ভারতীয় মা ও জামাইকান বাবার সন্তান কমলা হ্যারিস এই মুহূর্তে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্যময় বা কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে আলোচিত প্রতিনিধি। এই পরিচয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বহুবিতর্কিত ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র সামনে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।
Published : 31 Jul 2024, 06:14 PM
পৃথিবী শাসন করা যুক্তরাষ্ট্রের সাদা বাড়িটির মসনদে বসার লড়াই যত ঘনিয়ে আসছে ততই দেশটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ডক্টর স্কাইয়ের বলা কিছু কথা যেন আরও বেশি বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে আমার কাছে।
কিছুদিন আগেই আমি ও আমার ক্লাসের তিন বন্ধু মিলে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিবাসন নিয়ে আলোচনার বিষয় ও ধরণ নিয়ে একটি গবেষণা সেরেছি। সামাজিক মাধ্যম এত বড় দেশের সব মানুষের সামগ্রিক মনোভাব নিয়ে ধারণা না দিলেও, একটা বিষয় নিয়ে মানুষের গড় মনস্তত্ত্বের বেশ ভালো ধারণা দিতে পারে। সেই গবেষণা করতে গিয়ে এখানকার অধিবাসীদের সামাজিক মাধ্যমের লেখালেখিতে একটা জাতিগত সূক্ষ্ম ভেদরেখা দেখতে পেয়েছি। রাজনৈতিক সমর্থনের বেলাও এই কথা সত্য। ডেমোক্রেটিক কিংবা রিপাবলিকান সমর্থক হওয়া এখানে অনেকটা বাংলাদেশে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার ফুটবল সমর্থক হওয়ার মতো। সমর্থনের ব্যাপারটা এখানে বেশ জমজমাট। তবে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মতো মারদাঙ্গা নয়।
এখানকার অধিবাসী আমেরিকানরা যেমন ভাবেন তাদের একজন নেতা প্রয়োজন যিনি তাদের ‘আমেরিকানিজম’কে আরও দূর এগিয়ে নেবেন, তেমনি যারা অভিবাসী কিংবা দ্বিতীয় প্রজন্মের আমেরিকান তারা মনে করেন আমেরিকাকে বৈশ্বিক কাতারে সেরাদের সেরা বানানোর পেছনে তাদের পূর্বপুরুষ থেকে শুরু করে তাদের আছে সমান সমান অবদান। তাই নেতা হতে হবে এমন যিনি সবার কথা সমানভাবে ভাববেন।
সেই গবেষণাটি যেদিন শেষ হয় সেদিন আমার আমেরিকান অধ্যাপক ডক্টর স্কাই কুলি আমাদের এক খাবার দোকানে লাঞ্চে নিয়ে গেলেন। পলিটিক্যাল কমিউনিকেশনের গবেষক তিনি। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন আইরিশ। সেদিন কফি খেতে খেতে কী ভেবে যেন আমি তাকে বললাম, “আমি পিএইচডি করতে ইউরোপে চলে যেতে চাই। সেখানকার পরিবেশ আমার কাছে বেশি সংস্কৃতিমনস্ক আর প্রগতিশীল মনে হয়।”
স্কাই কুলি সেদিন আমাকে বলেছিলেন, “মার্কিন রাজনৈতিক দৃশ্যপট গভীরভাবে বিভক্ত। জাতিগত বিষয়গুলো এখনও বিতর্কিত, তবে এই দেশ চলে আইনের শাসনে, ফলে এখানে সুযোগ সবার সমান।”
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তার রানিংমেট হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন আইনের শাসনে চলা যুক্তরাষ্ট্রের এই বিভক্ত রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই যেখানে এই সময়ে জাতি ও লিঙ্গের বিষয়গুলো জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে সেখানে একজন বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ও নারী হিসেবে কমলা হ্যারিসের এই মনোনয়ন যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্যনির্ভর, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সমাজের বৃহত্তর রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যেমন চ্যালেঞ্জিং তেমনি আবার সুযোগও বটে।
ভারতীয় মা ও জামাইকান বাবার সন্তান কমলা হ্যারিস এই মুহূর্তে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্যময় বা কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে আলোচিত প্রতিনিধি। এই পরিচয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বহুবিতর্কিত ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র সামনে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। প্রমাণ আমরা সাম্প্রতিক সময়ে হ্যারিসের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের মাঝেই দেখেছি। তবে তার কর্মজীবন, জেলা অ্যাটর্নি, ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল এবং মার্কিন সেনেটর হিসেবে তার ভূমিকা, যুক্তরাষ্ট্র পরিচালনার প্রশ্নে তাকে আইনি ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় যেমন শক্তি দেবে তেমনিভাবে তার এই জাতিগত পরিচয় হিলারি ক্লিনটনের পর আরেকজন নারী হিসেবে আবারও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগও এনে দেবে।
