আমাদের ‘বসন্ত’ আরব-স্টাইলে আসবে, নাকি রাজনীতির নেপথ্য খেলোয়াড়েরা ‘সব সংগীত’ ‘ইঙ্গিতে থামিয়ে’ দেবেন, এটা বোঝার জন্য আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।
Published : 03 Aug 2024, 06:57 PM
বাংলাদেশ এখন অগ্নিগর্ভ। দিকে দিকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। চলছে সহিংসতা, উত্তেজনা। দুই সপ্তাহ আগে আন্দোলন যখন সহিংস হয়ে উঠেছিল তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে দুই শতাধিক। এরপর থেকেই পরিস্থিতি একটু একটু করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। এখন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে, সান্ত্রী-সেপাই দিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতাকে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আন্দোলনের ঢেউ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। আন্দোলনকারীদের হত্যার দায় বর্তেছে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যেহেতু সম্মুখভাগে আছেন, কাজেই তারা আন্দোলনকারীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। গত কয়েকদিনের সহিংস আন্দোলনে চারজন পুলিশকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
ঠিক সময়ে যথাযথ উদ্যোগ নিতে ব্যর্থতার কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করছে। আর এই ফাঁকে ‘ঝোঁপ বুঝে কোপ মারা’র বিদ্যায় পারদর্শীরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে গেছে। আন্দোলনে এখন শুধু শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক নয়, জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানান মহলের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন কার্যত সরকার ফেলার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বলা হচ্ছে, এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল। এবং সুযোগ তৈরি করে দিলে তাদের তা-ই করার কথা। একইসঙ্গে ফেইসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকারীদের মারমুখী করে তোলার চেষ্টাও হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নানা প্রক্রিয়ায় তাদের তাতিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে একেকটি শিক্ষার্থী হয়ে উঠেছে যেন ‘টাইম বোমা’। এখন কেবল বিস্ফোরণের অপেক্ষা!
কেউ কেউ এই আন্দোলনকে মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন বা তিউনিশিয়ার মতো ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলন বলে মনে করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘আরব বসন্ত’-এর সঙ্গে এই আন্দোলনের মিলও আছে।
দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুর্বল অর্থনীতি, অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, চরম দারিদ্র্য ও শিক্ষিত হতাশাগ্রস্ত যুবসমাজ বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যুবকদের অসন্তোষ আরব বসন্তের পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এ ছাড়াও ওইসব দেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে ছিল। সম্পদের সুষম বণ্টন হয়নি। ফলে খরা ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয় সাধারণ মানুষ। ওই সময় আন্দোলনের শুরুটা করেছিল তরুণ সমাজ। তাদের অনেকেই ছিলেন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। যেখানে স্বৈরতন্ত্র ও রাজতন্ত্রকে অচল বলে মনে করা হয়। এ কারণে জীবনযাত্রার মান, শিক্ষার হার বৃদ্ধির ফলে মানব উন্নয়ন সূচকের উন্নতি হলেও সরকারের সংস্কার না হওয়া তারা মেনে নিতে পারেনি। এই তরুণ সমাজ মূলত সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে আন্দোলন গড়ে তোলে।
বাংলাদেশের চলমান আন্দোলনের মূল কারিগর হচ্ছে তরুণ সমাজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাদের প্রধান হাতিয়ার। এই হাতিয়ার ব্যবহার করে তারা একটা সামাজিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। আর জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে সরকারে চণ্ডনীতি, একগুয়েমি, দুর্বিনীত আচরণ। সরকার যদি শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোনো আপস-রফায় যেতে না পারে তাহলে এই আন্দোলনের গতিমুখ আরব বসন্তের পথেই যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত মনে পড়ছে আরব বসন্তের দিনগুলোর কথা। ১৮ ডিসেম্বর, ২০১০। তিউনিসিয়ার এক মফস্বল শহর সিদি বাউজিদে মুহাম্মদ বুয়াজিজি নামে ২৬ বছরের এক ফল বিক্রেতা প্রশাসনের দুর্নীতি আর বেকারত্বের জীবনে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। তখন কে জানত এ ঘটনার মাত্র ২৭ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলীর ২৩ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের মাধ্যমে সূচনা হবে ‘আরব বসন্তের’। এতে করে কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা শাসনযন্ত্র তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। বাধ্য হয়ে বেন আলী পালিয়ে যান সৌদি আরবে। তিউনিসিয়ার পর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আলজেরিয়া, জর্ডান, মিসর এবং ইয়েমেনসহ আরবের অন্যান্য দেশে।
