Published : 16 Sep 2019, 04:10 PM
[পূর্বকথা: হিন্দুস্তানের বদমেজাজিবাদশাহ শাহরিয়ার তাঁর এক বেগমের পরকীয়ার কারণে পুরো স্ত্রীজাতির উপর যারপরনাই নারাজহয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করবেন এবং ভোরহলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতল করাবেন। কয়েক বৎসর ধরে শত শত যুবতী কন্যা বেঘোরে ইন্তেকালফরমালে বাদশার প্রধান উজিরের জ্যেষ্ঠা কন্যা ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী শেহেরজাদি নারীজাতিরপ্রতি করুণাপরবশ হয়ে ছোটবোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লাপূর্বক স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিকাহকরেন বাদশা শাহরিয়ারকে। জীবনের আখেরি রাতে নববধূর আবদার রাখতে বাদশার আদেশে বাসরঘরেডেকে আনা হয় শ্যালিকা দিনারজাদিকে। গভীর রাতে পূর্বপরিকল্পনামাফিক দিনারজাদি বাংলাদেশেরএকেকটি সমস্যা নিয়ে সওয়াল পুছতে থাকেন আর শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না সেই সব সওয়ালের জওয়াবদিতে শুরু করেন, কিন্তু ভোরের আজান শোনা মাত্র শেহেরজাদি কথা বলা বন্ধ করে দেন এবংনকশি লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন দুই বোন। বাদশা ধীরে ধীরে জ্ঞানপিপাসু হয়ে উঠছেন, শুনছেনমন দিয়ে দুই বোনের সওয়াল-জওয়াব, যার ফলশ্রুতিতে পর পর নয় দিন ধরে বার বার শেহেরজাদিরমৃত্যুদণ্ড বাতিল হয়েছে। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের নবম রাত্রি]
দিদি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্প্রতি শাড়িবিষয়ক এক নিবন্ধ লিখে বাংলাদেশেরএকটি মহলের বাচিক ও লিখিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন। নিবন্ধটি সুলিখিত ও কাব্যময়, সন্দেহনেই, এবং তুমিও গত রাতে প্রবন্ধটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলে বলে মনে হয়েছে আমার। কিন্তুযতই পড়ছি, ঐ নিবন্ধে যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে, সেগুলোর একটিও 'স্বতঃসিদ্ধ' হওয়াদূরে থাকুক, 'অর্ধসিদ্ধ' কিংবা 'স্বল্পসিদ্ধ' বলেও মনে হচ্ছে না আমার। আশ্চর্যের বিষয়এই যে অধ্যাপক সায়ীদের যুক্তিগুলো খণ্ডন করে পাল্টা কোনো নিবন্ধ এখনও লেখা হয়নি আমারজানামতে। তার পরিবর্তে সামাজিক গণমাধ্যমে যে তুলকালাম হয়েছে, তাতে অধ্যাপক আবু সায়ীদএবং তাঁর সমর্থকদের 'পিতৃতান্ত্রিক', 'যৌনবিকৃত' কিংবা 'ধর্ষকামী' বলে ব্যক্তিগত আক্রমণকরা হয়েছে।
'উল্টো বুঝলি রাম!' শোনো দিনারজাদি, রাম-রাবণের যুদ্ধে রাবণের বুকে তীরনিঃক্ষেপেরপরিবর্তে রাম যদি রাবণকে বলে: 'অ্যাই ব্যাটা, তোর দশ দশটা মাথা কেন রে! আমারতো মাত্রএকটা!' কিংবা 'তুই এতগুলো বিয়ে কেন করেছিস? আমারতো সবেধন সীতামণি যাকে তুই 'নারীন্যাপ'(কিডন্যাপের অনুকরণে) করেছিস!' তবে রাবণও মরবে না, শাড়ির রামায়ণও আর শেষ হবে না।
শাড়ি এক 'যৌনাবেদনপূর্ণ শালীন' পোশাক, অধ্যাপক সায়ীদের প্রথম দাবি। বলা বাহুল্য, শাড়ি নারীর পোশাক এবং যৌনাবেদনটা জাগবে নারীর বিপরীত লিঙ্গ পুরুষের মনে। কমপক্ষে তিনটি উপায়ে: ১. প্রয়োজনের তুলনায় কাপড়ের পরিমাণ কম রেখে, ২. নারী শরীরের যৌনসংবেদনশীল অংশগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে এবং কৌশলে অনাবৃত রেখে এবং ৩. আবৃত হওয়া সত্তেও নারী শরীরের বন্ধুর অংশগুলো দৃশ্যমান করে তোলার মাধ্যমে, পুরুষের দৃষ্টিতে নারীর পোশাককে যৌনাবেদনপূর্ণ করে তোলা যেতে পারে।
