Published : 26 Sep 2019, 07:50 PM
গত ২২শে অগাস্টদ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসন শুরুর সব প্রস্তুতি ভেস্তে যাওয়া এবং সঙ্কটের দ্বিতীয়বছর র্পূর্তিতে শরণার্থী শিবিরে বিশাল সমাবেশের পর থেকে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে হঠাৎকরেই যেন জনমানসে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছে। ক্ষোভটা আগে ছিল স্থানীয় পর্যায়ে।
রোহিঙ্গারা যখনদলে দলে সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসছিল তখন মানবিকতা এবং মুসলিম ভাতৃত্ববোধস্থানীয় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিরজটিল গতি প্রকৃতি সম্পর্কে কোন দেশের জনগণেরই সাধারণত গভীর ধারণা থাকে না। স্থানীয়রাসহঅনেকেই ভেবেছিলেন, এ আগমনটা সাময়িক। কিন্তু বাস্তবে দেখাগেল, দুই বছর পার হয়ে গেলেও রোহিঙ্গারা ফিরে তো যায়ই নাই, বরংমাঝে মাঝে সীমানা অতিক্রম করে আরো অনেকে এসেছে।
এ পর্যন্ত কী পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। আনুমানিক হিসেবে ২০১৭ সালে সেনা অভিযান থেকে বাঁচতে সেসময় সাত লাখ ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সব মিলিয়ে এখন কমপক্ষে ১২ লাখের মত রোহিঙ্গা বিভিন্ন ক্যাম্পে বাস করছে বলে ধরে নেয়া হয়। ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে এর সাথে যোগ হয়েছে আরো ৪০ হাজার নবজাতক। উখিয়া এবং টেকনাফে মূল জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০ শতাংশ এখন রোহিঙ্গা। আজকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।
জাতিগত নিপীড়ণেরশিকার হয়ে দুই বছর আগে যখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসা শুরু করে, তখন তা আওয়ামীলীগের সরকারকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। জিয়াউর রহমানের সময় থেকে আসতেথাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে ততদিনে কয়েক লাখে পৌঁছে গেছে।
বিএনপি, জামায়াতের মত মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং 'ইসলামপন্থার' রাজনীতিতে বিশ্বাসী দলগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবার এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখে। তারা ধরে নিয়েছিল, এমনিতেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গাদের ভারে ভারাক্রান্ত দেশে আওয়ামী লীগ সরকার কোনভাবেই রোহিঙ্গাদের জন্য সীমানা উনুক্ত করে দিবে না। এতে তারা বলতে পারবেন, আওয়ামী লীগ সরকার ইসলাম এবং মুসলিম বিদ্বেষী। সামাজিক যোগযোগের মাধ্যমগুলিতে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তাদের সমর্থকরা এ প্রচারণা শুরু করেও দিয়েছিলেন।
অপরদিকে, সীমানাখুলে দেওয়া ছাড়া সরকারের সামনে আর কোন বিকল্পও ছিল না। সীমানা না খুললে এক করুণমানবিক পরিস্থিতির উদ্ভব হত, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দুইভাবেই সরকারের এক নেতিবাচকভাবমূর্তিকে তুলে ধরত। পাশাপাশি, মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং 'ইসলামপন্থী' দলগুলি জনমতেরবড় অংশকে সরকারের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে সমর্থ হত। ফলে, সরকারের সীমানা খুলে দেবারনীতি রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া বিএনপি, জামায়াতকে হতাশ করে—একটানিশ্চিত ইস্যু তাদের হাতছাড়া হয়ে যেতে দেখে।
সীমানা খুলেদেওয়া হলেও আগত লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভবিষ্যতে কী করা হবে, অথবা কীভাবেই বাতাদের ফেরত পাঠানো হবে, এ ধরণের কোন পরিকল্পনা সরকারের সামনে ছিল না। সেসময় তাদেরএকটাই লক্ষ্য ছিল সেটা হল রোহিঙ্গা ইস্যুতে জনমত যাতে তাদের বিপক্ষে চলে না যায়।
