে শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের নিবিড় আচরণ, পরিবারের সদস্যদের মাঝে শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি শিক্ষার প্রসারে রাষ্ট্রের ইতিবাচক ও কঠোর ভূমিকা গ্রহণ কিউবার শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তুলেছে যুগোপযোগী ও শক্তিশালী। আজকের কিউবার শিক্ষাব্যবস্থা কোনো মিরাকল নয় বরং তা সুপরিকল্পনা ও তার সফল বাস্তবায়নের ফসল।
বলছিলাম রাজনীতির কথা। অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রায় সব বিষয়ে পশ্চিমা মুরুব্বিরা নাক গলাচ্ছে । ঢাকা ১৭ আসনের উপনির্বাচনের পর আক্রান্ত প্রার্থী হিরো আলমের ব্যাপারেও তারা কথা বলছে। অথচ এই প্রার্থীর যোগ্যতা এবং অবস্থান সর্ব অর্থে প্রশ্নবিদ্ধ।তবু তাঁর ওপর হামলা হলে কথা তারা বলতেই পারেন। কিন্তু আমাদের কি এতে বোধোদয় হয় না যে তাদের নাক গলানোর কারণ আমরাই? বলার পরিস্থিতি তো আমরাই তৈরি করে দিয়েছি। এমন সব স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলা মানে তো দেশের আইন, শাসন ও বিচার নিয়ে কথা বলা। যে সরকার বছরের পর বছর দেশ শাসনে, যার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত বলেই শুনি, তারা কি ভাবেন না এতে করে তাদের ইমেজ সংকটে পড়ে? যে ঘটনা, যে অঘটনা তার পেছনে আসলে কারা বা কেন তা করা হয়েছে সেটা যতদিন প্রকাশ্য না হবে আমাদের কপালের দুর্ভোগ ঘুচবে না।
অবশ্য হিরো আলমকে নিয়ে বিবৃতিদাতা ১৩ জন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে সরকার তাদের এই কাজে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনের কথা জানিয়ে দিয়েছে। ২৬ জুলাই দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ১২ দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারদের ডেকে সরকারের অসন্তোষের কথা জানানো হয়। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের উপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এই রাষ্ট্রদূতরা বিবৃতি দিয়েছিলেন।
হিরো আলমের কথা থাক। মূলত রাজনীতির জটিলতায় সমস্যা মেরুদণ্ডকে আঘাত করতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এখন এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি যে দেশে যান সেখানেই মুষ্টিমেয় বাংলাদেশীর উগ্র আচরণ এখন প্রকাশ্য। এই মারমুখি আচরণ দেশ ও দেশের ইমেজের সহায়ক নয় । বরং সংঘাতপূর্ণ। অথচ দেশের বেশিরভাগ মানুষই রাজনীতি বিমুখ। তাহলে যে প্রশ্নটি মাথাচাড়া দেয়, একদিকে রাজনীতিবিমুখতা অন্যদিকে রাজনৈতিক উগ্রতা, এ দুয়ের ব্যবধান ঘুচবে কি ভাবে ?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখার পর ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ক্যাস্ত্রোর এই কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও কিউবা ছিল। সেই সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাক্ষাৎ হয়। সে সময় ক্যাস্ত্রো নাকি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’
তাহলে প্রশ্ন আসে বঙ্গবন্ধুর দেশের রাজনীতি, তাঁরই দল আওয়ামী লীগের শাসনামলে কেন এই সংকটে পড়েছে? রাজনীতির খেলাধুলা বোঝা কঠিন। যেটা বুঝি তা হচ্ছে মেরুদণ্ড ভেঙে পড়া। আজকাল মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষের বড় অভাব। মেরুদণ্ড ‘নাই’ হয়ে যাবার কারণ ও অজানা কিছু নয়। সহজ জীবন আর উচ্চ চিন্তার বাঙালি বিলুপ্তপ্রায়। তার হাতে টাকা এসেছে। টাকা আসলেই যে দেশ বা জাতি সভ্য হয়ে যায় না তা বহু দেশের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব। যদি তাই হতো ব্রুনাই বা মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশই হতো আদর্শ । তারা সুখে শান্তিতে আছেন, ভালো আছেন। কিন্তু পৃথিবীর মানদণ্ডে তাদের অবদান শূন্যের কোঠায়। আর যে সব দেশ সভ্যতাকে নিয়মিত পুষ্ট করে চলেছে তাদের হয়তো তেমন টাকা নেই, আছে অন্তরের ঐশ্বর্য। আছে জ্ঞান বিজ্ঞান। আমরা কি সে পথে এগুচ্ছি?