উপরের তিনটি গুণের একটিও 'শাড়ি' নামক পোশাকটির নিজস্ব কিংবা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নয়। প্রথমত, বারো হাত লম্বা আনকোড়া এক থান কাপড় এই শাড়ি স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো পোশাক নয়। এর দুটি পরিপূরক পোশাক অপরিহার্য আমাদের যুগে: উধ্বাংঙ্গে ব্লাউজ এবং নিম্নাঙ্গে পেটিকোট। 'আমাদের যুগে' বললাম এ কারণে যে ব্লাউজ কিংবা পেটিকোটের বয়স খুব বেশি নয়। ষাটের দশকে আমাদের দিদিমা-ঠাকুমাদের দৈনন্দিন জীবনে পেটিকোট পরতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সে সময়ে আমাদের গ্রামের অনেক মহিলা ব্লাউজও পরতেন না। কোথাও বেড়াতে যাবার সময় কেউ কেউ 'শেমিজ' পরতেন। শব্দটা ফরাসি, আজকের যুগের ফরাসিতে এর অর্থ 'ছেলে বা মেয়ের শার্ট', কিন্তু এক কালে উপমহাদেশে শব্দটির অর্থ ছিল হয়তো 'কামিজ' জাতীয় কিছু।
গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা জামা বা কামিজকে রূচি অনুসারে কোমরের কাছে বা নাভির উপরে কেটে দিলে উপরের অংশ হয়ে যেতে পারে ব্লাউজ আর নিজের অংশ পেটিকোট (শুনেছি ধ্রুপদী সঙ্গীতবিদ আমীর খসরু সাহেব মৃদঙ্গ ভেঙে দু টুকরো করে তবলা সৃষ্টি করেছিলেন। ব্লাউজ আর পেটিকোটও ফরাসি সেমিজ কেটে সৃষ্টি হয়েছে কিনা, পোশাকের ইতিহাসবিদেরা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।) এই পেটিকোট ও শাড়ির দুই প্যাঁচ মিলে নিম্নাঙ্গে কমপক্ষে তিন স্তর এবং উর্ধাঙ্গে দুই স্তরের আবরণ থাকাতে শাড়ির শরীর ঢাকার ক্ষমতা কিংবা বাধ্যবাধকতা কোনো বিচারেই অন্য পোশাকের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। শাড়িকেও কাপড়ের গুদামঘর বলা যায়। (রাজস্থানী দেহাতী মেয়েদের মতো) লম্বা ঘোমটা দিয়ে আপাদমস্তক শরীর ঢেকেও শাড়ি পরা যেতে পারে। আমাদের দিদিমা-ঠাকুমাদের অনেকে ব্লাউজ ছাড়াই সেটা করতে জানতেন।
আজকের বাঙালি মহিলা যে ভঙ্গীতে শাড়ি পরে, ব্লাউজ-পেটিকোট দিয়ে, সেটা নাকি চালু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। এই আধুনিক ধাঁচে পরা শাড়িতে নারীদেহের যে জায়গাগুলো অনাবৃত থাকে (ধরা যাক, মধ্যপ্রদেশ), অন্য পোশাক, যেমন বিশেষ কাটের টি-শার্ট বা গেঞ্জিও সেটা অবলীলায় করতে পারে। (মিনি বা লং) স্কার্টে নারীদেহের যে জায়গাগুলো ঢাকে না, যেমন হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত দুই পা, শাড়ি বরং সে জায়গাটা খুব ভালো করে ঢেকে দেয়। শরীরের যে অংশগুলো ঢাকে না, ঢাকতে পারে না শাড়ি, সেগুলো আদৌ যৌনসংবেদনশীল কিনা, সেটা একান্তই ব্যক্তিগত, জাতিগত, স্থানগত, কালগত, বয়সগত কিংবা অন্য কোনো '-গত' রূচির প্রশ্ন। এ বিষয়ে কোনো সাধারণীকরণ করা সম্ভব নয়।
কিছু জায়গা অনাবৃত রাখলে নারীশরীর রহস্যচকিত হয়ে উঠে– এমন ধারা দাবিকরেছেন অধ্যাপক সায়ীদ। 'রহস্যচকিত' কথাটাও আপেক্ষিক। এতে বিশেষ ব্যক্তি ও সমাজের সাংস্কৃতিকপক্ষপাতও (ইংরেজিতে 'বায়াস') আছে। এমনও নৃগোষ্ঠী আছে, যাদের নারীরা শরীরের উর্ধাঙ্গকিংবা উত্তরপ্রদেশ অনাবৃত রাখে। তাদের পুরুষদের কাছে উত্তর প্রদেশে বিন্দুমাত্র রহস্যনেই, স্তন্যপায়ী শিশুর চারণক্ষেত্রের বেশি কিছু নয় এই বন্ধুর (উভয়ার্থে) এলাকাটা। আবারইন্ডিক জাতিগোষ্ঠী, বিশেষত উত্তর ভারতের পাঞ্জাবি ও পূর্বভারতের বাঙালি পুরুষেরা নারীরউত্তরপ্রদেশ থেকে চোখ সরাতেই পারে না।