হ্যারিসে সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো বিশাল। ঐতিহাসিকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ রাজনৈতিক পদগুলোতে নারীদের পদায়ন কিংবা উঠে আসার ক্ষেত্রে ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের পরাজয়, নারী প্রার্থীরা যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উচ্চপদে আসীনের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হন এবং সর্বোচ্চ সমর্থন পান না তার একটি সুস্পষ্ট স্মারক।
লেডি ক্লিনটনের নির্বাচনি প্রচারণার সময়ের দিকে খানিকটা পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রচণ্ড লিঙ্গভিত্তিক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যা তার নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছিল। কমলাকেও এমন একটি রাজনৈতিক দৃশ্যপটের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যেখানে তার প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু তার নারী পরিচয়টিই নয় একইসঙ্গে তার কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় জাতিসত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্লেষণ করা হবে, করা হচ্ছেও।
লিঙ্গ মার্কিন রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে এখনও রয়ে গেছে। ২০২২ সালে ‘পলিটিক্যাল বিহেভিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, নারী প্রার্থীরা প্রায়ই তাদের পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেক বেশি মান যাচাই এবং নিবিড় নিরীক্ষণের সম্মুখীন হন। তাদের নীতি এবং দক্ষতার পাশাপাশি তাদের চেহারা, আচরণ এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিচার করা হয়।
প্রভাব আছে গণমাধ্যমে প্রার্থীকে উপস্থাপনের ভঙ্গিও। বাংলাদেশের মতো নাজুক গণতন্ত্রের দেশগুলোতে নির্বাচনে গণমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক না হয়ে উঠতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে নির্বাচনের প্রার্থীদেরকে গণমাধ্যম যেভাবে উপস্থাপন করে তা ভোটারদের সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে গণমাধ্যমে প্রার্থীর প্রতি লিঙ্গগত পক্ষপাত জনসাধারণের ধারণাকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্বের ২৫ হাজার রাজনীতিবিদের উপর ৭৫ হাজার সংবাদ নিয়ে করা ৯০ টি গবেষণার উপর করা একটি রিভিউ আর্টিকেল ২০২০ সালে প্রকাশিত জার্নাল অব কমিউনিকেশনে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, রাজনীতিতে নারীরা পুরুষদের তুলনায় কম মিডিয়া কভারেজ পান এবং তারা যে কভারেজ পান তা প্রায়ই তাদের নীতি বা সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তে তাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলোতে বেশি মনোনিবেশ করা হয়। এই পক্ষপাত ভোটার মনোভাবকে প্রভাবিত করতে পারে, যা নারীদের জন্য নির্বাচন জেতার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন গড়ে তোলা আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।
তার কর্মজীবনের সময়, কমলা বারবার এমন নিরীক্ষণের মুখোমুখি হয়েছেন। সমালোচকরা প্রায়ই তার কঠোরতা এবং নেতৃত্বের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় আরও কঠোরভাবে করা হয়। নারী পরিচয়ের এই চ্যালেঞ্জটিকে আরও জমাট করে তুলতে পারে হ্যারিসের জাতিগত পরিচয়। বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকা দেশটিতে একজন কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণের নারী হিসেবে, তিনি এমন একটি জনসংখ্যাকে প্রতিনিধিত্ব করেন যারা মার্কিন রাজনীতিতে ঐতিহাসিকভাবেই কম প্রতিনিধিত্ব করেছে। নির্বাচনের টিকিটে তার উপস্থিতি একদিকে যেমন তার মধ্যে নিজেদের জাতিগত পরিচয় খুঁজে পাওয়া ভোটারদের উজ্জীবিত করবে অন্যদিকে তাকে বর্ণবৈষম্যপূর্ণ আক্রমণের সামনেও ফেলবে, ফেলছেও।
