১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কোনো কথা নেই। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলতে জাতিসংঘের স্বীকৃতিকেই ধরে নেয়া যায়। জাতিসংঘ সনদেও গণহত্যার স্বীকৃতি বলে কোনো বিধান নেই।
Published : 28 Mar 2024, 06:12 PM
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে পরের বছর ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসমূহ মোটামুটি একবাক্যেই মেনে নিয়েছিল যে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সাংকেতিক নামে বাংলাদেশের মানুষের উপর যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল এবং চলেছে পরের ৯ মাস ধরে, তা স্মরণকালের নির্মমতম গণহত্যা। এর তীব্রতা দ্বিতীয় মহাসমরকালে চালানো গণহত্যাকে হার মানিয়েছিল এই অর্থে যে সে সময়ে ৪ বছর সময়কালে ৬০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল নাৎসিরা, যেখানে বাংলাদেশে ৯ মাস সময়ে ন্যূনতম হিসাবে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনাদের দল।
শহীদদের সংখ্যা গণনায় পশ্চিম বাংলা যাত্রাপথে, পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরার আশ্রয় শিবিরসমূহেও বহু লোকের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানিয়েছেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস, যিনি সে সময়ে অক্সফাম নামক বিশ্বনন্দিত ত্রাণ সংস্থার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তার মানবিক সেবার জন্য বৃটিশ রানি তাকে সম্মানসূচক পদবি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে শুধু সম্মাননাই দেয়নি, দিয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও।
জুলিয়ান বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা অভিমুখে যাত্রাকালে বহু বৃদ্ধ এবং শিশু ক্লান্তিতে, কলেরা, উদারাময়, টাইফয়েড প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। তার দেখা মতে আশ্রয় শিবিরসমূহেও বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছিল বিভিন্ন ব্যাধিতে। ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে জেনোসাইডের সংজ্ঞা বেশ ব্যাপক। এ সংজ্ঞায় শুধু হত্যাকাণ্ডেই সীমিত নয়, এতে জেনোসাইড নামক অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে (ক) হত্যা, (খ) মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক যাতনা, (গ) একটি মানব গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া, (ঘ) গোষ্ঠী বিশেষের জন্ম প্রক্রিয়া বন্ধকরণ, (ঙ) একটি গোষ্ঠীর শিশুদের অন্য গোষ্ঠীতে বদলিকরণ। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী যাত্রাপথে এবং আশ্রয় শিবিরে মৃতদেরও ধরা যায়। এই সংজ্ঞায় ধর্ষিত নারীরাও অন্তর্ভুক্ত।
সরকারিভাবে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ২ লাখ বলা হলেও এ ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণা করে বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক এবং গণহত্যা জাদুঘরের প্রধান ট্রাস্টি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এই মর্মে দাবি করেছেন যে যৌন নির্যাতনের শিকার মহিলাদের সংখ্যা ৫ লাখের কম ছিল না। অধ্যাপক মামুনের দাবির সমর্থন পাওয়া যায় ডেভিড ডেভিস নামক এক অস্ট্রেলিয়ান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বক্তব্যে, যাকে ১৯৭২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল ধর্ষণের শিকার নারীদের চিকিৎসার জন্য। তিনি বলেছেন ধর্ষিতাদের সংখ্যা কোনোক্রমেই চার লাখের কম ছিল না। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে অন্তত ৫ হাজার ধর্ষিতা নারী আত্মহত্যা করেছেন, বেশ কয়েক হাজার আত্মগোপনের জন্য ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন। গত ২৫ মার্চ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবির যথার্থই বলেছেন নির্যাতিতা মহিলাদের সম্ভ্রম হারানো মহিলা বলা কোনোক্রমেই যৌক্তিক নয়, এটি নির্যাতিতাদের উপর চালানো হায়েনাসুলভ নির্মমতাকে খাটো করার শামিল।