কোনো জাতি বা ব্যক্তির কাছে স্কার্ট শাড়ির চেয়ে অধিকতর রহস্যচকিত মনে হতেপারে, কারণ আগেই বলেছি, স্কার্টে নারীর হল্যান্ড ('হল্যান্ড' শব্দের অর্থ নিম্নদেশবা নিচু ভূমি) অর্থাৎ পায়ের হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত অংশটি দৃশ্যমান হয়। 'যে পুরুষটিমেয়েদের ভালোবাসতো' শীর্ষক ফরাসি ছবির নায়ক ছিলেন এমন একজন নারীপদপ্রেমিক, হল্যান্ড-লাভার।পঞ্চাশ-ষাটের দশকের নিউ ওয়েভ ধারার এই ছবিটি উৎসুক পাঠক দেখে নিতে পারেন।
কোনো মেধাবী ফ্যাশন ডিজাইনার যদি চান, তবে যে কোনো পোশাকেই তিনি প্রদর্শন ও সংগোপনের জাদু সৃষ্টি করতে পারেন। একজন চৌকশ দর্জি ইচ্ছে করলে নারীদেহের প্রচ্ছন্ন বন্ধুরতাকে প্রকট করে ফুটিয়ে তুলতে পারেন যে কোনো পোশাকেই। এর মানে হচ্ছে, নারীশরীরকে রহস্যচকিত করার গুণটি কোনো বিচারেই শাড়ির একচেটিয়া নয়। শাড়ি বরং এই দিক দিয়ে বেশ কিছু পোশাকের তুলনায় পিছিয়েই আছে। আর শালীনতার কথা যদি বলো, তবে আমি বলবো, যে কোনো পোশাকই যেমন একদিকে শালীনভাবে পরা যায়, আবার অন্যদিকে, যৌনাবেদন সৃষ্টির উদ্দ্যেশ্যেও পরা যায়। সুতরাং 'শাড়ি যৌনাবেদনপূর্ণ শালীন পোশাক' এই দাবি 'তামিলদের দুই পা আছে' বলার মতোই হাস্যকর।
অধ্যাপক সায়ীদ দাবী করেছেন, শাড়ি একটি রহস্যময় পোশাক। এক সময় সারা পৃথিবীরলোকজন ভাবতে, ভারতবর্ষ একটি রহস্যময় দেশ। হিন্দু সাধুরা এখানে প্রাতরাশে লম্বা একটাতলোয়ার গিলে ফেলে! মুসলমান ফকিরেরা বাহ্য করতে দড়ি বেয়ে আকাশে উঠে যায়! এই ধরনের হাস্যকরওরিয়েন্টালিস্ট 'রহস্যপনার' আর 'বেইল নাই'। নতুন কোনো কিছু দেখে খামাখা উচ্ছসিত হওয়া,তাতে রহস্য খোঁজার বাতিককে Afganistanism বলতেন শিশির ভট্টাচার্য্যের পরলোকগত শিক্ষকভাষাবিজ্ঞানী রাজেন্দ্র সিংহ। আহার-নিদ্রা-মৈথুন… সারা পৃথিবীর লোকজন যা যা করে,উপমহাদেশের লোকজনও তাই করে। তাদেরও সকালবেলা কমোডে (কিংবা রেল লাইনের ধারে) বসতে হয়,কারণে-অকারণে তাদেরও মন খারাপ হয়, কিংবা ভালো হয় অন্য সবার মতোই। না, ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে কিংবা ভারতবর্ষের অন্যতম পোশাক শাড়ির কোনো ভাঁজে বিন্দুমাত্র রহস্য নেই। রহস্যআছে বলে যদি কেউ দাবি করে, তবে (যদি রেগে বলি) সেটা তার কুসংস্কার (আর যদি ভেবে বলি),সেটা তার ভুল ধারণা।
শাড়ি পরা নারীশরীরে এক 'অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল' বয়ে যাবার কথা বলেছেনঅধ্যাপক সায়ীদ। একেতো 'বিদ্যুৎ', তার উপর 'হিল্লোল' আবার তার উপর 'অলৌকিক'। পাঠক পালানোরপথ পায় না। বিদ্যুৎ প্রবাহের ব্যাপারটা মূলতঃ নির্ভর করে কাঠ শুকনো কি ভেজা তার উপর।ভেজা কাঠ অতি সহজেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়, কিন্তু শুকনো কাঠের ভিতর দিয়ে লৌকিক কিংবা অলৌকিককোনো বিদ্যুতই Pass হয় না (বিদ্যুতের খাম্বাগুলো বুঝি সেই কারণেই আবশ্যিকভাবেশুকনো কাঠের তৈরি হয় কিনা বিএনপি নেতা তারেক জিয়া হয়তো ভালো বলতে পারবেন!)। শাড়িপরাকোন নারীশরীরটি কখন, কোথায়, কী অবস্থায় দেখে কার মনে হবে যে সেই শরীরে বিদ্যুৎ হিল্লোলবয়ে যাচ্ছে, সেটা গবেষণা ছাড়াতো বটেই, গবেষণা করেও নিশ্চিত বলা অসম্ভব। তবে আপাতত দাবিকরা যেতে পারে যে অধ্যাপক সায়ীদের 'বিদ্যুৎ হিল্লোল' নামক অনভূতিটি সংস্কৃতি কিংবাব্যক্তিনিরপেক্ষ নয়।