কর্মজীবনের সময়ও কমলা বর্ণবাদী এবং যৌনবাদী বক্তব্যের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন, যা তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রার্থিতা ঘোষণার পরও অব্যাহত রয়েছে। আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপালন করা কমলা হ্যারিস ডেমোক্র্যাট পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পথে সমর্থন দৃঢ় করার পর থেকেই তার ওপর এই আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠেছে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সমর্থকদের দ্বারা হ্যারিসের প্রতি বেশ কিছু বর্ণবাদী এবং লিঙ্গ বৈষম্যমূলক আক্রমণ করা হয়েছে। ট্রাম্প কমলাকে ‘পাগল’, ‘উন্মাদ’ এবং ‘পাথরের মতো নির্বোধ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও, রিপাবলিকান কংগ্রেসের সদস্যরা তাকে ‘বৈচিত্র্যের জন্য ধরে আনা একজন’ বলে উপহাস করেছেন।
এই ধরনের আক্রমণ শুধুমাত্র কমলাকেই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে নারীদের এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘস্থায়ী বর্ণবাদী এবং যৌনবাদী মনোভাব প্রকাশ করে। ট্রাম্পের উস্কানিমূলক বক্তব্য এই বিভক্ত সমাজে বর্ণবাদে বিশ্বাসী লোকদের আরও উৎসাহিত করতে পারে এবং এর ফলে হ্যারিসের বিরুদ্ধে আরও বর্ণবাদী এবং লিঙ্গ বৈষম্যমূলক মন্তব্যের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
অবশ্য এতে কমলা হ্যারিসের ভোটের বাক্স ভারীও হয়ে উঠতে পারে। এরই মাঝে ট্রাম্পের মিত্ররা সতর্ক করেছেন যে, এই ধরনের মন্তব্য এবং আক্রমণ কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের কাছে ট্রাম্পের পৌঁছানোর চেষ্টা ব্যাহত করবে, যাদের ভোট ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
রিপাবলিকান মেইন স্ট্রিট ককাসের চেয়ারম্যান ডাস্টি জনসন এবং অন্যান্য রিপাবলিকান নেতারা বলেছেন যে, কমলা হ্যারিসের কাজের জন্য তার বিরোধিতা করা উচিত, ব্যক্তিগত আক্রমণ করা উচিত নয়। তারা উল্লেখ করেছেন যে, এই ধরনের ব্যক্তিগত আক্রমণ দেশের জন্যও অসম্মানজনক এবং এর ফলে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। হ্যারিসের মিত্ররা আরও বলেছেন যে এই ধরনের অবমাননাকর মন্তব্য রিপাবলিকান পার্টির সমন্বিত প্রচেষ্টাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে এবং ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ভাটার টান লাগাতে পারে।
জনমত জরিপের তথ্য অনুসারে কমলঅ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে প্রতিযোগিতামূলক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। সাম্প্রতিক সমীক্ষা তাকে নিউ হ্যাম্পশায়ারে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ছয় পয়েন্টে এগিয়ে রেখেছে। রয়টার্স/ইপসোসের নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৩ শতাংশ নিবন্ধিত ভোটার কমলাকে সমর্থন করছেন, যেখানে ৪২ শতাংশ ভোটার ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন। জরিপটি ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত অনলাইনে পরিচালিত হয় এবং এতে ১,০২৫ জন নিবন্ধিত ভোটার অংশ নেন। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, প্রবল প্রতিযোগিতামূলক রাজ্যগুলোতে তার প্রচারণার ফোকাস ইতিবাচক ফলাফল দিচ্ছে। তার উপর, কমলঅ হ্যারিসের তহবিল সংগ্রহের প্রচেষ্টাও চিত্তাকর্ষক হয়েছে, তার প্রচারণা মাত্র তিন দিনে ১২৬ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে।
তবে, জনসাধারণের অনুমোদনের এই জরিপ আদতে একটি মিশ্র চিত্র উপস্থাপন করে। সুইং ভোটারদের তিনি কতটা টানতে পারবেন তা নির্ভর করবে তার প্রচারণা ও ঘোষণা করা নীতিগুলোর উপর।