২৫ তারিখ গণহত্যা শুরুর সময়ে সায়মন ড্রিং, পিটার হেজেল হার্স্ট, টনি ম্যাসকেরেনিয়াস, ডেভিড লোশাক প্রমুখ বিশ্বখ্যাত সাংবাদিকগণ কৌশলে ঢাকা শহরে অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয়ে, ভিডিও চিত্রসহ যে সব প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন, তাতে দাবি করা হয়েছে ২৫ তারিখের গণমেধ যজ্ঞে শুধু ঢাকা শহরেই অন্তত ২৫ হাজার লোককে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি অসুরকুল। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস, শহরের বিভিন্ন এলাকায় তারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল যা থেকে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, পথের ভিখারী, পথচারী কেউই বাদ যায়নি। নাদির শাহ দিল্লী আক্রমণকালে সেই শহরে যেমন যাকে দেখা গেছে তাকেই হত্যা করা হয়েছিল, বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত টিক্কা খান, রাও ফরমান আলি প্রমুখের নির্দেশে পাকিস্তানিরা সেভাবেই রক্তের হোলি খেলা চালিয়েছিল। হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল ধর্ষণকাণ্ডও। রোকেয়া হলের ছাত্রীরা অমানবিকভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, হেনরি কিসিঞ্জারও তার পুস্তক হোয়াইট হাউজ ইয়ার্সে লিখেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র বেশ দ্বিধাগ্রহস্ত হয়ে পড়েছিল। একটি নির্মম সামরিক নির্যাতন, যার দ্বারা হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা করা হয়েছিল, সেটিকে অনুমোদন দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সমীচীন ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানই ছিল চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টির একমাত্র অবলম্বন।” হেনরি কিসিঞ্জারের বইতে আরো উল্লেখ রয়েছে যে সে সময়ে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ওয়াশিংটনে এই বলে বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে তিনি (কিটিং) হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে মর্মাহত। বাংলাদেশে কর্মরত কনসাল জেনারেল আর্থার ব্লাড এবং তার সহকর্মীগণ যে টেলিগ্রামে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের দ্বারা চালানো গণহত্যার কথা উল্লেখ করেছিলেন, হেনরি কিসিঞ্জার সে কথাও তার বইতে লিখেছেন। (সূত্র : হেনরি কিসিঞ্জার লিখিত ‘হোয়াইট হাউজ ইয়ার্স’)
১৯৭১-এর ২৭ মার্চ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড জানিয়েছিলেন যে ঢাকাস্থ বৃটিশ ডেপুটি-হাইকমিশনার তাকে এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছেন যে ২৫ তারিখ রাতে ডেপুটি হাইকমিশনার একটি ভয়াবহ রাত যাপন করেছেন। পরের দিন তিনি শহরের দিকে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলে রাস্তায় লাশের স্তূপ দেখে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ডেপুটি হাইকমিশনার আরো জানিয়েছেন যে পরদিন সান্ধ্য আইন শিথিল হলে দূতাবাসের এক প্রথম সচিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে দেখেন ইকবাল হলে রক্ত গঙ্গা বইছে, হত্যা করা শিক্ষক ও ছাত্রদের লাশ ছুড়ে গর্তে ফেলে দেয়া হয়েছে। (সূত্র : বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর লিখিত ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’)।
১৯৭১-এ বিশ্বের সব দেশের গণমাধ্যম বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে স্মরণকালের জঘন্যতম গণহত্যা বলে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আওতাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কারণ পাকিস্তানের প্ররোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতিতে বাধা প্রদান করতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশের শাসন চলে যায় বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল করা মোশতাক-জিয়ার হাতে, পাকিস্তান ঘেষা হওয়ায় যারা আর এ বিষয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। জিয়া পরবর্তীকালে এরশাদ এবং খালেদা জিয়াও পাকিস্তানকে তুষ্ট রাখার নীতি পালন করেছে। ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল ক্ষমতায় এলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সাজা হয়, ২০১৭ সালে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস বলে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি বেগবান হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মানে কি? ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কোনো কথা নেই। