Published : 28 Aug 2021, 06:03 PM
খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগের কথা। কাহিনীটা ওল্ড টেস্টামেন্টের। দখলদার এফ্রাইম (ইব্রাহিম?) গোষ্ঠীর বাহিনীকে ধাওয়া করে জর্দান নদী পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল জিলেয়াদ (বা গিলেয়াদ) অঞ্চলের অধিবাসীরা। এবার পরাজিত সৈনিকদের মধ্যে শুধু এফ্রাইতিদের হত্যা করার পালা। কিন্তু কী করে বোঝা যাবে, কে এফ্রাইতি আর কে জিলেয়াদি? একটি 'ভাষাতাত্ত্বিক' উপায় বের করা হলো। হিব্রুভাষায় শস্য জিলেয়াদিরা তালব্য 'শ' দিয়ে বলত: 'শিবোলিথ'। পক্ষান্তরে এফ্রাইতিরা একই শব্দ দন্ত্য 'স' দিয়ে উচ্চারণ করত: 'সিবোলিথ'। বন্দিদের শব্দটি উচ্চারণ করতে বলা হলো এবং যাদের গলা দিয়ে 'সিবোলেথ' বের হলো, তাদের গলাটা কেটে দু ফাঁক করে দেওয়া হলো। নররক্তে লাল হয়ে গেল জর্দান নদীর পানি কিংবা জল যাই বলুন।
ফ্রান্সের ফরাসিতে ৭০-কে বলে 'সোয়াসন্ত-দিস' অর্থাৎ ৬০-১০। বেলজিয়ামের ফরাসিতে ৭০-কে বলে 'সেপ্তন্ত'। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কয়েদ হওয়া ফরাসিভাষীদের ষাট থেকে সত্তর পর্যন্ত গুনতে বলা হতো, বোঝার জন্যে, কে ফরাসি আর কে বেলজিয়ান। 'বোঝার' পর অত্যাচারের কী 'বোঝা' তাদের মাথায় চাপল, তা তারা জানে আর জানে নির্যাতনের ইতিহাস।
'জল' এবং 'পানি' দুটিই সংস্কৃত শব্দ। ষোড়শ শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষাব্যবহার অনুসারে যা পান করা হয় তা হচ্ছে 'পানি'। যাতে ম্নান করা হয় সেটা 'জল'। রাধা ও কৃষ্ণ যমুনায় জলবিহার করেন এবং রাধা কলসি নিয়ে 'পানি' আনতে যমুনায় যান। এ অর্থ আধুনিক বাংলায় বদলে গেছে। আমরা এখন 'জলখাবার' এবং 'পান্তাভাত' দুটোই বলি। বাংলাদেশে অনেকে মনে করেন, হিন্দুরা বলে 'জল', মুসলিমরা বলে 'পানি'। কথাটা সত্য নয়, দুই কারণে। ভারতে বাঙালি ছাড়া আর সব হিন্দুই সম্ভবত 'পানি' বলে।
দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই 'পানি' বলে। 'জল' শব্দটা আমি নিজে স্কুলে শিখেছি। ১৯৭১ সালে আট বছর বয়সে কলকাতায় গিয়ে ব্রাহ্মণের ছেলের মুখে 'পানি' শুনে সবার মুখমণ্ডলে যুগপৎ বিস্ময় ও ঘৃণার ভাব ফুটে উঠতে দেখে অবিলম্বে 'জল' বলা শুরু করেছিলাম। যুবক বয়সে, ১৯৯২ সালে ফরিদপুরে দাদাশ্বশুরের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে গিয়ে মুখ দিয়ে স্বভাবদোষে 'পানি' চলে আসাতে (সুখাদ্য দর্শন এবং তেষ্টাপ্রাপ্তি– উভয় কারণে সম্ভবত) সবাইকে 'ফিসাফিসি' করতে শুনেছিলাম: 'ওমা! জামাই ওদের মতো কথা বলে কেন!'
