গত ১৬ জুলাই থেকে ঢাকা শহর ও ঢাকার বাইরে যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল, রাষ্ট্রীয় অনেকগুলো স্থাপনা যেভাবে ধ্বংস করা হলো, যেভাবে মাসুম শিশু ও নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের খুন করা হলো, সেটি বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা।
Published : 03 Aug 2024, 03:30 PM
এটি কি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ? এটি কি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও বেগম রোকেয়ার বাংলাদেশ? এটি কি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ? কী করে এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল? মানুষের সভ্যতা তার শত বছরের বুদ্ধি, বিবেচনা, দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে গড়ে তুলেছে রাষ্ট্র। ফরাসী বিপ্লবের পর ইউরোপে গড়ে ওঠে ‘নেশন স্টেটে’র ধারণা। পরের দু শ’ বছর ধরে সারা বিশ্বে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা শক্তিশালী হতে থাকে। সারা বিশ্বের দু শ’র অধিক দেশে এখন দেশ শাসন করার নানাবিধ ব্যবস্থা। কোথাও পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, কোথাও একদলীয় সমাজতন্ত্র, কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও সামরিক শাসন, আবার কোথাওবা সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কল্যাণ রাষ্ট্র। হবস, লক, রুশোর হাত ধরে যে সামাজিক চুক্তির মতবাদ বিকশিত হয়েছে, ওই মতবাদ কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করেছে। একটি সমাজ এবং রাষ্ট্রে যে ব্রাত্য জনগণ বাস করেন, ওই সকল সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্যই রাষ্ট্রের সৃষ্টি। রাষ্ট্রের পক্ষে এর বৈধ সরকার সকল নাগরিকের ‘কমন গুড’ বা সাধারণ কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য শাসন কার্য পরিচালনা করে।
১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের ‘ডিক্লারেশন অব রাইটস অব দ্য ম্যান অ্যান্ড অব দ্য সিটিজেন’, যুক্তরাজ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে গৃহীত বিল অব রাইটস, পিটিশন অব রাইটস-এর কেন্দ্রে রয়েছে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক রেভ্যুলুশন বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব মানবাধিকারের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীরা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, ও চিকিৎসা পাওয়াকে প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার বলে দাবি করেন। সমাজতন্ত্রীরা রাষ্ট্রে ব্যক্তি সম্পত্তি নিষিদ্ধ করে এবং রাষ্ট্র সকল মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, ও চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি প্রকাশ করে। ওই ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে, যারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ (এমএনএ) এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন। তিন পৃষ্ঠার ওই ঘোষণায় বলা হয় যে, আমরা বাংলাদেশের সকল মানুষের তিনটি বিষয়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছি, এগুলো হচ্ছে — মানবিক মর্যাদা, সাম্য, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত মূল সংবিধানের মুখবন্ধ, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং মৌলিক মানবাধিকার অধ্যায়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় মানবাধিকার, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের ওপর। ন্যায়বিচারকে আবার বিশেষায়িত করা হয়েছে তিনভাবে— রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সামাজিক ন্যায়বিচার।
আজ আমি মর্মান্তিকভাবে বেদনাহত, সংক্ষুদ্ধ, ও শঙ্কিত। গত ১৬ জুলাই থেকে চার-পাঁচদিন ধরে ঢাকা শহর ও ঢাকার বাইরে যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল, রাষ্ট্রীয় অনেকগুলো স্থাপনা যেভাবে ধ্বংস করা হলো, যেভাবে মাসুম শিশু ও নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের খুন করা হলো, সেটি বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা। নাশকতাকারী ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। বরং যারা নাশকতা করবে, জঙ্গিবাদী হামলা করে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যই তো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পরিচালনা করা হয়। কিন্তু মাসুম শিশুদের কেন হত্যা করা হলো? রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী সাঈদকে কেন হত্যা করা হলো? প্রায় ৫০ জন সাধারণ শিক্ষার্থী কেন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে? এতে কি সংবিধানে বর্ণিত জীবনের অধিকার লঙ্ঘিত হলো না? কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে নিরাপত্তার কথা বলে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে তাদের দিয়ে ঘোষণা পাঠ করানোতে মানবিক মর্যাদা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার কফিনে কি পেরেক ঠুকে দেওয়া হলো না?
