Published : 05 Feb 2020, 09:00 PM
দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে যারা খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের কাছে রাজধানী ঢাকার দু'টি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অনাকাক্ষিত-অভাবনীয় কিছুই ঘটেনি। যা হবার কথা ছিল, তাই হয়েছে। অর্থাৎ শাসক দল আওয়ামী লিগের প্রার্থীরা জয়লাভ করাটা যেমন নিশ্চিত ছিল, আর নির্বাচনে খুব অল্প মানুষের ভোট দেওয়াটাও অভাবনীয় ছিল না। এই নির্বাচনে খুব কমসংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছে। নির্বাচন কশিনের হিসেবেই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ভোট পড়েছে ২৫.৩% এবং দক্ষিণে ২৯%। এটা খুব সম্ভবত একটা রেকর্ড। এটা ব্যতিক্রমী ঘটনাও বটে। কেননা অতীতে কোনো নির্বাচনেই এত সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে ভোটগ্রহণ হয়নি। অতীতের নির্বাচনগুলোতে উপস্থিত না হলেও নির্বাচন কমিশন ভোটার উপস্থিতি অনেক বাড়িয়ে দেখিয়েছেন। এবার অন্তত তেমনটা দেখা যায়নি। অনেকে অবশ্য এবারের সিটি নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতির হিসেব নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, ১২-১৫%-এর বেশি ভোটার এবার ভোটকেন্দ্রে যায়নি। নির্বাচন কমিশন সত্যিই কারসাজি করে ভোটার সংখ্যা ২৯% দেখিয়েছেন কিনা সেটা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। কেননা এমন অভিযোগের পক্ষে কেউ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
এই প্রথম ঢাকার সর্বত্র ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। সেই দিক থেকে এই নির্বাচনে অনিয়ম হওয়ার আশঙ্কা কম ছিল। তারপরও অভিযোগ এসেছে। যতটুকু যা ভোট হয়েছে, সেখানেও বিস্তর ত্রুটি-বিচ্যুতি-অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। ভোট দিতে এসে অনেককে ফিরে যেতে হয়েছে, এমন অভিযোগ মিলেছে। কারও অভিযোগ বুথে ঢোকার আগেই বলা হয়েছে, তাদের ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছে। অনেকের আবার আঙুলের ছাপ বা নাগরিক কার্ডের নম্বর না-মেলায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হাতের ছাপই যন্ত্রের সঙ্গে মেলেনি। প্রায় আধ ঘণ্টার চেষ্টার পরে তিনি জাতীয় পরিচয় পত্রের নম্বর মিলিয়ে তিনি ভোট দিতে পেরেছেন। কোথাও আবার নজরদারির মধ্যে ভোট দিতে হয়েছে, এমন অভিযোগ মিলেছে। কোনও কোনও বুথে নির্বাচনকর্মী বা শাসক দলের কর্মীরা ভোটারদের সহযোগিতা করার নামে এই নজরদারি করেছে। অনেক কেন্দ্রে সাহায্যের নামে ভোট অন্যরা দিয়ে দিয়েছেন।
এবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে সবেচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে কম ভোটারের উপস্থিতির বিষয়টি। বেশিরভাগ বিশ্লেষকের মত হচ্ছে, একটার পর একটা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠার পরে মানুষ ভোটদানে আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের ধারণা হয়েছে, ফলাফল আগেই নির্ধারণ করে রাখায় সাধারণ মানুষের ভোটদান অর্থহীন।
আসলে গত কয়েকটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে রয়েছে মানুষের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। অনেকে ভোট কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেন না। অনেকে কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। অনেকে আবার ভোট দেওয়ার পর ফলাফল দেখে হতাশ হন। আর ভোটের আগের রাতে 'ব্যালট বাক্স-ভর্তি' করতে দেখার অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই।