প্রাচীন যুগের ফরেনসিক লিঙ্গুইস্টিক্স বা অপরাধ ভাষাবিজ্ঞানের একটি অ্যাপস বা ডিভাইস হচ্ছে এই 'শিবোলিথ'। এর কাজ বক্তার ভাগ্য নির্ধারণ করার লক্ষ্যে বক্তার ভাষাগোষ্ঠী নির্ধারণ করা। সভ্যতার উন্মেষ থেকেই সম্ভবত শিবোলিথ ব্যবহৃত হয়ে আসছে, কারণ সর্বকালে, সর্বস্থানে জিলেয়াদি এবং এফ্রামির মতো একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল।
গত ঈদে লক্ষ্য করলাম, একদল বাঙালি ফেইসবুকে লিখছে: 'সালাত আদায় করলাম' এবং আরেক দল লিখছে: 'নামাজ পড়লাম'। প্রথম দল সাধারণত বলে 'আল্লাহ হাফেজ' এবং 'সিয়াম', যেখানে দ্বিতীয় দল বলে 'খোদা হাফেজ' এবং 'রোজা'। প্রথম দল 'দাদা' না বলে 'ভাই বলে, যদিও 'দাদা' ফার্সি এবং 'ভাই' সংস্কৃতমূল শব্দ। একটি গোষ্ঠীর পূর্বসূরী মোনায়েম খান গর্বভরে একবার নাকি বলেছিলেন: 'আমরা ডিমকে আন্ডা বলব বলে পাকিস্তান কায়েম করেছি!' মোনায়েম খান ভুল করে 'ডিম' এর পরিবর্তে 'আন্ডা'কে নিজের গোষ্ঠীর শিবোলিথ হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কারণ তিনি জানতেন না যে ডিম আর আন্ডা দুটিই সংস্কৃতমূল শব্দ।
শব্দ, পোশাক, কেশকলাপ ইত্যাদি অনেক কিছুই শিবোলিথ হতে পারে। এবার আরও লক্ষ্য করলাম, প্রথম দল ঈদের দিনে পাঞ্জাবি পরে না বাঙালিদের মতো, আরবিদের মতো জেল্লাবা পরে। দুই দলের দাড়ি রাখার ধরনও এক রকম নয়। এক দলের সদস্যরা ক্লিনশেইভ করে, কিংবা তাদের আছে চাপদাড়ি। অন্য দলের সদস্যরা রেখেছে (আবুল কালাম সামসুদ্দীনের 'দেয়াল' উপন্যাসের সংলাপ) 'গুছি গুছি দাড়ি, মনের সুখে নাড়ি'। এই কেশকলাপ কতটা ইচ্ছাকৃত, কতটা সহজাত, তা অবশ্য জানি না।
রবীন্দ্রনাথও একটি শিবোলিথ। 'যদিও আমার হৃদয় দুয়ার বন্ধ রহেগো প্রভু, দ্বার ভেঙ্গে তুমি এসো মোর প্রাণে! কিংবা 'চরণ ধরিতে দিওগো আমারে, দিও না ফিরায়ে' জাতীয় অসংখ্য একেশ্বরবাদী, আত্মসমর্পণবাদী গীত রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাতে কী যায় আসে? লম্বা দাড়ি ও জোব্বা পরা সত্ত্বেও বিশেষ ধর্মে জন্ম না দেওয়া জনিত ঈশ্বরকৃত প্রমাদ আমৃত্যু সংশোধন না করার অপরাধে শেষ বিচারের দিনে রবীন্দ্রনাথের অবস্থা যে একান্ত কাহিল হবে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠী মোটামুটি নিঃসন্দেহ। মুসলমানপ্রধান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বিধর্মী রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন– এটা মেনে নিতে পারে না এই গোষ্ঠী। পাকিস্তান আমলে তাদের পূর্বসূরিরাই রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিল বেতারে-টেলিভিশনে।
এ একই গোষ্ঠী নজরুলের 'বেদাতি' লেখালেখি অগত্যা সহ্য করে নেহায়েত স্বধর্মের লোক বলে এবং মুসলিমদের মধ্যে একজনও তুল্য প্রতিভাবান নেই বলে। জন্মসূত্রে ভারতীয় নজরুলকে অনেকটা গায়ের জোরে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণার কারণ তার বিশেষ ধর্ম ছাড়া আর কী? এরা বিশ্বাস করে, শ্যামা-সঙ্গীত লেখার অপরাধে সৃষ্টিকর্তার বিচারে নজরুল মাফ পেয়ে যাবেন 'রমজানেরই ঐ রোজার শেষে' কিংবা 'আমি যদি আরব হতাম' ধরনের গানগুলোর জন্যে।
অনেকটাই পরিবারের অমতে, তাড়াহুড়ো করে নজরুলকে কবর দেওয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে, কারণ নজরুল যেহেতু যে বিশেষ গোষ্ঠীর শিবোলিথ, তারা কীভাবে তাদের জাতীয় কবিকে একটি বিজাতীয় দেশে সমাহিত করতে পারে! এ 'সুকর্মে' হালের একাধিক আওয়ামী বুদ্ধিজীবীও সামিল ছিলেন, যারা বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে নজরুলের কবর হতেই হবে, কারণ তিনি লিখেছেন: 'মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই!