রোহিঙ্গাদেরপ্রবেশ করতে দিলেও সরকার তাদের আজ পর্যন্ত শরণার্থীর মর্যাদা দেয়নি। ফলে, এ বিপুলজনগোষ্ঠী মৌলিক নাগরিক সুবিধা হতে বঞ্চিত, যা মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবা পাশ্চাত্যে অভিবাসী, সংখ্যালঘু বা শরণার্থী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেখলেডান, বামসহ আমাদের দেশের যাদেরকে সোচ্চার হতে দেখা যায়, সেই তারাই শুরু থেকে রোহিঙ্গাদেরমৌলিক মানবাধিকারের বিষয়ে বিস্ময়করভাবে নিরব রয়েছেন।
জাতিগত নিপীড়ণের শিকার হয়ে অন্য একটি দেশে আসা জনগোষ্ঠী যতক্ষণ না তাদের নিজ দেশেফিরে যেতে পারছে, ততক্ষণ তারা সেই দেশটিতে শরণার্থী মর্যাদার দাবি রাখে। এ বিষয়টি বাংলাদেশেরসিভিল সোসাইটির অ্যাক্টিভিস্টসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ওয়াকিবহাল কিনা, সেটিই একটি দ্ব্যর্থবোধকপ্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা টেকনাফ, উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অনেকটা বন্দি জীবন যাপনকরছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী জাপানিজ আমেরিকানদের সে দেশেরবিভিন্ন ক্যাম্পে যেভাবে আটকে রাখা হয়েছিল, তাদেরকে রাখা হয়েছে অনেকটা সেরকমভাবে; যদিও,সে সমস্ত ক্যাম্পের সুযোগ-সুবিধা রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলি থেকে অনেক বেশি ছিল।
সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গাদেরক্যাম্প থেকে বাইরে বের হওয়া নিষেধ। চাকরি, ব্যবসা বা কোন প্রকার কাজ করবার অধিকারতাদের নেই। মোবাইল এবং ইন্টারনেটের সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। এ অসহায়ত্ব বোধ অনেকরোহিঙ্গাকে মরীয়া করে তুলছে যেকোন ভাবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট বা জাতিয় পরিচয়পত্র পেতে।
চিকিৎসার সুবিধাতাদের জন্য অত্যন্ত সীমিত। রেজিস্টার্ড ক্যাম্পগুলিতে কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসাথাকলেও রেজিস্ট্রেশনবিহীন ক্যাম্পগুলিতে সে সুবিধাও নেই। ক্যাম্পে নারীদের অবস্থা আরোশোচনীয়। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকবার লড়াইয়ে অনেক নারীকে বাধ্য হয়ে খুঁজে নিতে হচ্ছে যৌনবৃত্তি।তদুপরি, গত দুই বছরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে একজননারীসহ নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৫ জন রোহিঙ্গা।
যেকোন রাষ্ট্রেযেভাবেই একজন ব্যক্তি অবস্থান করুক না কেন, শিক্ষা তার মৌলিক অধিকারের একটি। রোহিঙ্গাদেরমধ্যে শিক্ষার হার এমনিতেই কম। তার উপর রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে নারী শিক্ষার প্রতিএ যুগে এসেও তাদের রয়েছে প্রবল অনীহা। একশ বছর আগে বাঙালি মুসলমান সমাজেও আমরা এরকমরক্ষণশীলতা এবং নারী শিক্ষার প্রতি অনীহা প্রত্যক্ষ করেছি।
এরকম রক্ষণশীলতা উপেক্ষা করে, ক্যাম্পের প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও একটি রোহিঙ্গা মেয়ে যখন কক্সবাজারের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পর্যায়ের ছাত্রী হিসেবে পড়াশোনা শুরু করে, বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়া একে ইতিবাচক সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করে। কিন্তু এ সংবাদটি প্রকাশিত হবার পর তার ছাত্রত্বই স্থগিত করে দেয়া হয়।
সিভিল সোসাইটিরঅ্যাক্টিভিস্ট এবং মানবাধিকার কর্মীরা বিস্ময়করভাবে এখানেও নিরব থাকেন। এর চেয়েও বিস্ময়করহল, শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নয়, এমনকি প্রিন্ট, এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও রোহিঙ্গাদেরএমন মানবেতর জীবন যাপনকে, স্বর্গে বসাবাসের সাথে তুলনা করে অনেকের বক্তব্য দিতে শুরুকরা।