শহরের নাগরিকদের অনেকে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আস্থা হারিয়েছেন। প্রার্থীরা কেউই ঠিক মতো কাজ করেন না। ভোটের আগে এক রকম কথা বলেন, প্রতিশ্রুতি দেন। ভোটের পর ভিন্ন বক্তব্য, ভিন্ন চেহারা। প্রার্থীরা কেউই কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেন না। ফলে ভোট দেবার আগ্রহ সাধারণ ভোটারের মধ্যে ক্রমেই কমছে।
এর সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের 'দখল' করার নীতি। তাদের কর্মীসমর্থকরা নির্বাচন এলে আদাজল খেয়ে মাঠে নামেন। তারা ভোটকেন্দ্র, ভোটের লাইন, কেন্দ্রের বাইরে মহড়া দেয়া সব কিছুতে এগিয়ে। তাদের সংখ্যা ও দাপটের কাছে প্রতিপক্ষের সমর্থকরা কুঁকড়ে থাকেন। অনেকে ভয়ে সমর্থিত দল বা পছন্দের প্রার্থীর ব্যাজ পর্যন্ত খুলে ফেলেন। কারণ সেধে মার খেতে, অপমানিত হতে কারুরই ভালো লাগার কথা নয়। তাছাড়া এখনকার রাজনৈতিক কর্মীরাও 'চালাক' বনে গেছেন। তারাও বুঝে গেছেন, আপনি বাঁচলে বাপের নাম!
আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে সব সুবিধা তাদের অনুকূলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের ঘাটাতে সাহস পান না। নির্বাচন পরিচালনা কর্মকর্তারাও 'হাওয়া' অনুযায়ী 'দায়িত্ব' পালন করেন। এ যুগে কে আর বাহুল্য ঝামেলা পোহাতে চায়? তা ছাড়া নীতিনিষ্ঠতা বা দায়িত্বশীলতার জন্য দেশে কোনো পুরষ্কার নেই। বরং আছে হয়রানি ও অপমান। সেধে অপমানিত হওয়ার মতো আহাম্মক দেশে খুব কম আছে।
তাই বলে ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক শক্তিকেও খাটো করে দেখা যাবে না। পাশাপাশি রয়েছে টাকার জোর, ক্ষমতার জোর। টাকার জোরে তারা অনেক কর্মীসমর্থককে কাজে লাগাতে পারেন। ভোটের আগে-পরে তারা দলের জন্য দাপটের সঙ্গে কাজ করেন। তারা অন্যায় করলেও কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। দলের লোকেরা তাদের প্রটেকশন দেন। ক্ষমতাসীনদের বাইরে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা এখন কেউই নিজ এলাকায় তেমন একটা সক্রিও বা সোচ্চার নয়। নানারকম হয়রানি-জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে তারা গা-বাঁচিয়ে চলার নীতি গ্রহণ করছেন। তারা কর্মীদের পেছনে যথেষ্ট টাকাও ঢালেন না। কর্মীদের বিপদে-আপদে তেমন কোনো ধরনের সহযোগিতাও করেন না। ফলে কর্মীরাও এখন আর কোনো ঝুঁকি নেন না। পরিস্থিতি 'অনুকূল' মনে হলে বড় জোর মিছিল কিংবা সমাবেশে যোগ দেন। কিন্তু মার-পিট কিংবা হয়রানির আশঙ্কা থাকলে তারাও নিরাপদে বসে বসে ফেসবুক চালান। বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখন এই সূত্র মেনেই রাজনীতি করছেন।
তাছাড়া মানুষ এখন আর আগের মতো ভাবাবেগ দ্বারা চালিত হন না। আগে কর্মীসমর্থকরা দলের জন্য, নেতার জন্য যেকোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতেন। অনেকে জেল-জুলুম-হুলিয়া এমনকি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতেন দলের স্বার্থে, প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে। এখন আর কেউ এমন বেহুদা আবেগে চালিত হন না। এখন যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শের খুব একটা ফারাক নেই, কাজেই কর্মীরাও নিজেদের মনটাকে 'পরিবর্তিত পরিস্থিতি'র জন্য তৈরি করে নিয়েছেন। তারা এখন নিজেদের স্বার্থ আর সুবিধার জন্য সরকারি দলের প্রতি সহজেই আনুগত্য স্বীকার করে নিচ্ছেন। 