নজরুলের আরও অনেক ইচ্ছা ছিল, বহু গানে 'শ্যামা মায়ের চরণতলে' থাকতে চেয়েছেন তিনি, ভগবানের বুকে লাথি মারতে চেয়েছেন, 'সৃষ্টিকর্তার আরশ ছেদ করার' ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কবির এসব ইচ্ছার কথা ধর্মগন্ধী রাজনৈতিক কারণে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। সব্যসাচী ঢাকায় এসে পোঁছানোর আগেই কবর দেবার সব আয়োজন সম্পন্ন দেখে কবিপুত্র এই বলে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন: 'আমাদের অনুমতি নেবারও প্রয়োজন বোধ করলেন না আপনারা!' কী অনুমতি নেবে? অভাগা বাঙালি মুসলিমের হিরো দরকার, হিরো মারা গেলে সে মাজার বানিয়ে জেয়ারত করবে, খাদেম হবে (হুমায়ুন আজাদ একজনকে 'নজরুল মাজারের খাদেম' বলেছিলেন!) হিরো না থাকলে প্রয়োজনে সে আমদানি করবে। গ্যালিলিও নাটকে ব্রেখট লিখেছিলেন: 'দুর্ভাগা সেই জাতি যার বীর সন্তানের প্রয়োজন হয়!'
বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতির পার্থক্যের কথা লিখেছেন- বাংলার ভূমি গঠিত হয়েছে চলিষ্ণু নদীবাহিত নরম পলি দিয়ে, আরব-আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো পাথর আর শুষ্ক-তপ্ত মরুর বালি দিয়ে নয়। পোশাক, খাদ্যসহ জীবনের অন্য সব কিছুর মতো ধর্মাচরণের উপরও ভূগোলের প্রভাব থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মরুর পোশাক-জীবনাচরণ, পারলে ভাষাও বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিতে চায় একটি গোষ্ঠী, কারণ এগুলোকে তারা শিবোলিথ বিবেচনা করে।
আরবি হরফ, উর্দুভাষা ছিল পাকিস্তানের শিবোলিথ, তখনও, এখনও। পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখানোর প্রকল্পে টাকা ঢেলেছিল। বাঙালির ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার অন্যতম অজুহাত ছিল এই যে (হিন্দুস্থানী, সংস্কৃতমূল হওয়া সত্ত্বেও) উর্দু পবিত্র আরবি হরফেও লেখা হয়। বাঙালি মুসলমানের একটা অংশের কাছে বাংলা ভাষা এখনও পর্যন্ত হিন্দুয়ানির শিবোলিথ। সম্প্রতি ঢাকা চিড়িয়াখানায় জন্ম নেওয়া দুই বাঘের বাচ্চার নাম যথাক্রমে 'অবন্তীকা' এবং 'দুর্জয়' রাখার কারণে ফেইসবুকে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, বাঘের বাচ্চার কেন হিন্দু নাম রাখা হলো। হায়, মুর্খতার কোন পর্যায়ে গেলে কারও মনে হতে পারে যে বনের বাঘেরও হিন্দু-মুসলমান আছে।
ইসলামি পোশাক কিংবা খাবার বলে কিছু নেই। আরবি পোশাক, আরবি খাবার আছে বটে। পোশাক-ফ্যাশন যুগে যুগে বদলায়। আজ আরবেরা যে ধরনের পোশাক পরে থাকেন, সেটা ছিল অনেকটাই পারস্য থেকে আমদানি করা ফ্যাশন এবং হজরত ওমর নাকি এই ফ্যাশন পছন্দ করতেন না। হজের সময় যে ধরনের পোশাক পরা হয়, সে ধরনের পোশাক পরার পক্ষপাতী ছিলেন হজরত ওমর।