কমলা হ্যারিস আমেরিকার প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তাকে সুযোগে পরিণত করতে হবে তাকে। কমলা যদি তার নির্বাচনি প্রচারণায় বর্তমান আমেরিকার সমস্যা সমাধানের জন্য তার নীতি ও প্রস্তাবনাগুলোর দিকে মনোনিবেশ করেন এবং আরও আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আমেরিকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন, তবে তিনি বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হবেন। তাকে এমন একটি বার্তা দিতে হবে যা শুধু তার দলের গোড়া সমর্থকদের জন্য নয়, বরং সুইং ভোটার এবং তার মত বৈচিত্র্যপূর্ণ বর্ণের সবার জন্য আকর্ষণীয় হবে। যা লিঙ্গ ও বর্ণ পরিচয়ের কারণে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি, সেটিকে কাটিয়ে উঠতে এবং নির্বাচনে জয়ের দৌঁড়ে এগিয়ে রাখবে।
বর্তমান বাস্তবতায় তাই তার এই নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয়ের চ্যালেঞ্জ কমলা হ্যারিস উতরাতে চাইবেন সামাজিক ন্যায়বিচার, ফৌজদারি বিচার সংস্কার এবং অভিবাসনের নীতি নিয়ে তার অবস্থানকে নির্বাচনি প্রচারণার প্রধান এজেন্ডা করে। একজন আইনজ্ঞ হিসেবেও তিনি যেমন শক্তি পাবেন তা আবার তাকে বিরোধের মুখেও ফেলবে। কেউ কেউ তার অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করেন, আবার কেউ কেউ তাকে অপরাধ বিচার ইস্যুতে যথেষ্ট প্রগতিশীল না হওয়ার জন্য সমালোচনা করেন।
একটা উদাহরণ প্রায়ই সামনে আসছে যে, কমলা যখন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন, তখন তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেননি। তিনি মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রয়োগে কোনো বাধা দেননি, যা প্রগতিশীলদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই ধারণাগুলোর ভারসাম্য বজায় রাখা তার প্রচারণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
পরিচয় রাজনীতির বাইরে, কমলঅ উল্লেখযোগ্য নীতিগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হতে যাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক উত্তেজনা নিয়ে লড়াই করছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে, হ্যারিস এই বিষয়গুলোর সমাধানে জড়িত ছিলেন, তবে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসাবে, তাকে এসব বিষয় নিয়ে তার নীতি কী হতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট করতে হবে। তার প্রচারণায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া এবং জলবায়ু নিয়ে পদক্ষেপের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি প্রজনন অধিকার রক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ মোকাবেলার কথাও রয়েছে । এই বিষগুলোর আমেরিকান সমাজে ভোটারদের যেমন ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে তেমনি মেরুকরণও করতে পারে। গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে কমলার শক্ত অবস্থান একদিকে তার সমর্থক বাড়াতে পারে, আবার অন্যদিকে বিরোধীদের সক্রিয় হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। এই বিভাজনমূলক বিষয়গুলো পরিচালনা করার জন্য একটি কৌশলগত পদ্ধতি কমলা হ্যারিসকে নিতে হবে।
হিলারি ক্লিনটনের ২০১৬ সালের প্রচারণার সঙ্গে তুলনা করে কমলা কিছু সমস্যা চিহ্নিত করতে পারেন এবং সেগুলো এড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। হিলারি ক্লিনটনের পরাজয়ের পেছনে বিভিন্ন কারণ দায়ী ছিল, যার মধ্যে তার ইমেইল কেলেঙ্কারি, তাকে অভিজাত গোষ্ঠীর একজন হিসেবে চিহ্নিত করা এবং নির্বাচনকালীন অপতথ্য অনেক বেশি আলোচিত হয়। কমলা হ্যারিসকেও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, যেখানে মিথ্যা তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেখানে অপতথ্যের এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে হবে।
হিলারির অভিজ্ঞতা থেকে এটা বোঝা যায় যে, মাঠের খেলায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে কমলাকে, ভোটারদের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ করতে হবে।
কমলা হ্যারিসের প্রচারণা ইতিমধ্যেই এই দিকে পদক্ষেপ নিয়েছে, তারা মাঠপর্যায়ে যোগাযোগ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার উপর দৃষ্টি দিচ্ছে। তবে, তাকে অবশ্যই তার বার্তাটি স্পষ্ট এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, ভোটারদের মেরুকরণ করে ফেলতে পারে এমন অনেক জটিল নীতিগত প্রস্তাবগুলো এড়াতে হবে।