আমাদের সামনে এখন টাকার হাতছানি। কত টাকা থাকলে বা কত টাকা হলে একজন মানুষ বড়লোক হতে পারে সে ধারণাও নেই। গত এক দশকে টাকার জোরে জনপ্রতিনিধি হয়ে আসা মানুষজনের চারিত্র বিশ্লেষণ করলেই বুঝবেন কেন সমাজে ভালো মানুষেরা একঘরে। কেন তাদের জবান বন্ধ। একটা সময় ছিল যখন সাধারণ নামের অসাধারণ মানুষেরাই থাকতেন সামনের কাতারে। যেমন ধরুণ প্রাইমারি স্কুলের টিচার বা সমাজকর্মী। এমন মানুষেরা ছিলেন আদর্শ। আজ আপনি এদের কোথাও খুঁজে পাবেন না। তার বদলে নামের আগে ইয়াবার মতো মারাত্মক মাদকের নাম বসে গেছে এমন মানুষও সমাজের মধ্যমণি। নিজে নির্বাচনে মনোনয়ন না পেলেও তাদের বউ বা ভাইবেরাদর পান। তাহলে আপনি শান্তি বা স্বস্তি পাবেন কোথায়? কে দেবে ভরসা?
মেরুদণ্ড নির্মানের প্রথম ধাপ তৈরি করে পরিবার ও স্কুল কলেজ। তারপর সমাজ। দেশে স্কুল কলেজের যা হাল তাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও ক্লাসিক বিষয়গুলো লোপাট । ধর্মের প্রয়োজন যুগে যুগে ছিল থাকবেও। কিন্তু এমন একমুখী আগ্রাসন কি মেরুদণ্ডের জন্য স্বাস্থ্যকর? আসলে যে যা জানছে বা শিখছে তার ভেতর কোথাও একটা ভুল থেকেই যাচ্ছে। আর সেই ভুল বড় হতে হতে এখন আমাদের সমাজকে পঙ্গু করে ফেলেছে প্রায়।
বিদেশের মাটিতে বসবাসের বয়স অনেক দীর্ঘ। প্রবাসী বাঙালির মনোজাগতিক আচরণ ও একই কথা বলে। বুঝিয়ে দেয় আমাদের মেরুদণ্ডের চিকিৎসা প্রয়োজন। আমরা গণতান্ত্রিক দেশ ও সমাজে বসবাস করি কিন্তু নিজেদের বেলায় গণতন্ত্র মানি না। আমরা উদার সমাজের সবকিছু ভোগ করি অথচ নিজেদের বেলায় পূর্ণ অনুদার বা কট্টর। শুধু দেশের দিকে নয় এখন দেশের বাইরের বাংলাদেশীদের দিকে তাকালেও মানদণ্ডের সমস্যা চোখে পড়বে।
উপায় তাহলে কি? উপায় অবশ্যই আছে। যে রাজনীতি সফেদ পাঞ্জাবি-পায়জামার, যে সমাজ সাইকেল চেপে আসা গানের মাস্টারের, যে দেশ কৃষক-শ্রমিকের তার কাছে ফেরত যাওয়া। আধুনিকতা বা প্রযুক্তি কখনো এদের অসম্মান করতে শেখায় না। এই অস্ট্রেলিয়ায় দেখছি, যে কোনো ধনী মানুষের চাইতে সম্পন্ন ও সফল কৃষকের মূল্য বেশি। ফার্মার নামধারী এদের শান শওকত ও মর্যাদা রাষ্ট্রের কাছে সবচাইতে বেশি। আমরা যেন তা ভুলে না যাই। যদি সাধারণ মানুষের অসাধারণ কাজকর্ম আর সফলতা মূল্যায়ন করা হয়, যদি ভুইফোঁড় রাজনীতিবিদ ও নেতাদের আসমান থেকে মাটিতে নামিয়ে আনা যায় তো কেউ আমাদের চোখ রাঙ্গাতে পারবে না। বরং সমীহ করতে বাধ্য হবে।