'আমার পোশাক আমার চয়েস!' ভালো কথা, কিন্তু এখানে দুইটি প্রশ্ন আছে। প্রথমত, শুষ্ক মরুভূমির 'চয়েস' বাংলার আর্দ্র আবহাওয়ার জন্যে কি আদৌ উপযোগী? কত জনের মাথায় টাক পড়ে যাচ্ছে স্রেফ মাথা ঢাকার কারণে। অনেকে অবশ্য টাক পড়ছে বলেও মাথা ঢাকছে। ভারতবর্ষে প্রায় সব জাতিই পাগড়ি-টুপি পরে, কিন্তু ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালিই সম্ভবত একমাত্র জাতি যে কখনও নিজের মাথা ঢাকতে চায়নি। এর পেছনে বাংলার আর্দ্র জলবায়ুর কি কোনোই ভূমিকা নেই? বিশ্বাস এক জিনিস এবং সত্য আরেক জিনিস। মানব ইতিহাসে কোনো বিশ্বাস এ পর্যন্ত কখনও সত্যে পরিণত হয়নি।
দ্বিতীয়ত, বুদ্ধি হবার আগে, শৈশব থেকে যা চাপিয়ে দেওয়া হয় তা কীভাবে ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ হতে পারে? গরুর গায়ে গরম লোহা দিয়ে নম্বর দেওয়া হয়, যাতে গরুকে সহজে খুঁজে পাওয়া যায়। এই উত্তপ্ত ও কষ্টদায়ক নম্বরায়নকে কি কোনভাবেই গরুর নিজের চয়েস বলা যায়? প্রতিটি ধর্ম, প্রতিটি সমাজ ব্যক্তির গায়ে বিশেষ নম্বর দেগে দেয় তার বুদ্ধি হবার আগেই এবং বুদ্ধি হবার পর মুর্খরা সেই দাগানো নম্বরকেই নিজের পরিচয় মনে করে, কারণ তার জন্যে সেটাই সহজতম, অভ্যস্ত আচরণ। জ্ঞান সব সময়েই অভ্যাসের কাছে হেরে যায় বলেই সমাজে মূর্খদের এত রমরমা।
বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠী পীর-মাজার সংস্কৃতির বিরোধী। লালনের মাজারে হামলা করে এরা একবার বাউলদের চুলদাড়ি কামিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গীত-নৃত্য-শিল্পকলা-কবিগানেরও চরম বিরোধী এরা। 'আত্মা' ও 'পরমাত্মা' কিংবা 'আশেক' ও 'মাশুক' কিংবা 'ভক্ত' ও 'ঈশ্বর' সেজে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কবি তর্ক-বিতর্ক করে আসছে আবহমান কাল ধরে। কবির লড়াইয়ের এই সংস্কৃতি ছিল সাধারণ মানুষের জ্ঞানার্জন ও বিনোদনের মাধ্যম। কয়েকজন শিল্পীর বিরুদ্ধে মামলা, হুমকি-ধামকি দিয়ে, প্রশাসনের নিস্পৃহতার সুযোগ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে এই কবিগান প্রায় বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছে একটি গোষ্ঠী।
অন্তর্জালে লক্ষ্য করলাম, কবির লড়াইয়ের শিল্পীরা ইদানিং আধ্যাত্মিক বিষয় বাদ দিয়ে নরনারীর চটুল প্রেমের বিষয় নিয়ে বাহাস করছেন, কারণ পেটতো চালাতে হবে। এর ফলে আর যাই হোক, জাতির মানসিক গঠনের যে উন্নতি হবে না, সে কথা বলা বাহুল্য। অনাহারে, অবহেলায় কবিরা একদিন মরে ফুরিয়ে যাবে। সব কবি মরে গেলে জাতির মনও মরে যাবে। 'মনমরা' (উভয়ার্থে) একটি জাতি আদৌ কি রাষ্ট্রের কাম্য হতে পারে?