একথা ঠিক যে, সামাজিকনানা সূচকে অনেক অগ্রগতি হলেও, দেশের জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করবার মত একটা অংশ রোহিঙ্গাদেরচেয়েও খারাপ অবস্থায় জীবন যাপন করেন।বাস্তবতা হল মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জিডিপির উচ্চপ্রবৃদ্ধি ইত্যাদি সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের জীবন মানের মানদণ্ডে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশেরনিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র শ্রেণি চরমতম মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। ফলে, রোহিঙ্গারাযখন ক্যাম্পগুলিতে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং বেসরকারী সংস্থাগুলির সহায়তায় অবস্থান করছেন,সেটা অনেকের মাঝেই ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তারা ভাবতে শুরু করেছেন, তাদেরকে বঞ্চিত করেইরোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, টেকনাফ এবং উখিয়াতে গত দুই বছরে সাত/আটজনবাঙালি রোহিঙ্গাদের হাতে খুন হবার ফলে, একটা শীতল দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে রোহিঙ্গাদেরসাথে স্থানীয়দের।
রোহিঙ্গারা যখনমিয়ানমারে ছিলেন তখন তারা নিজেরা যেমন একদিকে মূলধারার সাথে একাত্ম হতে চাননি; অপরদিকে,মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীও চেষ্টা করেছে কোন অবস্থায় তারা যাতে মূলস্রোতের সাথে মিশে যেতেনা পারেন। এ বিছিন্নতাবোধ তাদেরকে আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার সাথে পরিচয় ঘটবারসুযোগ দেয়নি। ফলে, জাতিগত নিপীড়ণের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে 'ইসলামপন্থা'ররাজনীতিকে ভিত্তি করে। কেননা, জন্মসূত্রে প্রাপ্ত একমাত্র ইসলামের সাথেই প্রায় সব রোহিঙ্গাপরিচিত।
প্রতিরোধের অংশহিসেবে ইসলাম ধর্মকে ভিত্তি করে তারা গড়ে তুলেছেন আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি(আরসা) নামক সশস্ত্র সংগঠন, যার প্রায় সাড়ে তিন হাজার সদস্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেরয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে তারা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে কঠোরইসলামি আইন চালুর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলিতে সক্রিয় রয়েছে সামাজিকঅপরাধের সাথে যুক্ত নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
বামপন্থা, সেকুলার জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি রোহিঙ্গাদের কাছে অপরিচিত শব্দ। ফলে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা অধিক সংসক্তি বোধ করছেন 'ইসলামপন্থী' দল এবং 'ইসলামভিত্তিক' এনজিওগুলির সাথে। এ বিষয়টা বাংলাদেশের 'ইসলামপন্থী' দল এবং তাদের সাথে সম্পর্কিত এনজিওগুলিকে একটি বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। প্যান ইসলামিজমের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা যেমন একদিকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে চায়; তেমনি, তারা এটাও চায়, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে অবস্থান করুক। এটি সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে তাদেরকে রাজনীতিতে একটা বাড়তি সুবিধা দিবে বলে তারা মনে করছেন। এর পাশাপাশি কিছু ছোট এনজিও- যাদের প্রাপ্ত ডোনেশনের একটা বড় অংশ নির্ভর করে রোহিঙ্গাদের মাঝে তাদের কার্যক্রমের উপর- তারাও রোহিঙ্গারা সহসা প্রত্যাবর্তন করুক, এ বিষয়টি চাচ্ছে না।