যারা রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করেছে, যারা বড় বড় অবকাঠামো ধ্বংস করে বাংলাদেশের উন্নয়নকে থমকে দিতে চেয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশেকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে, ওইসব নাশকতাকারী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে শুধু বিচার নয়, নির্মূল করতে হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করেছেন, তারা কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন না? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘মানুষের মত মানুষ’ তৈরি করার শিক্ষা ব্যবস্থার কথা। কিন্তু যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘আমলা তৈরি করার কারখানা’য় পরিণত করলেন, তাদের বিচার হবে না? যারা ‘মুক্তচিন্তা’র কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করালেন, তারা জবাবদিহি করবেন না? যারা সকল প্রতিবাদ, যুক্তিতর্ক, ভিন্নমত, সমালোচনা, সহিষ্ণুতা বন্ধ করে দিয়ে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা বিস্তৃত হবার পথ করে দিলেন, তাদের মুখোশ উন্মোচিত হবে না?
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে আমরা বাংলাদেশকে এমন একটি জায়গায় দেখতে চেয়েছিলাম যেখানে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই রাষ্ট্রটিকে মনে হবে গণতান্ত্রিকভাবে প্রাথমিক পরিপক্কতা অর্জন করেছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও মানবসম্পদ উন্নয়নে শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠায় টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হাঁটছে রাষ্ট্রটি; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলার দিকে ধীরে হলেও এগিয়ে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ আজ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে ভয়ানকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশি ও বিচারিক সেবার কোনোটাই জনবান্ধব নয়। যেকোনো সরকারি অফিসে গেলে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রায় সবাই, যার যেখানে সুযোগ আছে, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।
পঞ্চাশ বছরে একটি রাষ্ট্রে বসবাসকারী নানা রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের, তার সিভিল সোসাইটি ও বুদ্ধিজীবীদের, নানা ধর্ম ও গোত্রের মানুষের যে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিপক্কতা গড়ে ওঠে, বাংলাদেশ সেটি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। এখানে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সচিবদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয় না। পেশাদারিত্ব এবং সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখানে শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিচারক, পুলিশ ও আইনজীবীদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যবসায়ীরা এখানে মুক্তবাণিজ্যের নামে অবাধ লুন্ঠনে মেতে উঠেছেন। রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো জমি দখল, দখলের প্রয়োজনে খুন, মালিকানায় থাকা প্লটের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি বিক্রি, ক্রেতাদের সঙ্গে জালিয়াতি — হেন অপকর্ম নেই যা করে না।
সংবিধানের মুখবন্ধ ও ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, এ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক হচ্ছে জনগণ। কিন্তু আদতে রাষ্ট্রের মালিক হয়ে বসেছে আমলা, পুলিশ, কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ এবং ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদেরা। কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, গবেষক ও অধ্যাপকেরা এখানে অবহেলিত ও চরমভাবে অসম্মানিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশি ও বিচারিক সেবার কোনো কিছুই ব্রাত্য জনগণের ভাগ্যে জোটে না। বড় দুর্ভাগা এ দেশের আম ছাত্র-জনতা। বার বার তারা অন্দোলন করেন, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তারা আশা করেন, এইবার গণতন্ত্র আসবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি স্বস্তি দেবে, শিক্ষা শেষে তার সন্তানের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বার বার তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। নতুন যারা আসেন, তারা পুরানোদের মতো হয়ে যান অথবা পুরনোদের চেয়ে বেশি স্বৈরাচারী, দুর্নীতিবাজ ও লুন্ঠনকারীতে পরিণত হন। তখন মানুষ বলতে থাকে ‘আগে যারা ছিল’ তারাই ভালো ছিল। এই দুষ্টচক্রে আবর্তিত হতে হতে বাংলাদেশের অর্ধশতক পার হয়ে গেল।
বাংলাদেশের কিছুই হয়নি, তা আমি বলব না। বেশকিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অর্জন আছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে একটি দেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্র, সুশাসন, ভারসাম্যপূর্ণ সরকার ব্যবস্থা, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা, সামষ্টিক অর্থনীতির শৃঙ্খলা, সর্বোপরি গবেষণাভিত্তিক নীতি নির্ধারণ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ। কিন্তু এই প্রত্যেকটি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা ভঙ্গুর, নাজুক ও হতাশাজনক। তবুও অশাবাদী হতে হবে, স্বপ্ন দেখতে হবে। কেননা, আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদের আশাবাদী হতে শিখিয়েছে, সাহসী হতে শিখিয়েছে, উদ্দীপ্ত করেছে স্বপ্ন দেখতে।