শোনো দিনারজাদি, কোনো সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা-প্রকল্পে শ খানেক বাঙালিনারীকে দৈবচয়ন করে প্রত্যেককে একে একে শাড়ি এবং অন্য কয়েকটি জনপ্রিয় পোশাক পরিয়ে যদিশ খানেক পক্ষপাতহীন ব্যক্তির মতামত নেওয়া যায়, তবে সেই মিশ্রপ্রকৃতির (সংখ্যাত্মক+গুণাত্মক)গবেষণার ভিত্তিতে দাবি করা গেলেও যেতে পারে যে দর্শকের মনে তথাকথিত বিদ্যুৎ হিল্লোলসৃষ্টি করার ক্ষমতা অন্য পোশাকের তুলনায় শাড়ির আসলেই বেশি কিনা। বাঙালি নারীকে সবচেয়েবেশি মানায় শাড়িতে– এই দাবিটিও সেই একই গবেষণায় পরখ করে নেওয়াযেতে পারে। শাড়ি আদৌ উত্তম মেকআপ কিনা অর্থাৎ নারীশরীরের সৌন্দর্যের তথাকথিত ঘাটতিএই পোশাক অন্য কোনো পোশাকের চেয়ে মুন্সিয়ানার সঙ্গে মেটাতে পারে কিনা, সেই দাবিও গবেষণাসাপেক্ষ।কোনো ধরনের গবেষণার ফলশ্রুতিতে অধ্যাপক সায়ীদ তাঁর সিদ্ধান্তগুলোতে উপনীত হয়েছেন বলেমনে হয় না, অন্ততপক্ষে তাঁর নিবন্ধে সেরকম কোনো ইঙ্গিত নেই।
উচ্চতার তথাকথিত ঘাটতি সত্তেও শাড়িতে যে বাঙালি নারীকে সুশ্রী দেখাতে পারে,তার বাস্তব প্রমাণ বা ইমপিরিক্যাল এভিডেন্স রয়েছে: বোম্বের এককালের নায়িকা রাণী মুখার্জিকিংবা উভয় বাংলার হাল আমলের জনপ্রিয় নায়িকা জয়া আহসানকে শাড়িতে সুশ্রী দেখায় না বলতেশোনা যায়নি কাউকে। অধ্যাপক সায়ীদের দাবী, নারী-শরীরের প্রস্থের অসমতা কিংবা বিষমতারসমস্যা সমাধান করতে পারে একমাত্র শাড়ি। আারবি জেল্লাবা কিংবা বুরখাও কি এই কাজটা করতেপারে না? কোট-স্কার্টও এ কাজটি করতে পারে, যদি কাপড়টা লম্বালম্বী স্ট্রাইপের হয়। মিনিস্কার্টএবং জিন্স পোশাক না পরারই সামিল– অধ্যাপক সায়ীদের এই দাবিটিও ধোপেটিকবে না। জিন্স শাড়ির চেয়ে কোনো অংশে কম শরীর ঢাকে না। মিনি স্কার্টের সঙ্গে মোজাবা ল্যাগিং পরা হলে শরীর যথেষ্ট আবৃত হয়।
গড়পড়তা বাঙালি নারীর উচ্চতা শাড়ি পড়ার জন্যে কাম্য উচ্চতার চেয়ে কয়েক ইঞ্চিকম– এই দাবি করেছেনঅধ্যাপক সায়ীদ। সম্ভবত শারিরীক সৌন্দর্য্যের আর্য কিংবা উত্তর ভারতীয় মানদণ্ড তাঁরএই দাবির ভিত্তি। ওঁর এই দৃষ্টিভঙ্গী সাবজেক্টিভ শুধু নয়, ত্রুটিপূর্ণও বটে। শাড়িতেদীর্ঘাঙ্গী পাঞ্জাবি মেয়েদের সুশ্রী নাও দেখাতে পারে অনেকের চোখে। তাছাড়া উপমহাদেশেশাড়ি পরার অনেক রকম ধরণ আছে, (যতদূর মনে পড়ছে) পঞ্চাশটির মতো ধরণ আছে বলে উল্লেখ করেছেনএক অধ্যাপিকা তাঁর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে। কোন ধরনের নারীশরীরে শাড়ি পরার কোন ধরণটিখাপ খাবে, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে, ওঠা উচিত, কিন্তু অধ্যাপক সায়ীদ সে প্রসঙ্গে যাননি।
বাঙালি নারী ইচ্ছে করে, স্ব-উদ্যোগে শাড়িকে নিজের আলনা, আলমারি কিংবা ওয়ারড্রব থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে বলে অভিয়োগ করেছেন অধ্যাপক সায়ীদ। এই অভিযোগ সত্য নয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, পোশাক ইত্যাদি যে কোনো ব্যাপারে নারীরা সাধারণত পুরুষের তুলনায় রক্ষণশীল হয়ে থাকে। পুরুষ বহু আগেই তার ফতুয়া, চাদর, ধুতি বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। ধুতি কোনোমতে, টিমটিম করে টিকে আছে হিন্দু বিয়ের পোশাক হিসেবে। আজ থেকে প্রায় আড়াই শ বছর আগে বাংলার সর্বশেষ নবাব সিরাজদৌলার পোশাক যদি শেরওয়ানি-তাজ হয়ে থাকে, তবে সেই শেরোয়ানি-তাজ এখন টিকে আছে শ্রেফ মুসলিম বিয়ের পোশাক হিসেবে। ঘরের পোশাক হিসেবেও বেচারা লুঙ্গি যাই-যাচ্ছি করছে না কি? 