Published : 05 Jun 2020, 11:46 AM
বিশ্বে শিল্প বিপ্লবের শেষ প্রান্তে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটিতে পৌঁছেছিল। শিল্প বিপ্লব মানুষের উৎপাদন শক্তি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেল যাতে করে মাত্র ১৭০ বছরের মধ্যে ২০০০ সালে সে সংখ্যা ৬০০ কোটি অতিক্রম করে। আর এখন প্রতি ১১ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা ১০০ কোটি করে বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই রকেট গতির সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের জীবন ধারণের প্রয়োজনে প্রকৃতির উপর চাপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। তদুপরি এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের সাথে সাথে যোগ হয়েছে বিলাসী জীবন। মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় বিলাস দ্রব্যের উৎপাদন জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। কৃষি থেকে শিল্প বিপ্লব মানুষের চাহিদাকে সীমাহীন করে তুলেছে। সবকিছুর যোগান পেতে নির্ভরতা বাড়ছে প্রকৃতির ওপর আর এতেই প্রকৃতির ভাণ্ডার শূন্য হয়ে পড়ছে। প্রকৃতি বিরূপ হচ্ছে, প্রকৃতির রুদ্ররূপ প্রকাশ পাচ্ছে।
মানুষ তার অন্তহীন ক্ষুধা নিবারণে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রকৃতির মালিক বিবেচনায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সবুজ বিপ্লব, গোলাপী বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলার সময় সে প্রকৃতিকে অস্বীকার করেছে বা ভাবনার মধ্যেই রাখেনি। বিশাল জনগোষ্ঠীর অন্নসংস্থানের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। আবাসভূমি গড়ে তুলতে কৃষিযোগ্য জমি ব্যবহার হয়েছে। বনভুমি ধ্বংস হয়েছে জলাভুমি ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। বিলাসী জীবনের জন্য নগর থেকে মহানগর এবং কলকারখানা স্থাপন করতে হয়েছে। মানুষ তার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য পেছনে ফিরে তাকায়নি। আজও মানুষের ছুটে চলার গতি কমেনি। অতৃপ্ত মানুষ দিনে দিনে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়েছে। মানুষের অসীম সৃজনশীলতা তাকে দায়বদ্ধ না করায় সে গন্তব্য নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকৃতি হয়েছে রুষ্ট।
মানুষের চরিত্রের ষড়রিপুর মধ্যে অন্যতম দুটি হচ্ছে লোভ আর মোহ। এই দুটি রিপু মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের চরিত্র সৃষ্টি করে। মানুষ তখন নিজের বিলাসী জীবন উপভোগ ছাড়া আর কিছু বুঝতে চায় না। উপরন্তু বিজ্ঞান মানুষকে পারিপার্শ্বিকতার উপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিলাসী জীবনের একটা বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এই মানুষেরা নিজেদের যত বেশি ক্ষমতাবান ভাবেন তারা তার চাইতে অনেক বেশি অতৃপ্ত। নিজেকে তৃপ্ত করার জন্য মানুষ তাই পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের ভয়াবহ পরিস্থিতি একটা সময় পর্যন্ত মানুষের অনুমানে থাকলেও আজ আর তা মানুষের অনুমান নয়। যত দিন যাচ্ছে অনুমান বাস্তবে রূপ নিয়ে মানুষের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এতে খুব উপকার হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। মানুষ এখনো নিজের বিলাসী জীবনযাপনে ছাড় দিতে রাজী নয়।
মানুষের সীমাহীন বিলাসী জীবনের লোভ নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার ফলে দ্রুতলয়ে পৃথিবীর কৃষিব্যবস্থা উৎপাদনশীল জমি হারাচ্ছে। জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক চক্র ধ্বংস হচ্ছে। বৈচিত্র্যময় জলবায়ুতে প্রভাব পড়ছে, সুপেয় পানি ও বিশুদ্ধ বায়ুপ্রাপ্তি বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। একটার পর একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘাড়ের ওপর চেপে বসছে। একদিকে বৃষ্টির অভাবে মরুকরণ দেখা যাচ্ছে, বিপরীত দিকে বন্যায় ভেসে যাচ্ছে লোকালয়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে উষ্ণায়ন ঘটছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে, মূল ভূখণ্ড ডুবে যাচ্ছে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রকোপে মানুষের রোগ-বালাই বাড়ছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাস্তুহারা হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে মানবকুল।
মানুষ একটার পর একটা যুগকে পার করেছে আর নিজেকে ব্যক্তিস্বার্থের মধ্যে সীমিত করেছে। বহুজনের কল্যাণের মধ্যে নিজের কল্যাণ তা সে ভুলেই গিয়েছে। মূলত কৃষির আবিষ্কারের পর থেকেই ধীরে ধীরে মানুষ অন্যের উৎপাদিত সামগ্রীতে ভাগ বসানো শুরু করে। আগে গাছপালা প্রাকৃতিক নিয়মেই জন্মাতো এবং অরণ্যচারী মানুষ তা থেকেই নিজের ক্ষুধা নিবারণ করে জীবনধারণ করত। বন্য পশু শিকার করে খাবারের চাহিদা মেটাত। কৃষিকাজ শেখার পর মানুষ যত্ন করে গাছ লাগাতে শুরু করে। এতে করে জমির মালিকানা নিশ্চিত করার প্রয়োজন পড়ে, ফসল রক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। ফলে মানুষের কাজ বেড়ে যায়, অবসর কমে আসে। এখান থেকেই শুরু মানুষের ব্যক্তিচিন্তা। ক্রমে ক্রমে সামাজিক বিবর্তনে বৈষম্যের বিকাশ ঘটে। বিলাসী জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষা মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। মানবিক গুণ হারিয়ে মানুষ অমানবিক হয়ে যায়। অমানবিক মানুষের কার্যক্রমে আজ বিশ্ব পরিবেশ হুমকির মুখে।
