ঢাবি অধ্যাপকের বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর উপর অমার্জনীয় লেখনী

গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইত্যাদি বিষয়ে যিনি নিজেই অজ্ঞতা এবং ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত, তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের কী শেখাবেন? তিনি নিশ্চয়ই জেনোসাইড সেন্টারে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং গণহত্যা নিয়ে ভ্রান্তিকর, উদ্ভট এবং মনগড়া কথাই শেখাবেন।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 29 March 2023, 07:15 AM
Updated : 29 March 2023, 07:15 AM

কয়েক সপ্তাহ আগে বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশে গণহত্যার ওপর গবেষণারত কয়েকজন আমার কাছে যে বইটি পাঠিয়েছিলেন, সেটি পড়ে আমার ভিমরি খাওয়ার দশা। বইটির লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন অধ্যাপক, নাম ইমতিয়াজ আহমেদ, যিনি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ’-এর প্রধান। যে কটি বিষয় আমার ভিমরি খাওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল, তার একটি হলো তার লেখা এই যে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলার পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলে তার ভাষণ শেষ করেছিলেন। ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’ নামক বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত অধ্যাপক ইমতিয়াজ লিখেছেন তিনি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিজে হাজির হয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে শুনেছেন। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের ইংরেজি ভাষায় লেখা বইয়ের উল্লিখিত অংশ বাংলায় তরজমা করলে যা দাঁড়ায়, তা নিম্নরূপ:

“পাকিস্তান শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণের জন্য তার ওপর দোষ চাপাতে পারত না, যেটি ছিল একজন রাজনৈতিক প্রতিভাবানের মাস্টার স্ট্রোক কেন না তিনি ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কিন্তু একই সাথে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলে তাঁর ভাষণ শেষ করেছিলেন। এটা উল্লেখযোগ্য যে ‘ইনডেপেন্ডেন্স’-এর বাংলা শব্দ স্বাধীনতা হলেও, এই শব্দটির একাধিক অর্থ হতে পারে, যথা ফ্রিডম। তাই ওই ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল, যেটি আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ, সেটি ভাবা ঠিক নয়।” তিনি আরও লিখেছেন, “এই বইয়ের লেখক সে সময়ের রেসকোর্স, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ উপস্থিত ছিলেন বিধায় পুরো ভাষণটি শুনতে পেরেছিলেন। এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কিছু লোক, যারা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন, তারা মুজিব জয় পাকিস্তান কথাটি বলেননি বলে দাবি করেন। আমি মনে করি তারা সম্ভবত শ্রবণ সমস্যার জন্য এমনটি বলেন। যারা মঞ্চের কাছে ছিলেন, অথবা মাইক্রোফোন থেকে দূরে ছিলেন তারা সম্ভবত শেষ কথাটি শুনতে পাননি, কেননা তখন হাজার হাজার লোক উত্তেজনাপ্রসূত হলে সেখানে প্রচুর চিৎকার ধ্বনিতে পরিবেশ এমন হয়ে গিয়েছিল যে তারা শেষ শব্দ অর্থাৎ জয় পাকিস্তান কথাটি শুনতে পাননি। এমনকি পাকিস্তান সরকার বা জুলফিকার আলি ভুট্টোও ওই ভাষণের পর মুজিবের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ আনেননি।” (পৃষ্ঠা ৪০)। অধ্যাপক ইমতিয়াজ বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি।