'বাস্তববুদ্ধি' তাদের শিখিয়েছে, সরকারি দলের সমর্থক হলে বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করা যায়। বিরোধী দলে নাম লেখালে নানা রকম ঝামেলা পোহাতে হয়। প্রতিপক্ষ কিংবা পুলিশের কোপানলে পড়ার আশঙ্কা থাকে। বৈধ কোনো কিছু প্রাপ্তিও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তারচেয়ে সরকারি দলের সঙ্গে থাকলে সুবিধা তো মিলেই, অন্তত তেমন কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় না।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকাও তেমন ইতিবাচক নয়। এই দলটি কখনও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-রাজাকারের সমার্থক হয়ে, কখনও পেট্রোলবোমার রাজনীতিতে জড়িয়ে, আবার কখনও দুর্নীতি ও গ্রেনেড হামলার দায়ে দণ্ডিত আসামী লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারেক রহমানের আদেশনির্দেশ অনুযায়ী চলে সচেতন মানুষের আস্থা হারিয়েছে। যারা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত, তারাও বিএনপিকে নিজেদের ঠিকানা মনে করেন না। বিএনপি গত দুই দশকে সেই আস্থার জায়গাটি হারিয়েছে। অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থানও আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে হতাশ বিপন্ন মানুষরা কেবলই রাজনীতির প্রতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে। নির্বাচনকে দেশের অনেক মানুষই এখন তামাশা মনে করে। তারা ধরেই নিয়েছেন যে, ভোট দিতে না গেলেও কেউ না কেউ বিজয়ী হবে, আর বিজয়ী হয়ে সে তার নিজের মতোই শাসন-শোষণ-লুণ্ঠন-দুর্নীতি ইত্যাদি করবে। এসবের ফাঁকে ফাঁকে 'লোক-দেখানো' কিছু উন্নয়ন কাজও হবে। সে চাইলেও হবে, না চাইলেও হবে। কাজেই কী লাভ ভোট দিয়ে?
পুনশ্চ: বিএনপির অনেক নেতা এখনও 'ভোট বিপ্লবের' স্বপ্ন দেখেন। 'বিপ্লব' এমনি এমনি হয় না। 'বিপ্লবের' পথে জনগণকে চালিত করতে হয়। নিজেকে মাঠে থেকে নেতৃত্ব দিতে হয়। যারা 'করে-কম্মে খাচ্ছেন', তারা সহজে 'বিপ্লব' হতে দেবেন, নিজেদের চামড়া দিয়ে অন্যদের ডুগডুগি বাজানোর সুযোগ করে দেবেন, এমনটা ভাবা আহাম্মকের ভাবনা। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে, ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখতে চাইবে, 'সাহায্যের নামে' কোনো ভোটারের ভোট নৌকা মার্কায় দিয়ে দেবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা ঠোকানোর জন্য বিএনপি কী করেছে? ঢাকা শহরে তাদের কতজন কর্মীকে তারা ভোটকেন্দ্রে নিতে পেরেছে?
আমি কিছুই করব না; প্রতিপক্ষকে মাঠ দখলের সুযোগ করে দেব, আর জনগণ আমার হয়ে 'ভোট বিপ্লব' করে দেবে, বিএনপির নেতারা কী এতই পূণ্যবান? দেশের জন্য কী তাদের অবদান? দলের জন্যই বা তারা কে কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন?
গা-বাচিয়ে চলা সুবিধাদাবাদী বিএনপি নেতারা তাই ক্রমেই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। তারা যদি জনগণের পক্ষে না দাঁড়ান, সুবিধাবাদিতা ঝেড়ে ফেলে ত্যাগস্বীকারের পথে না হাঁটেন, নিজেদের অতীতের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা না চান, তাহলে আওয়ামী লীগ শত 'অপরাধ' করেও পার পেয়ে যাবে। মানুষ বাঘের খপ্পর থেকে রেহাই পেতে কখনও সিংহের পিঠে সওয়ার হতে চাইবে না!