শহীদ আসাদ যে আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিলেন, যে আন্দোলনে আইয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল ওই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন মওলানা ভাসানী। তার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বাংলার বুকে সংঘঠিত হয়েছে অভূতপূর্ভ এক গণঅভ্যুত্থান।
Published : 20 Jan 2025, 03:54 PM
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রনেতা আসাদ কোথায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন? এই প্রশ্নটি আমি কয়েকটি পরিসরে করেছিলাম। অনেকেই বলেছেন, সংসদ ভবনের পশ্চিম পাশে আসাদ গেইটে। বাঙালির অবিস্মরণীয় জাগরণকালের এক শহীদ সম্পর্কে এমন অজ্ঞতা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। তবে কোনো কিছু না জানা অন্যায় বা অপরাধ নয়। লেখাটি শুরুতে দুটো ছোট্ট বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (ডাক নাম আসাদ) আসাদ গেইটে নয় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটকের সামনে। ওই সময় সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সম্মানে নির্মিত আইয়ুব গেইটের নাম পরিবর্তন করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা বর্তমান সংসদ ভবনের পশ্চিম পাশের এই গেইটের নামকরণ করেছিলেন আসাদ গেইট। ওই থেকেই আইয়ুব গেইট হয়েছে আসাদ গেইট। আর এই গণআন্দোলনে ১৯ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদুল হক নামের আরেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলেন। যদিও ভাগ্যগুণে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এই আসাদুল হক ও শহীদ আসাদ এক নন। ১৯৬৯ সালের শুরুতে বাঙালির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশার স্তূপে স্ফূলিঙ্গ হয়ে দাবানাল ছড়িয়েছিল তিনটি মৃত্যু। ওই তিন অমর শহীদ হলেন রুস্তম, মতিউর ও আসাদ। আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় তার মৃত্যু বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চার করেছিল সুনামির মতো।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এক বড় মাইলফলক। একটি জাতির জাগরণ কাল। দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ওই সময়ে বাংলার মানুষ সমস্বরে প্রতিবাদ করেছিল। ছাত্র, যুবা, রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী, আমলা, চাকুরে প্রায় সবাই রাস্তায় নেমেছিল আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে। যা অনেকটা ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানের মতো। ঊনসত্তরের ওই অভূতপূর্ব জনজাগরণের নানা অনুঘটক ছিল। ছিল ত্যাগ-তিতিক্ষা, কারাবরণ ও আত্মদানের করুণ কাহিনী। যেগুলো ক্রমান্বয়ে একটি আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ওই সময় ঢাকার পিচঢালা পথে পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও বুলেটের মুখে বিক্ষুব্ধ নগরবাসী জঙ্গি মিছিলে তুলে ধরেছিলেন একটি নিশান। একটি বুলেটবিদ্ধ শার্ট, শহীদ আসাদের শার্ট। যে রক্তাক্ত শার্ট বাঙালি জাতিকে একত্রিত করেছিল প্রতিবাদ মিছিলের মোহনায়। নাগরিক কবি শামসুর রাহমান যথাযথভাবেই লিপিবদ্ধ করেছেন–
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো, কিংবা সুর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
আসাদ পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সক্রিয় নেতা ছিলেন। এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে কৃষকদের মধ্যে সংগঠনের কাজ করতেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। কৃষক সমিতিকে সংগঠিত করতে তিনি কাজ করেন শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা ও নরসিংদী এলাকায়। ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে আসাদ ঢাকার বাইরে ছিলেন। তিনি দলের জন্য কৃষক সংগঠনের কাজ করছিলেন মনোহরদীতে। এ সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। আইয়ুব খানের নির্দেশ মতো চলছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার। দেশে রাজনীতি প্রায় নিষিদ্ধ। বেশিরভাগ দলের শীর্ষ নেতারা জেলে। এ সময় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন ছাত্র ও শ্রমিক নেতারা। এটা উল্লেখ করতেই হয়, ওই আন্দোলনে বামপন্থী নেতাদের বিশেষত ছাত্রনেতাদের বিশেষ অবদান ছিল। আর সার্বিকভাবে বাতিঘর হিসেবে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শক্তিশালী ও একক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। যে কারণে অন্যসব রাজনৈতিক নায়করা দুঃখজনকভাবে আলোচনার বাইরে থেকে গেছেন। তাদের অবদান স্বীকার করা তো অনেক দূরের কথা, মুছে দেয়ার চেষ্টাও হয়েছে। শহীদ আসাদ যে আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিলেন, যে আন্দোলনে আইয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল ওই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন মওলানা ভাসানী। তার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বাংলার বুকে সংঘঠিত হয়েছে অভূতপূর্ভ এক গণঅভ্যুত্থান। যার মূল শক্তি ছিল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ। ওই অভ্যুত্থানের একটি লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলন প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানে। আর পূর্ব পাকিস্তানে এই আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে। যা দ্রুত গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এই গণঅভ্যুত্থানের জঙ্গি শক্তি ছিল ছাত্র সমাজ। আর তাত্ত্বিক বা ঋষির মতো আন্দোলন এগিয়ে নিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। দেশবরেণ্য বাম রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনো তার ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ আত্মজীবনীতে এ বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “মওলানা ভাসানী বিভিন্ন বক্তৃতার মধ্য দিয়ে আগুন ছড়াচ্ছেন। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় মানুষ তেতে উঠছে, বিদ্রোহে ফেটে পড়ছে। মওলানা ভাসানীর এই সময় আরেকটি বড় অবদান হল, তিনি আন্দোলনকে মধ্যবিত্তের গণ্ডির বাইরে নিয়ে যেতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি শ্রমিক কৃষকদের মুক্তি সংগ্রামের ঝাঁপিয়ে পড়ার আবেদন রাখছেন, যার ফল পাওয়া গেল ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে।” (পৃষ্ঠা; ১৬৮)
ওই গণআন্দোলনে মওলানা ভাসানীর আহ্বানে অভূতপূর্ব একটি কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। যার নাম ‘হাট হরতাল’। ২৯ ডিসেম্বর ছিল ভাসানীর দ্বিতীয় হাট হরতাল কর্মসূচি। এই হাট হরতালেই পুলিশ মনোহরদীতে গুলি চালায়। এতে বেশ কয়েকজন হতাহত হন। সেই খবর নিয়েই ঢাকা শহরে এসেছিলেন আসাদ। তার উদ্দেশ্য ছিল গণমাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের খবর দেওয়া। ওই সময় জেলা শহরের খবর খুব একটা গণমাধ্যমে পৌঁছাত না। কিন্তু ঢাকা শহরের আইয়ুব খানের পুলিশের বর্বরতার খবর দিতে এসে আসাদ নিজেই বড় খবরে পরিণত হয়েছিলেন ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯।
ডিসেম্বরের শেষে ঢাকায় এসে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন আসাদ। তখন উত্তাল ঢাকা মহানগরী। এরই মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ, ছাত্রলীগ ও এনএসএফের একটি অংশ মিলে গঠিত হয়েছে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। তারা জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন ঐতিহাসিক ১১-দফা। একের পর এক চলছে ধর্মঘট। মিছিলে মিছিলে বিক্ষুব্ধ নগরীর পথঘাট। এমনই উত্তাল সময় পেরিয়ে বাঙালি জাতির সামনে আসে ২০ জানুয়ারি। যেদিন একটি মিছিলে পুলিশের গুলিতে বিদীর্ণ হয় ছাত্রনেতা আসাদের বুক। ওই দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আসাদের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা রাশেদ খান মেনন দিনটিকে উল্লেখ করেছেন বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি হিসেবে। কারণ এদিনও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন ছাত্ররা।
রাশেদ খান মেনন তার ‘এক জীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন “এক সময় হঠাৎ মিছিল লক্ষ্য করে পয়েন্ট ব্ল্যাংক গুলি ছোড়া হলে আসাদের বুকে লাগে এবং সে রাস্তায় পড়ে যায়। ... তখন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী চঞ্চল সেন প্রমুখ তাকে ধরাধরি করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।” (পৃষ্ঠা; ২৭০)
এরপর আসাদের মৃত্যুর খবর ঢাকা শহরে বিদ্যুতের বেগে ছড়িয়ে পড়ে। শোকার্ত মানুষের ঢল নামে ঢাকা মেডিকেলে। এদিকে ওইদিন বিকেলেই শোকার্ত নগরবাসী সড়কে দুই লাইনে ভাগ হয়ে খালি পায়ে শোক মিছিল বের করেন। ওই মিছিলের অগ্রভাগে ছিল বুলেটে ক্ষতবিক্ষত আসাদের রক্তাক্ত শার্ট।
২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যুর পর ২৪ জানুয়ারির ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হরতাল। ওই সময় এই হরতাল সর্বজনীন রূপ লাভ করে। মানুষ স্রোতের মতো রাস্তায় নেমে আসে। পুরো আন্দোলন জনবিস্ফোরণে রূপ নেয়। যে তীব্র বিস্ফোরণে ভস্মীভূত হয়ে যায় আইয়ুব খানের নিপীড়ক প্রশাসন। যদিও এ সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রুস্তম ও স্কুল ছাত্র মতিউর। এতে আন্দোলন আরও সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করে। ভেঙ্গে পড়ে আইয়ুব খানের প্রশাসন। এমন বাস্তবতায় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পিছু হটে আইয়ুব খান। আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় গোলটেবিল বৈঠক। তাতে যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। ২৫ মার্চ ১৯৬৯ পদত্যাগ করেন আইয়ুব খান। যদিও এর পরই মার্শাল ল’ জারি করে পাকিস্তানের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন ইয়াহিয়া খান। শুরু হয় বাঙালির আরেক সংগ্রামের অধ্যায়।
রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম দুর্বলতা হলো, এখানে অনেক চোরা গলি আছে। আছে ক্ষমতাসীনদের শক্তিশালী বয়ান। যে কারণে অনেক আত্মত্যাগের ইতিহাস চাপা পড়ে যায়। আসাদ বামপন্থী ছিলেন, মওলানা ভাসানীর দল বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কখনই ছিল না— যে কারণে ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোর ইতিহাস এই দুই চরিত্রের ওপর কখনোই আলো ফেলেনি। এমনকি শহীদ আসাদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল চত্ত্বরে ‘গণজাগরণ’ নামে একটি ভাস্কর্য করা হলেও সেটা রাতের আঁধারে উধাও হয়ে গেছে। আর কেউ খোঁজ রাখেনি। আশা রইল নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঊনসত্তরের শহীদ আসাদ, রুস্তম, মতিউর ভিন্নভাবে আলোচিত হবেন। মওলানা ভাসানীকেও কেউ কেউ স্মরণ করবেন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আর তা না হলেও মন খারাপের কিছু নেই। কারণ আমার বিশ্বাস যখনই কোনো স্বৈরাচার বাংলার মানুষের ওপর জুলুম চালাবে তখনই আসাদের রক্তাক্ত শার্ট বিজয় নিশান হিসেবে আমাদের পথ দেখাবে।