বিএনপির প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এই তত্ত্বের উদ্ভাবক। সাবেক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও একথা বলে নিন্দিত হয়েছিলেন। এমন কথা সাবেক এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারও তার বইয়ে লিখেছিলেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ হলে তিনি অবশেষে তার সে কথা ভুল ছিল বলে স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। জানা যায়, জনাব খন্দকার তখন বার্ধক্য অবস্থায় বিএনপি-জামায়াতের এবং অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী লোকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই লিখেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলে তার ভাষণে ইতি টেনেছিলেন। সেদিন লন্ডনে ছাত্র হিসাবে অবস্থানরত হলেও বিবিসি বাংলা বিভাগের সিরাজুর রহমান, কমল বোস, শ্যামল লোধ প্রমুখের সহায়তায় আমাদের কজনার সুযোগ হয়েছিল বুশ হাউজে বিবিসি বাংলা বিভাগের স্টুডিওতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পুরোটাই শোনার। তাই নিশ্চিত করে বলতে পারি বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান শব্দ উচ্চারণ করেননি। এমন বহু লোক যারা সেদিন রেসকোর্সে উপস্থিত ছিলেন, যাদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের অগ্রজ এবং দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলাম সাহেবেরও অনুজ, মাইনুল ইসলাম (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল) উপস্থিত ছিলেন তারাও নিশ্চিত করেছেন যে বঙ্গবন্ধু কখনো জয় পাকিস্তান বলেননি। গত ১৮ মার্চ বাংলা একাডেমিতে গণহত্যা জাদুঘরের অনুষ্ঠিত এক সভাকালে একাডেমির প্রধান কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, তিনিও সেদিন রেসকোর্সে উপস্থিত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু নিশ্চিতভাবে একথা বলেননি।

কিছু লোক বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার উদ্দেশ্যে এই অপপ্রচারটি চালাচ্ছে, নিশ্চিতভাবে অধ্যাপক ইমতিয়াজও তাদের গোত্রভুক্ত। এখানেই শেষ নয়। অধ্যাপক ইমতিয়াজ তার উল্লেখিত পুস্তকে এমন কথাও লিখেছেন যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে ১৯৭১-এ বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা ১৯৪৮ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশনের’ আওতায় পড়ে না। জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞাভুক্ত হতে হলে একটি মানবগোষ্ঠী কর্তৃক অন্য এক মানবগোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে হয়। এই পার্থক্য হতে পারে (১) জাতীয়, (২) নৃতত্ত্বগত, (৩) বর্ণগত, (৪) ধর্মগত। অর্থাৎ আক্রমণকারী এবং আক্রান্তগণ উপরে উল্লেখিত কোনো পার্থক্যভুক্ত না হলে জেনোসাইডের আওতাভুক্ত হয় না।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ লিখেছেন পাকিস্তানি এবং বাঙালিরা অভিন্ন। তার কথায় প্রাক্তন পাকিস্তানের দুই অংশের লোকই ধর্মগতভাবে এক। এ ব্যাপারে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু তিনি এও লিখেছেন যে উভয় প্রদেশের লোকই এক ভাষাভাষী কেননা বাংলাও গোটা পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষা। তার এই যুক্তি শুধু অবান্তরই নয়, হাস্যকরও বটে। এ কথা বলা সত্যিই উদ্ভট যে, বাংলা এবং উর্দু দুটিই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ছিল বৈ ভাষাগতভাবে দুই প্রদেশের মানুষ অভিন্ন ছিল। তার কথায় মনে হয় যে পূর্ব বাংলার সব মানুষই উর্দুতে কথা বলত এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরাও বাংলায় কথা বলত। এই যুক্তি ঠিক হলে ভারতের পাঞ্জাবি, গুজরাটি, বাংলাসহ সব ভাষাভাষী লোকদের অভিন্ন ভাষার লোক বলতে হয়, কেননা হিন্দি ভারতের রাষ্ট্র ভাষা। তিনি আরও লিখেছেন যে, দুই প্রদেশের মানুষকে আলাদা বর্ণ বা গোত্র (এথনিসিটি) ভুক্ত বলা যায় না, কেননা দুই প্রদেশের মানুষের মধ্যে বিবাহের ঘটনা এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগও বহুল আকারে ছিল। তার যুক্তি ঠিক হলে পৃথিবীর কোনো অঞ্চলের মানুষকেই অভিন্ন বলা যায় না, কেননা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়ত বৈবাহিক বন্ধন সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের এ ধরনের যুক্তিকে অর্বাচীনই বলতে হচ্ছে।