১৯৬২ সালে র্যাচেল ভারসন পরিবেশের বিপদ সম্পর্কে পৃথিবীকে সতর্ক করেছেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে মানুষ পরিবেশ সচেতন হতে শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এ ভাবনা মানুষের অবসরের কাজ হিসেবে বিবেচিত ছিল। একপর্যায়ে মানুষকে তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সচেতনতা সৃষ্টির কাজ শুরু হয়। বিশ্বের সর্বত্র পরিবেশকে ভালো রাখার জন্য পরিবেশবাদী মানুষের আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কিছু দেশের অসহযোগিতায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন আজও সোনার হরিণ হয়েই আছে। বিলাসী জীবন থেকে এরা সরে আসতে চায় না। তাই নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েও তা মানতে চায় না, অনেক শর্ত আরোপ করে। অর্থনৈতিক সামর্থ্য, রাজনৈতিক শক্তি, বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতার জোরে ক্ষমতাধর দেশগুলো প্রকৃতিকে অস্বীকার করলেও প্রকৃতি বৈষম্যহীন। তাই সবার জনই আজ তার সমান রুদ্ররূপ।
প্রকৃতি বৈষম্যহীন না হলে কি হবে তার রুদ্ররূপ কিছু কিছু দেশের জন্য মারাত্মক ভয়ংকর। আমাদের বাংলাদেশ ঘনবসতির কারণে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টিতে ন্যূনতম ভুমিকা রেখেও ক্ষতিগ্রস্থের তালিকায় উপরের দিকেই আছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের বর্তমান ধারা অব্যহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের ১৭৭ শতাংশ ভূমি পানির নিচে চলে যাবে। ফলে এই এলাকার মানুষেরা তাদের বাসস্থান হারাবে, জীবিকা হারাবে, সামাজিক নিরাপত্তা হারাবে। কৃষক প্রান্তিক থেকে যেমন ভুমিহীন হবে, ঠিক তেমনি মানুষ দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হয়ে বস্তিবাসী হবে। মানবেতর জীবন যাপন করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখনই কৃষি, মৎস সম্পদ ও প্রাণী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, সংক্রামক রোগ বাড়ছে, শ্রমিকের কর্মশক্তি কমে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের চরিত্র পরিবর্তনের ফলে একজায়গায় বন্যার দেখা দিলে পাশেই খরার ফলে মরুকরণের লক্ষণ ফুটে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের ওপর পরিবেশের ঝুঁকি মোকাবেলায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সুপারিশ অনুসরণ করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের তাপমাত্রর বার্ষিক গড় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে পারে। যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। আর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে অতিরিক্ত যে এক থেকে দেড় সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়বে তাতে ক্ষতি সামাল দেয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না।
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন লিখেছেন "মনে হচ্ছে আদিম যুগে ফিরে গেছি। এখন না আছে কাজ কাম, কেবল খাওয়া ঘুমানো আর গুহায় থাকা! সবজি আনাটা মনে হচ্ছে শিকারে যাওয়া।" অন্য একজনের উক্তি "নিন ঘুমিয়ে পড়ুন, কাল সকালে উঠেই তো আবার হাড়ভাঙ্গা বিশ্রাম করতে হবে"। ব্যঙ্গোক্তি হলেও সারাবিশ্বকে মহামারীরূপী করোনাভাইরাস আজ এই অবস্থার কাছেই নিয়ে গিয়েছে। শিকারী যুগে শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ ছিল। প্রতিদিন মানুষ কয়েক ঘন্টা পরিশ্রম করে যে খাদ্য সংগ্রহ করত তা সবাই ভাগ করে খেয়ে ফেলত, খাদ্য মজুদ করার যেমন চিন্তা ছিল না, ঠিক তেমনি অন্যের উৎপাদিত খাদ্যে ভাগ বসানোর মতো পরজীবী মনোভাবও মানুষের ছিল না। করোনাভাইরাস মানুষকে অনেকটা সেই পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ব পরিবেশে দুষণমুক্তির সুবাতাস বইছে। জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমার ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ গ্রিন হাউজ গ্যাস উদগীরণ কমে গিয়েছে। লকডাউনের কারণে শব্দদূষণ-বায়ুদূষণ কমেছে। জীববৈচিত্র্যের বিচরণ ক্ষেত্রে নির্মল হয়েছে। সার্বিক পরিবেশের উপর করোনাভাইরাসের কারণে যেসব প্রভাব পড়েছে তা পরিবেশবিদদের জন্য আনন্দের সংবাদ কিনা জানি না তবে বিশ্ববাসীর দায়িত্ব ও কর্তব্য এই পরিবর্তিত পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেয়া। যারা পরিবেশকে অশান্ত করেছে তারা পরিবেশকে শান্ত রাখতে নিজেদের বিলাসী জীবনের একটা সীমা নির্ধারণ করবে এটাই কাম্য।