এসব কিছুর সাথেপ্রত্যাবাসনের আগে রোহিঙ্গাদের কিছু দাবি- যেমন নাগরিত্ব প্রদান, জমি-জমা ও ভিটেমাটিরদখল ফেরত, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, রাখাইনে তাদের সঙ্গে যা হয়েছে, সেজন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানইত্যাদি যুক্ত হবার ফলে- বাংলাদেশের অনেকের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে তারা বোধহয় আর ফিরেযেতে চাচ্ছেন না। আর এ ধারণা থেকেই ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট এবং সামাজিক মিডিয়াতে কিছুবুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকসহ এক শ্রেণির মানুষকে দেখা গেছে নাৎসিদের মত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেজাতিবিদ্বেষমূলক বক্তব্য নিয়ে সরব হতে।
এ সমস্ত মিডিয়াতেপুরো রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠীকে 'বিষফোঁড়া', 'বিষবৃক্ষ' ইত্যাদি নানা নেতিবাচক অভিধায়অভিহিত করে এরা যে মননগতভাবে নাৎসি বা মিয়ানমার সরকারের মত একই জাতি বিদ্বেষমূলক মননকেধারণ করেন- এ অনভিপ্রেত বিষয়টি সবার সামনে স্পষ্ট করেছেন। এসব বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্যহল রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে জনমানসে ভীতির সঞ্চার করে আপামর জনগণকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেখেপিয়ে তোলা।
ভীতির সঞ্চার রোহিঙ্গাক্যাম্পগুলোতেও হয়েছে। তাদের মধ্যে নানাবিধ ভয় কাজ করছে। তারা একদিকে যেমন ভয় পাচ্ছেবাংলাদেশ সরকার তাদেরকে প্রত্যাবাসনে বাধ্য করে কিনা, তেমনি অপরদিকে ভয় পাচ্ছে- তাদেরকেযদি বাধ্য হয়ে ফিরে যেতেই হয়, তাহলে মিয়ানমারে গিয়ে তারা আবার নতুন কি ধরণের নিপীড়ণেরমুখোমুখি হবেন, এ বিষয়টিও। পাশাপাশি এ বিষয়টা তারা বুঝতে পারছেন যে, স্থানীয় জনগণেরক্ষোভের ফলে ইতিমধ্যে তারা অনাহুত অতিথিতে পরিণত হয়েছেন।
যে বিষয়টা প্রথম থেকেই বাংলাদেশ সরকারসহ অনেকেই বুঝতে পারেননি সেটা হল- নাৎসিদের মত জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা শুন্য করবার প্রকল্প হাতে নিয়েই রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে এমন ভাবে বিতাড়ণ করা হয়েছে, যাতে তারা আর প্রত্যাবর্তন করতে না পারে। এরই প্রক্রিয়া হিসেবে মিয়ানমারে অবস্থানরত ৬ লাখ রোহিঙ্গার উপর নতুন করে নিপীড়ণ শুরু হয়েছে যাতে তাদেরকেও বাংলাদেশ বা ভারতে ঠেলে দেয়া যায়।
বাংলাদেশ এ মুহূর্তেনতুন করে আরো ৬ লাখ রোহিঙ্গা সীমানা অতিক্রম করে প্রবেশ করে কিনা এ ঝুঁকিতে রয়েছে।পাশাপাশি, আসামের নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া ১৫ লাখ ভারতীয় নাগরিককে জোরপূর্বক বাংলাদেশেপাঠিয়ে দেবার কথা সেখানকার শাসক দল বিজেপির নেতারা প্রকাশ্যেই বলছেন।
১৫ লাখ ভারতীয় নাগরিকেরব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার নির্ভর করে আছে ভারতীয় সরকারের 'শুভ ইচ্ছা'র উপর। অর্থাৎ,ভারতীয় সরকার দয়া করে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেবে না, এ আশার উপর। কিন্তু যদি রোহিঙ্গাদেরমত তাদেরও ঠেলে দেয়, তাহলে বাংলাদেশে সরকারের করণীয় কী হবে, নীতিনির্ধাকদের কেউই সেটানিয়ে ভাবতে রাজি নন। 'বন্ধু' দেশের 'শুভ ইচ্ছা'-ই এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিরএকমাত্র ভরসা।
রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেবাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেন্দ্রিক। বাংলাদেশেরবিদেশ নীতি এখনো পরিচালিত হচ্ছে শীতল যুদ্ধোত্তর আমেরিকা-কেন্দ্রিক, এক বিশ্ব ব্যবস্থাকেমাথায় রেখে। চীনের উত্থান এবং রাশিয়ার পুনুরুত্থান যে বিশ্ব রাজনীতির বাস্তবতা বদলেদিয়েছে, সেটা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে অর্থে এখনো উপলব্ধি করতে পারেনি।