সম্প্রদায় হিসাবে বাঙালি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি, পাঠান, বালুচ ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য যে আকাশ-পাতালসম সে কথা অস্বীকার করে দুই প্রদেশের মানুষকে এক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ যা বলেছেন তা জ্ঞানের মাপকাঠিতে শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, তা হাসির উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য। যে সব লোক পাকিস্তানের অভিন্নতার পক্ষে ছিলেন বা আছেন তারাও বলেন না যে বাঙালি এবং পাকিস্তানিরা নৃতাত্ত্বিক অর্থে এক। দুই প্রদেশের কিছু মানুষের মধ্যে বিয়ে হয়েছে বলেই তাদের এক গোত্রভুক্ত বলা মানে পৃথিবীর সবাইকেই এক গোত্রভুক্ত বলা, কেননা গোটা বিশ্বের সকল অঞ্চলের মানুষের সাথে অন্য অঞ্চলের লোকদের বিয়ে হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি আইয়ুব খানও তার বই ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’-এ পরিষ্কারভাবে বাঙালি এবং পাকিস্তানিদের গোত্রগত পার্থক্যের কথা নোংরা ভাষাতেই বলেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়দের সাথে শারীরিক এবং চেহারাগত সাদৃশ্যপূর্ণ, দ্রাবিড়, অস্ট্রো এশিয়াটিক এবং তিব্বত-বার্মিজ মোঙ্গল রক্তে সৃষ্ট একজন বাঙালিকে ইরান-তুর্কি বৈশিষ্ট্যের এক পাকিস্তানির পাশে দাঁড় করালে, এমনকি ভিন্ন গ্রহ থেকে আগত কেউ তাদের পার্থক্য নিশ্চিত করতে ভুল করবে না। ড. ইমতিয়াজ দুই প্রদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের যে দাবি করেছেন, সেটি খণ্ডন করা জলবৎ তরলং।

তার দাবি ঠিক হলে ভাষা আন্দোলন হতো না, ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিত না, বাঙালি রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করত না, পাকিস্তানে ব্যবহৃত জিন্দাবাদ শব্দের পরিবর্তে ‘জয়’ শব্দ ব্যবহার করত না, শরৎ, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, সৈয়দ মুজতবা আলী, নজরুল, লালন, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্মের সাথে উর্দু, পাঞ্জাবি, পস্তু ভাষার লেখকদের সাহিত্যকর্ম অনুসরণ করতেন, যাদের খুব কম জনই পূর্ব বাংলায় পরিচিত এবং যাদের কাব্য-উপন্যাস পড়ার সক্ষমতা পূর্ব বাংলার কম মানুষেরই ছিল বা আছে।