হঠাৎ কী এমন হয়েছিল যে সাধারণ কবির লড়াইও ধর্মের জন্যে হুমকি বলে মনে হলো? ভালো কিছু হতে বহু সময় লাগে বটে, কিন্তু খারাপ কিছু, যেমন ধরুন, বন্যা কিংবা ভূমিকম্প হঠাৎ করেই ঘটে যায়। হাজার বছর ধরে শক-হুন-পাঠান-তুর্ক-মোগল সবাই কুচকাওয়াজ করে ভারতবর্ষের দখল নিতে এগিয়ে গেছে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির সামনে দিয়ে। কারও মাথায় আসেনি যে এ মূর্তিটা ভাঙতে হবে। বৌদ্ধ পূর্বপুরুষের সুকীর্তি বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ভাঙ্গার দুর্বুদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ার হাজার বছরের ইতিহাসে কেবল তালেবানেরই হয়েছিল।
দুই হাজার বছর ধরে সিরিয়ার মরুভূমিতে পড়ে থাকা পালমিরার ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের সৌন্দর্য উপভোগ করেছে মানবজাতি। এ অমূল্য ভাস্কর্য-স্থাপত্যকে ভেঙে টুকরা টুকরা করে পাশ্চাত্যে বিক্রি করেছিল আইএস। মূলত ধান্ধাবাজ কিন্তু স্বভাবত মূর্খ ও অজ্ঞান এই গোষ্ঠীগুলো পাশ্চাত্যের ইন্ধনে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে সিদ্ধহস্ত। 'আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান'– বাংলাদেশে পুনরায় এ স্লোগান শোনা যাবার সম্ভাবনার সূচনা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে। সাম্প্রতিক তালেবান বিজয়ের পর অনেকেই নতুন আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে অনেক বাঙালি যুবক আফগানিস্তানে রওয়ানা হয়ে গেছেন বলে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের ভাষ্যে।
সুখের বিষয়, বাংলাদেশে এখনও অবশিষ্ট আছে প্রগতিবাদী একটি গোষ্ঠী, যারা ধর্মের সংকীর্ণ ব্যাখ্যা মানতে রাজি নয়। পূর্বপুরুষদের মতো সুফী-আউল-বাউল-লালন-বিধর্মী সবাইকে নিয়ে সংস্কৃতি ও ধর্মের সাধনা করে সুখে ও শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করার পক্ষে এরা। সব ধর্মের লোক মিলেমিশেও যে থাকা যায়, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর কিংবা মুসলিমপ্রধান মালয়েশিয়ার মতো, এই চাক্ষুস প্রমাণে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ এরা খুঁজে পায় না। ঝামেলা এড়াতে প্রশাসন প্রায়ই প্রগতিবাদীদের পক্ষে থাকে না, কিংবা খোদ প্রশাসনেই হয়তো আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধবাদী লোক গিজগিজ করছে। রিসোর্ট কেলেঙ্কারির পর মৌলবাদী গোষ্ঠীটিকে আপাতত শান্ত বলে মনে হলেও একটি ফরাসি প্রবাদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে: 'ঘুমন্ত জলের চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছুই হতে পারে না।'
শিবোলিথের সঙ্গে রাজনীতি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নিরাপত্তা জড়িত। রাজনীতি কী? কেক ছোট, খানেওয়ালা বেশি। সুতরাং কেকের ভাগীদারকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে পুরো কেকটাই তো আমি বা আমরা খাবো। এমন ধারা চিন্তা প্রকৃতপক্ষে কুসংস্কার বটে, কারণ পাকিস্তান-আফগানিস্তান অঞ্চলে গত শ পাঁচেক বছর ধরে সংখ্যালঘুদের লঘুতম পর্যায়ে নিয়ে আসার পরেও কেক নিয়ে মারামারি থামেনি। কিন্তু ভয়ঙ্করতম নরবানর বা প্রাইমেটগোষ্ঠীটিই নিঃসন্দেহে মানুষের টিকে যাওয়া পূর্বপুরুষ। সুতরাং শিবোলেথের রাজনীতি আরও বহু কাল জারি থাকবে। এফ্রাইমিদের নিশ্চিহ্ন না করেও যে জিলেয়াদিরা সুখে থাকতে পারে– এটা বোঝার জন্যে যে নররক্তপাতের প্রয়োজন হবে, জর্দান, কাবুল কিংবা (বুড়ি)গঙ্গা কোনো নদীই তা ধারণ করতে পারবে না।