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলতে জাতিসংঘের স্বীকৃতিকেই ধরে নেয়া যায়। জাতিসংঘ সনদেও গণহত্যার স্বীকৃতি বলে কোনো বিধান নেই। কিন্তু সাধারণ পরিষদ এবং নিরাপত্তা পরিষদ গণহত্যার স্বীকৃতি প্রদান করে প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে নিশ্চয়ই। জাতিসংঘ সৃষ্টির পূর্বে জার্মানিতে নাৎসিদের দ্বারা চালানো গণহত্যা স্বীকৃতি পেয়েছে ন্যুরেমবার্গ এবং টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টির জন্য প্রণীত সনদে ব্যবহৃত ভাষার মাধ্যমে। জাতিসংঘ সৃষ্টির পর নিরাপত্তা পরিষদ রুয়ান্ডা, যুগোশ্লাভিয়া এবং কম্বোডিয়ার জন্য অস্থায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠনকে সে দেশগুলোতে গণহত্যার স্বীকৃতি বলা যায়। কেননা নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘে ছয়টি অঙ্গের একটি। প্রথম মহাসমরের সময় আর্মেনিয়ায় অটোম্যানরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, সেটিও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু আর্মেনিয় গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টির বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তাদের উপর গণহত্যা অতীতে লীগ অব নেশনস এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘের কোনো অঙ্গ প্রস্তাব পাশের আকারে স্বীকৃতি দিয়েছে এটা বলা যায় না। ১৯৯৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারস আর্মেনিয়ায় গণহত্যা হয়েছে মর্মে একটি প্রস্তাব পাশ করে। কিন্তু সেটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলা যায় না, কেননা এটা একটি সমিতি মাত্র, যেটি জাতিসংঘের কিছু নয়।
১৯৪৮ সালের মে মাসে জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুরোধে ড. করিম আজকুল যে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন, তাতে আর্মেনিয়া গণহত্যার বিবরণ প্রাধান্য পেয়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হলে অটোমেন সরকার অনেক ইয়াং তুর্কির বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের জন্য মামলা করে। ১৯২০ সালের ১০ অগাস্ট এক চুক্তি দ্বারা তুরস্ক যেসব ব্যক্তি হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তাদের গ্রেফতার এবং বিচারে আনতে বাধ্য হয়। ১৯৮৫ সালে আর্মেনিয়ান গণহত্যার উপর জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন গৃহীত হয়। জাতিসংঘের প্রিভেনশন অফ ডিসক্রিমেশন অ্যান্ড প্রটেকশন অব মাইনোরিটিস সাব কমিশন তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে ১৯১৫ সালে অটোম্যান শাসকগণ আর্মেনিয়াতে যা করেছিল তা গণহত্যা কনভেনশনের সংজ্ঞায় পড়ে। এমনটি উল্লেখ করে সাব কমিশন ১৯৮৫ সালে প্রস্তাব পাশ করে। এই প্রস্তাবকেও সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলা যায় কিনা, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ, কেননা ওই প্রস্তাব জাতিসংঘের ছয়টি অঙ্গের কোনোটিতেই পাশ হয়নি, হয়েছে জাতিসংঘের একটি সাব কমিশন দ্বারা। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ১৯৮৭, ২০০০, ২০০২ এবং ২০০৫ সালে আর্মেনিয়ায় জেনোসাইড হয়েছে বলে পোপ যে দাবি করেছেন, তা সঠিক মর্মে প্রস্তাব পাস করে। ২০০১ সালের ১৪ মে কাউন্সিল অব ইউরোপ ওই কাউন্সিলের সকল সদস্য রাষ্ট্রের কাছে আবেদন করে তাদের সংসদে যেন আর্মেনিয়ার জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তাছাড়া এ যাবৎ মোট ৩৪টি রাষ্ট্র এং তাদের সংসদ আর্মেনিয়ায় জেনোসাইড হয়েছিল মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও একই কথা বলেছেন। তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায় যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলতে যা বুঝায় সে অর্থে আর্মেনিয়ার গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে কিনা, কেননা জাতিসংঘের কোনো অঙ্গ এ ধরনের স্বীকৃতির পক্ষে কোনো প্রস্তাব পাশ করেনি। এটিকে বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আংশিক স্বীকৃতি বলাই সমীচীন।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) জাতিসংঘের ৬টি অঙ্গের একটি। এটি একান্তই একটি দেওয়ানি আদালত। সম্মতির ভিত্তিতে দুটি দেশের মধ্যে দেওয়ানি ধরনের বিরোধ মিমাংসা করাই এই আদালতের অধিক্ষেত্র। তবে ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের VIII অধ্যায়ে এই মর্মে বিধান রাখা হয়েছে যে কোনো সদস্য রাষ্ট্র জাতিসংঘের উপযুক্ত অঙ্গের নিকট (আইসিজে) এই মর্মে নালিশ করতে পারবে যেন উক্ত অঙ্গ (আইসিজে) কোনো রাষ্ট্রে সংঘটিত জেনোসাইড বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। জেনোসাইড কনভেনশনের উল্লেখিত বিধান মতে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইসিজেতে নালিশ করেছে। আইসিজে চূড়ান্ত শুনানির পর এই দুই দেশের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করলে সেখানে গণহত্যা হয়েছে মর্মে আন্তর্জাকিভাবে স্বীকৃত হবে, কেননা আইসিজে জাতিসংঘের একটি অঙ্গ।
বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা গণহত্যা করেছে এমন দাবি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বা নিরাপত্তা পরিষদ প্রদান করতে পারে। তবে নিরাপত্তা পরিষদ যুগোশ্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়ায় গণহত্যার বিচারে যে অস্থায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে, সে ধরনের ট্রাইব্যুনাল তারা বাংলাদেশে করতে পারবে না। তাছাড়া বিষয়টি সুদূর অতীতের বলে নিরাপত্তা পরিষদে এ ধরনের প্রস্তাব বিবেচনা বহির্ভূত বলে সিদ্ধান্ত হতে পারে। জেনোসাইড কনভেনশনের VIII অনুচ্ছেদের বিধান বলে আইসিজেতে এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নালিশ করার সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় একমাত্র সাধারণ পরিষদই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে গণহত্যা করেছে মর্মে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সেটিই হবে সত্যিকার অর্থে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এর জন্য প্রয়োজন হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রাষ্ট্রের ভোট। পাকিস্তান এর বিরোধিতা করবে, এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, কেননা পাকিস্তান নিজেই এ পর্যন্ত বাংলাদেশে গণহত্যার কথা স্বীকার করেনি এবং ক্ষমা চাইবে না, এমনটি আনুষ্ঠানিকভাবে বলছে। কয়েক মাস আগে জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনে ৭১-এর গণহত্যা নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করলে পাকিস্তান সরকার তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রতিবাদ করেছিল। পাকিস্তানের বিশিষ্ট বন্ধু চীন, যে দেশটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিল, সে কোন দিকে যাবে, তাও বলা যায় না। পাকিস্তান তার মিত্র দেশসমূহকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই আমাদের প্রচুর লবিং করতে হবে। আর্মেনিয়ার যেমন কয়েকটি দেশ নিজ দেশে প্রস্তাব পাশ করেছে, আমরা সে চেষ্টাও করতে পারি। এ ধরনের প্রস্তাবকে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসাবে গণ্য করা না গেলেও, এর ফলে সাধারণ পরিষদ প্রভাবিত হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে লবিং করেও ফল পাওয়া যেতে পারে।
১৯৭১-এ ঘটিত গণহত্যা প্রমাণের জন্য অনেক দালিলিক তথ্য রয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইন অনুযায়ী আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলার রায়সমূহ এবং এই মামলাগুলোতে যেসব তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোও অকট্য প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। তবে শহীদদের বধ্যভূমি ইত্যাদি বিষয়ে আরো কিছু তদন্ত প্রয়োজন।
দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশের মানুষ আন্তর্জাতিক লবিংয়ের মাধ্যমে জাতিসংঘকে প্রভাবিত করতে পারে। গণহত্যা জাদুঘর, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বিভিন্ন সাংবাদিক সমিতি এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা কেন্দ্রের বহিষ্কৃত পরিচালক, ড. ইমতিয়াজ আহমেদ তার প্রকাশিত পুস্তকে যে সব কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো স্বীকৃতি দাবির বিরুদ্ধে যেতে পারে। তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে ভাষাগত কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। কেননা, উর্দু এবং বাংলা দুটোই রাষ্ট্রভাষা ছিল এবং গোষ্ঠীগত কোনো পার্থক্যও ছিল না। উভয় প্রদেশের মানুষের মধ্যে বিবাহের প্রচলন ছিল। ড. ইমতিয়াজের এই সব উদ্ভট কথা মানলে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ গণহত্যার আওতায় আসে না। কেননা, কনভেশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীদের মধ্যে উল্লেখিত বিষয়ে পার্থক্য থাকা অপরিহার্য।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি এখন বেশ বেগবান। আর এই অবস্থা যেন ঝিমিয়ে না পড়ে সেই দিকে সরকার এবং সচেতন মহলসমূহের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে।
ঢাবি অধ্যাপকের বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর উপর অমার্জনীয় লেখনী
বোঝার ভুলে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ: অধ্যাপক ইমতিয়াজ
ড. ইমতিয়াজের হেঁয়ালি, নিজের লেখা গোপন করে প্রতিবাদলিপিতে মিথ্যাচার