অধ্যাপক ইমতিয়াজের ভৌতিক দাবি ঠিক হলে পূর্ব বাংলার মানুষ উত্তম-সুচিত্রা, জহির রায়হান, সৌমিত্র, শর্মিলা, সাবিত্রী, ছবি বিশ্বাস, ববিতা, রাজ্জাক, সুচন্দা, রহমানের ছবি না দেখে পাকিস্তানের উর্দু ছবির প্রতি আকৃষ্ট হতো। হেমন্ত, সন্ধ্যা, সলিল চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গীতা, প্রতিমা, সতীনাথ, শ্যামল, মানবেন্দ্র, ভূপেন হাজারিকা, কণিকা, সুচিত্রা মিত্র, রুনা, বন্যা, সাবিনা, পাপিয়া, কলিম শরাফী, ফাহমিদা প্রমুখের গান না শুনে পাকিস্তানি শিল্পীদের গান শুনতেন, যাদের খুব কম জনকেই পূর্ব বাংলার মানুষ চেনেন। যদি তাই হতো তাহলে পূর্ব বাংলার মানুষ আকাশ বাণী থেকে প্রচারিত গান না শুনে করাচি বা লাহোর বেতার শুনতেন। ড. ইমতিয়াজের মনে রাখা উচিত শুরুতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল দুই প্রদেশের মানুষের ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতার জন্য এবং পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর উর্দু ভাষা এবং তাদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার জন্য, বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর ছুরি চালানোর চেষ্টা করার জন্য, আরবি হরফে বাংলা লেখার আদেশ দেয়ার জন্য।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি চরম অবমাননা করে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, “একটি মৌলিক প্রশ্ন হলো, আসলেই কি ত্রিশ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, নাকি মৃতের সংখ্যা কম ছিল?” লিখেছেন, “ত্রিশ লক্ষ সংখ্যাটির প্রবক্তা ছিলেন বাংলাদেশী এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। .....অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার গঠিত হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায় ২৬ হাজার। উঁচু এবং নিচু সংখ্যাতত্ত্বের মধ্যে আরও কিছু সংখ্যার হিসাব পাওয়া যায় যার মধ্যে কে, চৌধুরীর অনুমান দশ লক্ষ থেকে ত্রিশ লক্ষ, রিচার্ড সিসন এবং লিও রোজের হিসাবে তিন লক্ষ, ...... আর রাও ফরমান আলীর হিসাবে ৪০ থেকে ৫০ হাজার” (পৃষ্ঠা ১৫)। প্রথমত, বাংলাদেশ বা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নয়, মস্কো থেকে প্রকাশিত প্রাভদা সংবাদপত্রে প্রথম বলা হয় ত্রিশ লক্ষের কথা। তারপর তা বলেন বঙ্গবন্ধু। এ ধরনের কথা অতীতে খালেদা জিয়াও বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। বাংলাদেশে হলকাস্ট ডিনায়েল আইন থাকলে এই অধ্যাপককে অবশ্যই সাজা পেতে হতো।

তার লেখায় রয়েছে যে ১৯৭০-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত ১৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার বিহারিকে হত্যা করা হয়েছিল। আরও লিখেছেন এটি সত্যি হলে তা তদন্তের দাবি রাখে এবং এ ধরনের মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সে সব বাঙালির অবশ্য বিচার করতে হবে যারা বিহারিদের হত্যা করেছে। (পৃষ্ঠা ৩৯)

সত্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ড. ইমতিয়াজ লিখেছেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পরও গণহত্যার বিচারের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, বরং ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই প্রক্রিয়া শুরু করে। তার ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে ২০০৮-এর নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছিল যে ক্ষমতায় গেলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর ওই প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়িত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, যে প্রক্রিয়ায় আপিল শুনানির একজন বিচারক হিসাবে এই লেখকের অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭৩-এর আইনটি পুনরায় প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে ইমতিয়াজ সাহেব আইন সম্পর্কে তার জ্ঞানশূন্যতারই জানান দিয়েছেন। ওই আইনটি সীমিত সময়ের জন্য ছিল না বিধায় একে আবার নতুন করে প্রণয়নের প্রশ্নই উঠতে পারে না, তা যে কোনো মোটামুটি শিক্ষিত মানুষেরই জানার কথা।