'সখি, যাই যাই বলো না!' কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার পোশাক শাড়ি। কৃত্তিবাস যদি ষোড়শ শতকের কবি হয়ে থাকেন, তবে বাঙালি নারী প্রায় ৫০০ বছর আগের পোশাক শাড়ি এখনও সাদরে পরিধান করছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমান মহিলাদের বর্মী মেয়েদের মতো থামি আর ওড়না পরতে দেখেছি ষাটের দশকে। এই পোশাক হারিয়ে গেছে (জীবনানন্দের ভাষায়) 'সেও আজ হলো কতো কাল!' তাদের বৌ-ঝি-নাতনীরা এখন শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরে। প্রতিটি পোশাককে অন্য সব পোশাকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় প্রতিনিয়ত। পরিধানকারীর ভূমিকা এখানে অতটা মুখ্য নয়, যতটা অধ্যাপক সায়ীদ ভাবছেন। কেন একটি পোশাক টিকে যায়, কেন অন্যটি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না? একটি পোশাক চিরতরে হারিয়ে যাবার কিংবা ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকার কোনো সাধারণ নিয়ম আছে কিনা জানার জন্যে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
১. Ox/Oxen, ২. Goose/Geese, ৩. Book/Books– ইংরেজি বহুবচনেরএই তিনটি নিয়মের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রথম দুটি নিয়ম আজ থেকে শ পাঁচেকবছর আগে বহুল ব্যবহৃত ছিল, তৃতীয়টি ছিল স্বল্প ব্যবহৃত। আধুনিক ইংরেজিতে তৃতীয় নিয়মটিবহুল ব্যবহৃত, প্রথম ও দ্বিতীয় নিয়ম প্রায় হারিয়ে যাবার পথে। কেন তৃতীয় নিয়মটি জনপ্রিয়এবং সর্বব্যাপী হয়ে উঠলো? Book/Beek নিয়মটি হারিয়ে গেল কেন? কারণ বলা সহজ নয়।
কিছু ভাষাবিজ্ঞানী মনে করেন, সব ধরনের শব্দে যুক্ত হবার ক্ষমতা আছে বহুবচনদ্যোতকs বিভক্তির। কিন্তুকথাটা আংশিক সত্য। শব্দের শেষে যদি ঘোষ ধ্বনি থাকে, যেমন mad, bed, কিংবা থাকে অ্যাফ্রিকেটধ্বনি, যেমন match, fridge, কিংবা থাকে শীষধ্বনি, bush, gas, তবে s বিভক্তি যুক্ত করা সহজ নয়: mads, matces, bushes– প্রথম শব্দে অঘোষs-এর উচ্চারণ z হয়ে যায়; দ্বিতীয়ও তৃতীয় শব্দে অপিনিহিতির আশ্রয় নিতে হয়, অর্থাৎ s-এর আগে অতিরিক্ত একটি e অন্তর্ভুক্ত করতেহয়। এত সমস্যাসঙ্কুল হওয়া সত্তেও ৩নং নিয়মটি ইংরেজি ব্যাকরণে বহুবচনের একমেবদ্বিতীয়মনিয়ম হয়ে উঠছে কীভাবে? 'প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়!' আসাদ চৌধুরীর কবিতা। ফ্যাশনের ক্ষেত্রেওকথাটা প্রায় সমভাবে প্রযোজ্য। 'কালস্য কুটিলা গতি।' বাঙালি নারী চাইলেই শাড়ি টিকে যাবে,আর না চাইলে হারিয়ে যাবে এই পোশাক, অস্তিত্বের সমীকরণ অতটা সরল-সোজা নয়। অসংখ্য অজানানিয়ামক এখানে সক্রিয় থাকে।
অধ্যাপক সায়ীদের প্রবন্ধটি সুলিখিত, সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ বটে, কিন্তু এইপ্রবন্ধে যে দাবিগুলো তিনি করেছেন, সেগুলোরএকটিকেও যুক্তিগ্রাহ্য বলা যাবে না- এই কথাটা তুমি ঠিকই বলেছো দিনারজাদি। কিন্তু এইসহজ কথাটা বলার আক্কেল কিংবা ক্ষমতা (চট্টগ্রামের ভাষায় 'হ্যাডম'। শব্দটা কারও কাছেঅশ্লীল মনে হতে পারে, কিন্তু উপযুক্ততর শব্দ মনে পড়ছে না) হয়নি কোনো বাঙালি বুদ্ধিজীবীর,যদিও অধ্যাপক সায়ীদকে ব্যক্তিগত আক্রমণে পিছপা হননি অনেকেই। ভাত দেবার ভাতার নয়, কিলদেবার গোঁসাই! ভুল মানুষেরই হয়। 'লেখা প্রকাশের অব্যবহিত পরেই লেখকের মৃত্যু হয়– বলেছিলেন রোলঁবার্থ। যুদ্ধই যদি করতে না শিখলাম, না পারলাম, মৃতদেহে খামাখা আঘাত করে কী লাভ?
