ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে ভালো করলেও কমলা তার একমাত্র পরিচয় দাঁড় করাতে পেরেছেন একজন ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে। তার নির্বাচনি অভিযানের মূল বার্তা প্রেসিডেন্ট হলে তিনি কী কী করবেন তা নয়, বরং ট্রাম্প কী কী ক্ষতি করবেন ওইসব।
Published : 03 Nov 2024, 05:58 PM
এবারের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি নানাদিক থেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি নির্বাচনেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা দাবি করেন তাকে নির্বাচিত করা ঐতিহাসিক প্রয়োজন। কিন্তু এবার বিশ্লেষকদের মতেও কমলা-ট্রাম্পের নির্বাচনি যুদ্ধটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ট্রাম্পের জয় এবার তাকে লাগামহীন হওয়ার প্রেরণা যোগাবে। তার হিটলার-প্রেম আর কেবল কথার মাঝে না, কাজেও প্রতিফলিত হতে পারে। একইসঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা ও একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত টালমাটাল বিশ্বপরিস্থিতির আশঙ্কা, বিশ্বজুড়ে ধর্মান্ধ রাজনীতি ছড়িয়ে পড়া ও ধর্মীয় আন্তঃসংঘাতের ও রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি আরও খারাপ রূপ নেবে তার বিজয়ে। আর ট্রাম্পের জয়কে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি তার পরাজয়েও মার্কিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ মোড় নিতে পারে তার সমর্থকদের গোঁয়ার্তুমির কারণে।
কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা তাদের করণীয় কাজগুলো করতে এখনো অনিচ্ছুক। বিশেষত কমলা হ্যারিস নিজেই নিজেকে আটকে রেখেছেন। কমলা যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন তবে তিনি অনেক দিক থেকে প্রথম হওয়ার রেকর্ড করবেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তো অবশ্যই। যা হিলারির কপালে জোটার শতভাগ কথা থাকলেও জোটেনি তার অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে। ২০১৬ সালে যে পচা শামুকে পা কেটে হিলারি মারাত্মক জখম হয়েছেন, ওই শামুক এখন ধারালো ছুরির মতো। কমলা লড়ছেন বহুভাবে প্রমাণিত এক দুষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে। তবে দুষ্ট শক্তি হিসেবে ট্রাম্পের এই পরিচয়ই তার জয়ের মূলধন হতে পারে। আর কমলার বিপদ তার আদর্শিক পরিচয়ের অভাব। যদিও এই আটকে থাকা ও পরিচয়ের অভাবকে তিনি নির্বাচনি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ট্রাম্পের একটি শক্তি হচ্ছে তার স্পষ্ট পরিচয়— কট্টর ডানপন্থী হিসেবে। কমলার এমন কোনো উল্লেখযোগ্য পরিচয় নেই, সম্ভাব্য অশ্বেতাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট ছাড়া। ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারিও যেমন পলিসি বা নীতিমালা প্রশ্নে নিজস্ব কোনো পরিচয় দাঁড় করাতে পারেননি, একমাত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের স্ত্রী ও ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিচয়টুকু ছাড়া, যদিও কারিশমার তার কমতি ছিল না। ওবামা তো হিলারির নির্বাচনি প্রচারণায় নিজের চেয়েও হিলারিকে অধিকতর যোগ্য বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তবু ভরাডুবি থেকে রক্ষা করতে পারেননি।
আর বর্তমানে কমলার যে পরিচয়টি তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তা হলো ‘জেনোসাইড জো’ অর্থাৎ গণহত্যাপন্থী বাইডেনের সহযোগী। ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে ভালো করলেও কমলা তার একমাত্র পরিচয় দাঁড় করাতে পেরেছেন একজন ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে। তার নির্বাচনি অভিযানের মূল বার্তা প্রেসিডেন্ট হলে তিনি কী কী করবেন তা নয়, বরং ট্রাম্প কী কী ক্ষতি করবেন ওইসব। পুরো বার্তা স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক। যে একমাত্র গুণের কথা সমগ্র ডেমোক্র্যাটরা বলছেন তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ট্রাম্পের দুর্যোগময় শাসনের বিপদ থেকে রক্ষা পাবে যদি তারা কমলাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে।
হ্যারিস সমর্থকদের নির্বাচনি স্লোগান “আমরা পেছনে ফিরে যাচ্ছি না”— তাও ট্রাম্পকেন্দ্রিক, অর্থাৎ তারা আর ট্রাম্পযুগে ফিরে যাবেন না। কিন্তু কমলাযুগ কী? কমলা নিজেও জানেন না। এ নির্বাচনি কৌশল খুব ভালো খাটত যদি ট্রাম্প করোনা, ঘূর্ণিঝড় বা এরকম ভয়ানক কোনো দুর্যোগ হতো। সেক্ষেত্রে অমুক দুর্যোগ থেকে কেবল কমলাই যুক্তরাষ্ট্রকে বাঁচাতে পারার দাবি হালে পানি পেত। কিন্তু ট্রাম্প কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, তিনি আরও বড় দুর্যোগ ও কমলার প্রতিদ্বন্দ্বী। ট্রাম্পের হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ কমলাকে ভোট দেবে না, কারণ ভোটাররা এভাবে হিসাব করে না। কিন্তু কমলা হ্যারিসের সমস্ত প্রচারণাই হচ্ছে ট্রাম্পকে আমেরিকার জন্য একটা দুর্যোগ হিসবে উপস্থাপন করা।