তার অজ্ঞতা আরও প্রকাশ পেয়েছে এই কথা থেকে যে সে আইনটি নাকি কম্বোডিয়া বা রুয়ান্ডা ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। উক্ত উক্তি তার অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। উনার জানা উচিত যে নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশের গণহত্যার বিচারের জন্য কোনো অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেনি বলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতে করার জন্যই স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপনায় ১৯৭৩-এ আইনটি প্রণয়ন করেছিল বাংলাদেশের সংসদ, যে কথাটি ১৯৭৩ সালের আইনে স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে এবং সম্ভাব্য জটিলতা রোধ করার জন্য সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, যেটি ছিল সংবিধানের প্রথম পরিবর্তন।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের সদস্যগণ বাংলাদেশে এসেছিলেন আমাদের ১৯৭৩-এর আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য এবং তারা আমাদের ১৯৭৩-এর আইন বহুলাংশে অনুসরণ করেই ‘রোম স্ট্যাচুট’-এর খসড়া তৈরি করেছিলেন, যার ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত সৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে। মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে সম্ভব ছিল না এই জন্য যে অতীতে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা ওই আদালতের নেই। আরও উল্লেখযোগ্য যে যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশসমূহে গণহত্যার বিচারের জন্য নিরাপত্তা পরিষদ যে সব অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে, মৃত্যুদণ্ড প্রদান করার ক্ষমতা সেসব ট্রাইব্যুনালের নেই, আর সে কারণে বাংলাদেশে ঘটানো গণহত্যাকারীদের বিচার বাংলার মাটিতে হওয়াই অপরিহার্য ছিল। 

প্রশ্ন হলো যে ব্যক্তি লিখেছেন বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ ‘জয় পাকিস্তান’ বলে বক্তব্য শেষ করেছেন, এই মর্মে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ১৯৭১-এর হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি, জেনোসাইড কনভেনশনের আওতাভুক্ত হতে পারে না, কেননা বাঙালি এবং পশ্চিম পাকিস্তানিরা নৃতাত্ত্বিক, ভাষা এবং সংস্কৃতিগতভাবে অভিন্ন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন আসলে কত বাঙালি ১৯৭১-এ শহীদ হয়েছিলেন, বলেছেন বাঙালিরা ১৫ থেকে ৫০ হাজার বিহারি হত্যা করেছে, যিনি ১৯৭৩-এর আইনকে বুঝতে পারেন না, তিনি অধ্যাপক হিসেবে ছাত্রদের যা বোঝাবেন তা তো বিভ্রান্তিকর হতে বাধ্য। যে ব্যক্তি এ ধরনের বিভ্রান্তিকর কথা তার বইয়ে লিখেছেন, তিনি কি করে জেনোসাইড সেন্টারের মতো একটি সেন্টারের প্রধান থাকেন? গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইত্যাদি বিষয়ে যিনি নিজেই অজ্ঞতা এবং ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত, তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের কি শেখাবেন?

তিনি নিশ্চয়ই জেনোসাইড সেন্টারে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং গণহত্যা নিয়ে ভ্রান্তিকর, উদ্ভট এবং মনগড়া কথাই শেখাবেন, যার ফলে ওই সমস্ত ছাত্রছাত্রীরাও ভ্রান্ত, ত্রুটিপূর্ণ এবং অবান্তর তথ্য নিয়েই কু-শিক্ষিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধ এবং গণহত্যা সম্পর্কে আসল তথ্য-উপাত্ত জানা থেকে বঞ্চিত হয়ে ইতিহাস বিকৃতির ধারা অব্যাহত রাখবেন। যিনি বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য বিকৃত করেন, গণহত্যা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর কথা বলেন, তিনি কীভাবে এখনও সরকারের ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুজন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন, কীভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিদেশে বাংলাদেশের গণহত্যার ওপরে বক্তৃতা দেয়ার জন্য নির্বাচিত হচ্ছেন? এর চেয়েও লঘুতর কারণে সিন্ডিকেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের শাস্তি দিয়েছে। তার নেতৃত্বে কি সেন্টার ফর জেনোসাইড চলা উচিত? ইউপিএলের মতো নামী সংস্থাইবা কীভাবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো বই প্রকাশ করে? এদের সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা উচিত। উল্লিখিত বইটির একটি জায়গায়ও ইমতিয়াজ সাহেব ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি লিপিবদ্ধ না করে সব জায়গায় ‘শেখ মুজিব’ লিখে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধাহীনতাই প্রকাশ করেছেন।