রোহিঙ্গা সমস্যানিয়ে তাদের দৌড়ঝাঁপ মূলত পশ্চিম ইউরোপ আর আমেরিকামুখী। আর ইউরোপ এবং আমেরিকা দুই পক্ষইএকে জাতিগত সমস্যার চেয়ে ধর্মগত সমস্যা হিসেবে দেখতে আগ্রহী। ফলে তাদের মিডিয়াতে রোহিঙ্গাশব্দটির সাথে সব সময় মুসলিম শব্দটি জুড়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের 'রোহিঙ্গা মুসলিম' হিসেবেঅভিহিত করা হয়; যদিও এ জাতিগোষ্ঠীর ১ শতাংশ হিন্দু এবং বৌদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রএবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখানে তাদের চিরাচরিত ইসলাম কার্ড খেলে মিয়ানমারকে চাপে রাখবারকৌশল নিতে আগ্রহী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রএবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দৌড়াচ্ছেন আসিয়ান এবংদক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে। কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারছেন না যে, এদের কারোরই মিয়ানমারকেপ্রভাবিত করবার ক্ষমতা নাই।
মিয়ানমার সরকারকেপ্রভাবিত করবার ক্ষমতা রাখে একমাত্র গণচীন। এরপর যে রাষ্ট্রটির প্রভাব মিয়ানমারের উপররয়েছে সেটি হল রাশিয়া। সামরিক, অর্থনৈতিক সবভাবেই মিয়ানমার গণচীনের উপর নির্ভরশীল।অপরদিকে, চীনের তরফ থেকে এ সম্পর্কটা মূলত স্ট্রাটেজিক। পুরো এশিয়াতে চীনের নির্ভরযোগ্যতিন মিত্র হচ্ছে উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার এবং পাকিস্তান।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়থেকে বাণিজ্যিক, সামরিক সব দিক থেকে বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটালেওএবং সম্প্রতি বিপুল চীনা বিনিয়োগ হলেও চীন বাংলাদেশকে তার স্ট্রাটেজিক পার্টনার হিসেবেদেখে না।
অপরদিকে, দক্ষিণএবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভিয়েতনাম এবং ভারতের পরেই রাশিয়া মিয়ানমারকে তার মিত্র মনেকরে। সম্প্রতি সামরিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে রাশিয়া মিয়ানমারে তার উপস্থিতি বাড়ালেও,রাশিয়াও চীনের মত মিয়ানমারকে দেখে স্ট্রাটেজিক পার্টনার হিসেবে।
রাশিয়া এবং চীনকোন ভাবেই চায় না যে, মিয়ানমারে তাদের প্রভাব হ্রাস পাক বা দেশটি মার্কিন বলয়ে চলেযাক। দুটি দেশের কাছেই মিয়ানমারের গুরুত্ব বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। ফলে, রোহিঙ্গা ইস্যুতেজাতিসংঘসহ সমস্ত আন্তর্জাতিক ফোরামে এ দুটি দেশ মিয়ানমারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে আসছে।পাশাপাশি, তার কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়ে মিয়ানমার ভারত, এমনকি ঘনিষ্ঠ মার্কিন মিত্র ইসরায়েলএবং জাপানের সমর্থনও আদায় করতে পেরেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ কূটনীতিক অর্জন এ ক্ষেত্রেএকেবারে শূন্য।
আজকে চরম বাস্তবতাহচ্ছে, রোহিঙ্গা সমস্যা তখনই সমাধান হবে যদি কেবল চীন এবং রাশিয়া মনে করে তাদের মিয়ানমারেফিরে যাওয়া উচিৎ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনীতিক সফলতার পুরোটাই নির্ভর করছেকতটা দক্ষতার সাথে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকার চীন এবং রাশিয়াকে বোঝাতে পারে,তার উপর। কিন্তু চীন এবং রাশিয়া যদি মিয়ানমার সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে তাদের বাংলাদেশেথেকে যাওয়াই উচিৎ বলে মনে করে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাবার কোন সম্ভাবনানেই।আর এ ফিরে যাবার সম্ভাবনা যত বিলম্বিত হবে, বাঙালিদেরসাথে রোহিঙ্গাদের দ্বন্দ্ব তত বৃদ্ধি পাবে, যা এক সময় দাঙ্গায় রূপ নিলে অবাক হবার কিছুথাকবে না।