গত ২৩ অক্টোবর ট্রাম্পকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলেছেন কমলা। সন্দেহ নেই যে ট্রাম্প তাই। কিন্তু এই অভিধা কেবল ট্রাম্পবিরোধীদের জন্যই আকর্ষণীয়। যারা ইতোমধ্যে ট্রাম্প-অনুসারী তাদের ওপর এটি কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না। এই লেবেল উদারনৈতিকদের চোখে যতই অসম্মানের হোক না কেন, ট্রাম্প ক্যাম্পে চিড় ধরাবে না। সুতরাং কমলার জয়েও তেমন সহায়ক হবে না। দেখা যাচ্ছে কমলার নির্বাচনি অভিযানকে তা বারবারই ট্রাম্পের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিচ্ছে।
তবে ট্রাম্পের বড় দুর্বলতাও হচ্ছে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তার আসল রূপ। কমলা যেমন বিতর্ক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ট্রাম্পকে নিয়ে বিশ্বনেতারা হাসাহাসি করত— সত্য। তার সমর্থকদেরকে উসকে দিয়ে ২০২১-এর ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটাল হিলে কংগ্রেস অধিবেশনে হামলা চালানো আরেক ন্যক্কারজনক ঘটনা যেখানে মারা গিয়েছে ৯ জন মানুষ আর আহত হয়েছে ১৫০ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। এবার প্রেসিডেন্ট হতে পারলে এসব অপরাধের দায় থেকে সে বাঁচতে পারবে।
গত কয়েক বারের মতোই এবারও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন হবে মূলত দুই মন্দের মাঝে কম মন্দকে বাছাই করার। সেদিক থেকে কমলা হ্যারিসই যে কম মন্দ এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর ফিলিস্তিনে চালানো লাগামহীন ইসরায়েলি গণহত্যার কালে কম মন্দ হ্যারিস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। কেননা ফ্যাসিস্ট ট্রাম্প ২০১৬-এর তুলনায় ২০২৪-এ আরও বেশি বিপজ্জনক। ভালো কোনো শক্তির অভাবে কমলা হ্যারিসের জয়ই কাঙ্ক্ষিত। দুই মন্দকে অনেক মানুষ প্রায় এক করে দেখলেও, এবার তেমনটা ভাবা ভুল হবে।
জয়ের কৌশল হিসেবে কমলা যা করছেন তা হলো তার রং লুকানো। বাইডেন যা করছেন তার বাইরে তিনি একচুল আগাতেও নারাজ।আর তাই মনে করা হচ্ছে বাইডেনের গণহত্যাপন্থী পররাষ্ট্রনীতি কমলারও। ভরসা কেবল একটাই— নির্বাচনে জিতলে হয়তো তিনি স্বাধীন পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস ও শক্তি পাবেন। বার্নি স্যান্ডার্স ভরসা করছেন তাতেই। তার আবেদন তাই কমলাকে ভোট দেওয়ার। খ্যাতিমান সাংবাদিক মেহেদি হাসানও তাই মনে করছেন। কারণ কমলা জিতলে আশা থাকবে অন্তত, ট্রাম্প জিতলে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মান্ধ রাষ্ট্রের পথে হাঁটতে শুরু করবে। সবচেয়ে বেশি লাভ হবে ইসরায়েলি যুদ্ধবাজ উন্মাদদের।
তবে কমলার জয় ও ট্রাম্পের পরাজয়ে বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতির অতি সামান্য হেরফের হবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া ট্রাম্পের উত্থানকে কেবল একটি সাময়িক ঘটনা মনে করেন না। তার মতে ট্রাম্পের শক্তি আরও গভীরে নিহিত, ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশে যার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। কট্টর ডানপন্থী, সাম্প্রদায়িক, গোষ্ঠিবাদী, ধর্মব্যবহারকারী শক্তির উত্থান হয়েছে বহু দেশে। যে পথে হাঁটছে ভারত, ওই পথে ট্রাম্পের রাজনীতিও। নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে যে পথে আগেই চলে গেছে ইসরায়েল। আর তাই ট্রাম্পের পরাজয় মানেই গণতন্ত্রের বিজয় নয়, ডেমোক্র্যাটদের হলেও। ট্রাম্প-রাজনীতি তখনও থাকবে, আমেরিকায় এবং অন্যান্য দেশেও।
এরপরও ফিলিস্তিনে পরিচালিত ইসরায়েলি গণহত্যা যে দুটো ভয়ঙ্কর আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে— এক) ফিলিস্তিনি জনগণকে হত্যা করে হলেও চিরতরে তাদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করা বা দাসে পরিণত করা, দুই) তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি— তা থেকে রক্ষা হতে পারে ডেমোক্র্যাটদের জয়ে, কারণ এই দলে এখনো বার্নি স্যান্ডার্স, আলেক্সান্দিয়া ওকাশিয়ো-কোর্তেজ, রশিদা তালিব, ইলহান ওমর, কোরি বুশ প্রমুখ আছেন। যদিও কমলার রং কী কেউ জানে না, নির্বাচিত হলে তিনি তার বর্তমান বস জোনোসাইড জোয়ের পথই অনুসরণ করবেন নাকি ইসরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন তা জানে না কেউ, তবু তার ওপরই ভরসা করছেন অনেকেই।
অবশ্য ট্রাম্পের জয়েও শাপে বর হতে পারে। বিশ্বের সামনে সে নিজেকে ও তার দেশকে যেমন হাসির পাত্রে পরিণত করবে— কিম জং উনের সঙ্গে প্রেমপত্র বিনিময়, মোদীর সঙ্গে বন্ধুত্ব, নেতানিয়াহুর সঙ্গে কোলাকুলি, পুতিনের সঙ্গে মাখামাখি ইত্যাদির মাধ্যমে— যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যকে দুর্বল ও খেলো করে তুলবে, অন্য কেউ তা পারবে না। তার নির্বাচনি বিজয়ে এটাই হতে পারে মন্দের ভালো।