ধরা যাক, অধ্যাপক সায়ীদ একটি থিসিস দিয়েছেন, তা সে যে কোনো বিষয়েই হোকনা কেন। শাড়ি বিষয়ে তাঁর থিসিসটি যদি মনোযোগ পাবার যোগ্য হয়, তবে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিএকটি অ্যান্টিথিসিস উপস্থাপন করবেন। এর পর তৃতীয় একজন থিসিস ও অ্যান্টিথিসিস মিলিয়েএকটা সিনথিসিস তৈরি করবেন। এটাই জ্ঞানউৎপাদনের কাম্য প্রক্রিয়া। অধ্যাপক সায়ীদের যুক্তিরঘাটতিগুলো দেখানোর পরিবর্তে তাঁকে 'পিতৃতান্ত্রিক', 'ধর্ষকামী' ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিতকরা লিঙ্গ ও নারীবাতিকগ্রস্তদের সময় ও ক্ষমতার অপচয়ই শুধু নয়, এ ধরনের আচরণ বাংলাদেশেরবুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ভবিষ্যতের জন্যে অশনিসঙ্কেতও বটে।
'শাড়ি' নিবন্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখা একটি প্রবন্ধে অধ্যাপক আবু সায়ীদের বিরুদ্ধে পুরুষাবলোকনের বা মেইলগেইজ-এর অভিযোগ করা হয়েছে। 'পুরুষাবলোকন' হচ্ছে সেই সব পুরুষের বিশেষ একটি দোষ যারা নারীকে নেহায়েত ভোগ্য পণ্য হিসেবে দেখে। 'কীভাবে প্রমাণিত হয় যে অধ্যাপক মহোদয় পুরুষাবলোকন করছেন?' তুমি যদি তাদের জিজ্ঞেস করো, তবে তারা উত্তর দেবে: কারণ তিনি বলেছেন, শাড়ি একটি রহস্যময় পোশাক; শাড়ি জানে, কোথায় নারীশরীরকে প্রকাশিত আর কোথায় অপ্রকাশিত রেখে তাকে অনিন্দ্য, যৌনাবেদনময় করে তোলা যায়, ইত্যাদি। শাড়িকে রহস্যময় বললেই কি নারীশরীরকে কাম ও লালসার বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হয়? একটা গল্প মনে পড়ছে। পকেটে নেলকাটার রাখার অপরাধে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হলে পুলিশকে সেই ব্যক্তি বলেছিল, সাথে একটা নারীনির্যাতনের মামলাও দিয়ে দিন, কারণ এমন একটি অঙ্গ আমার আছে যা দিয়ে প্রয়োজনে ধর্ষণ করা যায়।
"তন্বী শ্যামা শিখর-দশনা পক্কবিম্বাধর-ওষ্ঠী। মধ্যে ক্ষামা চকিত-হরিণী-প্রেক্ষণানিম্ননাভিঃ। শ্রোণীভারাদ অলসগমনা স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাং।" অর্থাৎ "কৃষ্ণবর্ণা তন্বীসেই নারী, (তুষারাবৃত) পর্বতশিখরের মতো তার দন্তরাজি, পক্ক বিম্বফলের মতো তার অধর আরওষ্ঠ, ক্ষীণ কটিদেশ, নীচু নাভিদেশ, নিতম্বের ভারে দ্রুত চলাচলে অক্ষম, স্তনভারে অবনতাসে, চঞ্চল হরিণীর মতো তার দৃষ্টি।' মেঘদূতে যক্ষের স্ত্রীর শরীর বর্ণনা। কালিদাস, তুমিমরে বেঁচে গেছো। আজকের যুগে হলে নারীবাতিকগ্রস্ত ও লিঙ্গবাতিকগ্রস্ত বালখিল্যরা 'হারেরে'করে তেড়ে আসতো তোমার দিকে। ব্যাটা কালিদাস কেন শ্রমজীবী নারীর ঘর্মাক্ত মুখের বর্ণনাদেয় না? আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো তোমার মনেও অন্তসলিলা ধর্ষকামীতা আর মেইলগেইজেরএমন অপবাদ তারা দিত যে তুমি অপমানে-লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে।
ইওরোপীয় স্কার্ট-জিন্স কিংবা সালোয়ার-কামিজ পরে নিজেদের ইওরোপীয় কিংবা ভারতীয় নারীদের সমকক্ষ ভেবে বাঙালি নারীরা হাস্যকর আত্মতৃপ্তি লাভ করে বলে অনুযোগ করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি মনে করেন, স্কার্ট-জিন্স কিংবা সালোয়ার-কামিজের মতো বিদেশী পোশাককে ভালোবেসে শাড়িকে পরিত্যাগ করা বাঙালি নারীর উচিত হয়নি। 'কত রূপ স্নেহ করি বিদেশী কুকুর ধরি, স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া'- ঈশ্বরগুপ্তের কবিতার এই চরণের মর্মার্থের সঙ্গে ওঁর বক্তব্যের মর্মার্থের তফাৎ কোথায়? অধ্যাপক সায়ীদ নিজেও দেশী পোশাক পাজামা-পাঞ্জাবি পরেন। ওঁর মানসিকতা ও পোশাক বাঙালি জাতীয়তাবাদী। বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি ভয়াবহ কোনো ব্যাপার? নিজের দেশ, নিজের পোশাক, নিজের ভাষার পক্ষে থাকা কি ভয়াবহ কোনো মানসিকতার পরিচায়ক?