তিউনিসিয়ার পর মিসর। দেশটির রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে মাত্র ১৮ দিনের আন্দোলনে প্রায় ৯শ প্রাণের বিনিময়ে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন হোসনি মোবারক। নভেম্বরে ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আলী আবদুল্লাহ সালেহ মনসুর আল হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। অবসান ঘটে ৩৩ বছরের স্বৈরশাসকের। এই আন্দোলনের পথ ধরে লিবিয়ায় ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে। তবে লিবিয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল কিছুটা ভিন্ন। দেশটিতে যেভাবে পরিবর্তন এসেছে তাকে কোনোভাবেই গণতন্ত্রের পথে সঠিক যাত্রা বলা যাবে না। লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির অপসারণের দাবিতে উত্তাল হলো গোটা দেশ। ২০ অক্টোবর টিভি চ্যানেলগুলি সারা বিশ্বকে দেখাল, কীভাবে স্বৈরাচারী গাদ্দাফিকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে মারল জনতা।
বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের শিকার হয়েছেন ইয়েমেনের একনায়কতন্ত্রী আলী আবদুল্লা সালেহ। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিল ইয়েমেনি জনতা। ২৩ নভেম্বর ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিতে সই করলেন সালেহ। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতন ঠেকাতে তার সরকার-বিদ্রোহীদের সংঘর্ষ এখনো চলছে।
‘আরব বসন্ত’ শেষপর্যন্ত বসন্ত আনতে পারেনি। আজ আরবের আকাশে ইউরোপের যুদ্ধবিমান আর মাটিতে ভ্রাতৃঘাতী ইসলামি জঙ্গিদের উন্মাদনা। সিরিয়া নামক দেশটি দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল। সংখ্যাগুরু সুন্নিদের সমর্থনে এগিয়ে আসে সৌদি আরব আর প্রেসিডেন্ট আসাদের সমর্থনে ইরান ও রাশিয়া। আসাদের ট্যাঙ্ক রুখতে বিরোধীরা ফ্রি সিরিয়ান আর্মি গঠন করে প্রত্যাঘাতের পথে পা বাড়ায়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যা এখনো চলছে। হাজারে হাজারে সিরিয়ান উদ্বাস্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয়প্রার্থী। এই সিরিয়াতেই আজকের বিশ্বের ত্রাস আইএসআইএস-এর ঘাঁটি। সিরিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ এবং ইরাকের বেশ কিছু এলাকা আইএস-এর দখলে।
তিউনিসিয়াতেও চলছে অরাজকতা, আর্থিক সংকট। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো এখানেও নিয়মিত হামলা পরিচালনা করছে।
আরবের যেসব দেশে বসন্ত এসেছিল, তার কোনোটিতেই তা স্থায়ী হতে পারেনি। একনায়কতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্র উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার যোগ্য দাবিদার না থাকায় একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। ওই শূন্যতাকে ব্যবহার করেছে উগ্র ইসলামি গোষ্ঠীগুলো।
মিশরে বসন্তের প্রথম লগ্নে ক্ষমতায় আসে মোহম্মদ মুরসির নেতৃত্বে জঙ্গি সংগঠন ‘মুসলিম ব্রাদারহুড।’ কিন্তু তার ফল ভালো হয়নি। মুরসির বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই তীব্র বিরোধিতায় নামে মুবারকের সমর্থকরা এবং ওই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো। ফলস্বরূপ, ২০১৩-এর অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের পেছনে ব্যাপক জনসমর্থন ছিল। ক্ষমতায় এলেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ সিসি। ২০১৪-এ ভোটে জিতে সিসি দেশের প্রেসিডেন্ট হলেও সাধারণ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দিয়েছেন। বিক্ষোভ আর অসন্তোষে জেরবার অবস্থা মিশরের। গাদ্দাফির লিবিয়ায় চলছে গৃহযুদ্ধ। দলে দলে যুবক যোগ দিচ্ছে আইএসআইএস এবং বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীতে।
কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে তরুণদের আবেগে ভেসে ক্ষমতার পরিবর্তন করে যে কোনো লাভ হয় না౼তার প্রমাণ আরবের দেশগুলো। ওই সব দেশে ক্ষমতা দখল করে এমন কিছু মানুষ যাদের প্রশাসনিক দক্ষতা দূরের কথা, কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। গণতন্ত্রের প্রতি দরদ থাকলেও ছিল না কোনো পাল্টা রাজনৈতিক দর্শন। ফলে, যে ব্যাপক শূন্যতা তৈরি হয়, তাতে সক্রিয় হয়ে উঠে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ইসলামি সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলি। হতাশ, বেকার, গরিব ও ধর্মান্ধ যুবকেরা কাতারে কাতারে জঙ্গি দলে নাম লেখায়।
অথচ তিউনিশিয়ায় যখন ‘বসন্ত’ শুরু হয়, তখন আরব দেশগুলোর সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু তা দুই বছরও স্থায়ী হয়নি। লিবিয়া, সিরিয়া বা ইয়েমেনে জনতার হুঙ্কার যে বসন্তের উপস্থিতি ঘোষণা করেছিল, তা আজ লাপাত্তা। ওই তিনটি দেশই এখন গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত, দিশেহারা। বাকি আরব দেশগুলোতে ‘যাহা অতীত তাহাই বর্তমান’। পারিবারিক এবং অভিজাত শ্রেণির শাসনই কায়েম রয়েছে। মরু-বিশ্বে ২০১১-এর সেই লাল টুকটুকে সূর্য অস্তমিত। বসন্ত চলে গেছে!
আমাদের ‘বসন্ত’ আরব-স্টাইলে আসবে, নাকি রাজনীতির নেপথ্য কুশীলবরা ‘সব সঙ্গীত’ ‘ইঙ্গিতে থামিয়ে’ দেবেন, এটা বোঝার জন্য আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।
তবে ‘বসন্ত’ আসুক বা না আসুক, দেশবাসীর কপালে যে অনেক দুর্ভোগ আছে, এটা এখনই বলে দেওয়া যায়!