যদিও এক অধ্যাপিকা বলেছেন, তিনি শাড়ি পড়ে সাইকেল চালাতে পারেন, তবুও সাইকেলচালাতে গিয়ে যদি কোনো নারী শাড়ির বদলে জিন্স পড়তে চায়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাতে বাধাদিতে চান না। তবে তিনি কষ্ট পান বিনা অজুহাতে বা ঠুনকো অজুহাতে নারী যখন শাড়ির সঙ্গেআড়ি দেয়। বাংলাকে যেমন হিন্দুর ভাষা বলার চেষ্টা হয়েছিল একসময়, তেমনি হিন্দুর পোশাকবলে শাড়িকে বাঙালি জীবন থেকে দূর করার অপচেষ্টা এখনও বহাল আছে কোনো কোনো মহলে। আবদুল্লাহআবু সায়ীদ হয়তো এই অপচেষ্টারই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।
নারীর উপর নিজের পছন্দ চাপিয়ে দিতে পারছেন না বলে নয়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকষ্ট পান, নারী তার দেশের পোশাক পড়ছে না বলে, যুগ ও কর্মের ক্ষেত্র পরিবর্তনের কারণেনিজের দেশের পোশাক বিদেশের পোশাকের কাছে হেরে যাচ্ছে বলে। কর্মক্ষেত্রে নারীকে শাড়িছাড়া অন্য 'ফাংশনাল' পোশাক পরতে হয়, অধ্যাপক মহোদয় সে কথা জানেন, কিন্তু তবুও তিনিএতে কষ্ট পান, কারণ তিনি একজন রোমান্টিক দেশপ্রেমিক। দেশপ্রেমও বাতিল করার সময় এসেগেছে– আমরা কি এতটাইআন্তর্জাতিক হয়ে গেছি?
একটা প্রাগৈতিহাসিক কিসসা বলি তোমাকে দিনারজাদি। বহু লক্ষ বছর পূর্বে পুরাতনপ্রস্তর যুগের এক সকাল। আমাদের দুই পূর্বপুরুষ ভাই হাবিল ও কাবিল পাথরের কুঠার হাতেশিকারে বেরিয়েছে। হঠাৎ এক বাঁশবনের পাশের ঘাসবনে সরসর আওয়াজ। 'বাঘ নয়তো!' ভেবে কুঠারহাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো হাবিল আর কাবিল এবং অনতিবিলম্বে বোকা বনলো। বাঘ নয়, বাঘ নয়! (বসন্তবাতাসে, সইগো, বসন্ত বাতাসে!) ঘাসের সঙ্গে বাঁশের শুকনো খোলসের ঘর্ষণে এই অদ্ভূত 'বাঘা'শব্দ হচ্ছিল। হাবিল আর কাবিল আক্রমণ করে কি ভুল করেছিল কোনো? বিন্দুমাত্র না। অনুরূপশব্দ শুনেও আক্রমণ না করে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে নরবানরেরা, তারা প্রায়সবাই বাঘের পেটে গিয়েছিল, আমাদের পূর্বপুরুষ হবার সৌভাগ্য তাদের হয়নি।
'বাঘ না বাঁশ'– বিচার না করেই হাবিল আর কাবিলের এই যে হঠাৎঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত, মনোবিজ্ঞানে (?) এর নাম 'সংজ্ঞাপনিক পক্ষপাত/অবহিতি' বা 'সংজ্ঞাপনিকতাড়না', ইংরেজিতে যাকে বলে 'কগনিটিভ বায়াস'। মানুষ যুক্তিবাদী প্রাণী বটে, কিন্তু তারদৈনন্দীন জীবনের সিংহভাগ সিদ্ধান্ত যুক্তিভিত্তিক নয়, সংজ্ঞাপনিক তাড়না-ভিত্তিক। আমি,আপনি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কিংবা তাঁর প্রতিপক্ষ, আমাদের সকলের মনে আজন্ম গ্রন্থিতবা ইনবিল্ড আছে এই তাড়না। মস্তিষ্কে এই ডিভাইসটি থাকা না থাকার উপর আমাদের অস্তিত্বনির্ভর করে। সাবধান! তাড়না দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে, কিন্তু সমাজে অগ্রগতি আসবেনা। মানব সমাজের অগ্রগতি নির্ভর করবে যুক্তিবাদিতা বা র্যাশনালিটির চর্চার উপর। যুক্তিবাদীহওয়া কষ্টকর বলে সাধারণ মানুষ সেই কষ্ট প্রায় কখনই করতে চায় না, তাড়নার স্রোতেই গাভাসিয়ে দেয়। এ কথা আমি, আপনি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়ে একেবারে প্রথমেই যে আচরণটা করতে ইচ্ছা হয় মানুষের,সেটার নাম আদিম বা অতিপ্রাথমিক তাড়না। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করার পরিবর্তে ব্যক্তিগতকোনো অভিজ্ঞতা, কারও সম্পর্কে কোনো পূর্বধারণা (দার্শনিক কান্ট যাকে A priori বলেছেন), কোনোপ্রবাদবাক্য (খনার বচনই হোক না কেন!), কোনো রসালো চুটকি, বা দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায়মুদ্রিত কোন খবরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি আমরা প্রায়শই। এর নাম দেওয়া যেতে পারে 'আওতাভিত্তিকতাড়না', যা কিছু হাতের নাগালে বা আওতায় পাওয়া যায়, তাই ব্যবহার করার অদম্য এক ইচ্ছাজাগে মানুষের মনে।
নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করে, এমন তথ্যকে মানুষ প্রাধান্য দেয়। যে সব তথ্যস্বমতের বিরুদ্ধে যায়, সেগুলো যত্নসহকারে চেপে যায়। এর নাম 'সুনিশ্চিতির তাড়না'। একেবারেপ্রথমেই যেটা মনে হয়েছে বা মাথায় এসেছে, সেটাকেই চিরদিন আঁকড়ে ধরে থাকা এবং সেই মতটাকেকোনো অজুহাতেই পরিবর্তন না করার যে তাড়না, তার নাম দেয়া যেতে পারে 'মননোঙর' বা 'মন-আঁকষি'তাড়না (এই তাড়নাগুলোর সুন্দরতর বাংলা নাম বাঙালি মনোবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই এতদিনে দিয়েথাকবেন)। সংজ্ঞাপনিক তাড়নার বহু রকমফের মনোবিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত আবিষ্কার করেছেন এবংএগুলোর সংখ্যা নাকি দিন দিন বেড়েই চলেছে।
শাড়ি বিষয়ক আলোচনায় যারাই অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সবার মধ্যেই এই তাড়নাগুলোকমবেশি ক্রিয়াশীল হয়েছে। এইসব বিচিত্র সংজ্ঞাপনিক তাড়না হাবিল-কাবিলের উত্তরপুরুষ আধুনিকহোমো সাপিয়েন্স মানবের অতি স্বাভাবিক একেকটি আচরণ। নরবানর থেকে আধুনিক মানুষে বিবর্তনেরদীর্ঘ যাত্রায় কোনো কোনো জাতি ও ব্যক্তির মননে-আচরণে যুক্তিবাদ অধিকতর প্রাধান্য বিস্তারকরেছে, অন্য কিছু ব্যক্তি ও জাতির মননে-আচরণে প্রাধান্য বিস্তার করেছে সংজ্ঞাপনিক তাড়না।বাংলাদেশে বহুকাল 'রেশন' দেওয়া হয় না, সে কারণেই হয়তো অন্য জাতির তুলনায় বাঙালিদেরর্যাশানালিটি বা যুক্তিবাদী মনোভাব কম।
আধুনিক কবিদের রাজা বোদলেয়ার যেমনটা লিখেছেন 'যোগাযোগ' শীর্ষক কবিতায়,প্রথমোক্তরা 'সমৃদ্ধ, বিজয়ের উল্লাসে উচ্ছল'। দ্বিতীয়োক্তরা পিছিয়ে আছে চিন্তায়-কর্মে-অর্জনে,যার প্রতিফলন ঘটেছে সাম্প্রতিক শাড়ি বিষয়ক চাপান-উতোরে। শান্ত হয়ে চিন্তা করে সিদ্ধান্তনেবার পরিবর্তে আমরা যারা অনবরত ভেংচি কাটছি, গা চুলকাচ্ছি, নিজের কিংবা অপরের, গণকিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে, 'বাব্যা, ভাইয়া আমাকে মেরেছে!' বলে অপোগ- শিশুর মতো হাপুসনয়নে কেঁদেকেটে নালিশ করে এসে যারা নিজের সম্মান, ব্যক্তিত্ব ও ক্যারিয়ারের পৌনে বারোটাবাজাচ্ছি, সেই আমাদের স্বভাবে যুক্তিকে ছাপিয়ে উঠেছে লক্ষ বছর আগের প্রাইমেট পূর্বপুরুষহাবিল-কাবিলের সংজ্ঞাপনিক তাড়না।
[শেহেরজাদির কথাটিও ফুরলো, নটে গাছটিও মুড়োলো, অর্থাৎ পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকেরচিহ্ন ফুটে উঠল। ভোরের আযান শোনা গেলে কথা থামিয়ে দিলেন শেহেরজাদি এবং ফজরের নামাজপড়ে দুই বোন নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাদশা শাহরিয়ারও বেরিয়ে গেলেন ফজরের নামাজআদায় করতে এবং অতঃপর রাজকার্যে। নারীদেহ ও শাড়ি নিয়ে এই অনন্য-সাধারণ আলোচনার আদ্যোপান্তশুনে বাদশা শাহরিয়ার চমৎকৃত হয়েছেন। আগামি রাতগুলোতে বিচিত্রতর বিষয়ের অবতারণা হতেপারে– এই আশায় বাদশানামদার শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড দশম দিন পর্যন্ত মুলতবী করলেন।]