ড. ইমতিয়াজের হেঁয়ালি, নিজের লেখা গোপন করে প্রতিবাদলিপিতে মিথ্যাচার

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের বইটি এক দশকেরও আগে লেখা। যেহেতু ওই বইয়ের কোনো বক্তব্য অস্বীকার করেননি বা ভুল বলে প্রত্যাহার করে নেননি, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় অনেকদিন আগের ওই বক্তব্যেই তিনি অটল। সুতরাং এখানে তার ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বা ‘ভুল ব্যাখ্যা’ করা হচ্ছে বলে দাবির কোনো অবকাশ নেই।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 4 April 2023, 02:19 PM
Updated : 4 April 2023, 02:19 PM

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগসমূহ খণ্ডনের অপচেষ্টায় একই ধরনের ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছেন, যে ধরনটি তিনি তার বই ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’-এ অনুসরণ করেছেন। অপকৌশল অবলম্বন করে, পাঠকদের ধোঁকা দেয়ার জন্য তিনি মূল কথাগুলো বেমালুম চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সেগুলো যে তার বইটিতে মুদ্রিতভাবে রয়েছে, তা তিনি সম্ভবত ভুলেই গিয়েছিলেন। আজকের এই লেখার সঙ্গে আমি প্রতিটি সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠার ছবি সংযুক্ত করছি যাতে পাঠকগণ বুঝতে পারেন যে আমি যা লিখেছি, তা তার বই থেকে নিয়েই লিখেছি।

তার বিরুদ্ধে মুখ্য অভিযোগ তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের বিষয়ে (এখন বঙ্গবন্ধু শব্দ উচ্চারণ কৌতূহলোদ্দীপক বটে, কেননা তার বইয়ের একটি জায়গায়ও তিনি বঙ্গবন্ধু শব্দ উচ্চারণ না করে লিখেছেন ‘মুজিবুর রহমান’) তার ভাষায় ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ জয় বাংলার পর জয় পাকিস্তান বলেছিলেন বলে যে কথা তার বইয়ে স্পষ্টভাবে লিখেছেন, মানুষের চোখে ধাঁধা লাগানোর জন্য তিনি তার প্রতিবাদলিপিতে সে কথাটি বেমালুম চেপে গেছেন। বলেছেন তার বইয়ে লেখাগুলো নাকি আমরা ঠিকভাবে বুঝতে পারিনি। তার বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় (সংযুক্ত) তিনি লিখেছেন “পাকিস্তান শেখ মুজিবুর রহমানকে ৭ই মার্চের ভাষণের জন্য দোষ দিতে পারত না, কেননা তিনি রাজনৈতিক মাস্টারস্ট্রোক জিনিয়াসের মতো ঘোষণা করেছিলেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম (ইমানসিপেশন) এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি (শেখ মুজিব) জয় বাংলা জয় পাকিস্তান বলে তার ভাষণ শেষ করেছেন।” অথচ অধ্যাপক ইমতিয়াজ তার তথাকথিত প্রতিবাদলিপিতে বস্তুত প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে একথা চেপে গেছেন যে বঙ্গবন্ধু (তার ভাষায় শেখ মুজিবুর রহমান) জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান বলে ভাষণ শেষ করেছেন।

তিনি একই পৃষ্ঠায় আরও লিখেছেন “তার লেখা বইয়ের লেখক (দ্য অথার, অর্থাৎ অধ্যাপক ইমতিয়াজ স্বয়ং) ৭ই মার্চ রেসকোর্সে, বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত ছিলেন বলে ব্যক্তিগতভাবে পুরো ভাষণটি শুনতে পেরেছিলেন।” আরও লিখেছেন “উল্লেখযোগ্য যে কিছু লোক, যাদের মধ্যে অনেকে রেসকোর্সে উপস্থিত ছিলেন, তারা এই মর্মে দ্বিমত প্রকাশ করেন যে শেখ মুজিব ভাষণ শেষে জয় পাকিস্তান বলেননি। আমি (অধ্যাপক ইমতিয়াজ) মনে করি তারা শ্রবণগত অসুবিধার কারণেই (রিজন অব অডিবিলিটি) এ কথা বলছেন।” অধ্যাপক ইমতিয়াজের লেখা এতই স্পষ্ট যে এখানে তার লেখা নিয়ে ভুল বোঝা-বুঝির দাবি হালে পানি পেতে পারে না। বরং তিনিই মানুষের মনে বিহ্বলতা সৃষ্টির চেষ্টায় বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান দিয়ে শেষ করেছেন বলে যে কথা তার বইতে পরিষ্কারভাবে লিখেছেন, প্রতিবাদলিপিতে তা চেপে গেছেন। তিনি একই পৃষ্ঠায় (সংযোজিত) আরও লিখেছেন “এটা উল্লেখযোগ্য যে ইনডিপেনডেন্স শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ স্বাধীনতা, যার বহুবিধ অর্থ রয়েছে, ফ্রিডমসহ। তাই এটি ঠিক নয় যে সেই ভাষণটিতে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল, অর্থাৎ বেআইনি একতরফা বিচ্ছিন্নতার ডাক ছিল।” তিনি তার বইতে ৭ই মার্চের ভাষণের ওপর কাচি চালানো হয়েছে (এডিটেড) বলেও লিখেছেন। অতীতে যে দু-চারজন ব্যক্তি দাবি করেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলে ভাষণ শেষ করেছেন, পরবর্তীতে তারাই নিজেদের ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ড. ইমতিয়াজও কি এখন একইভাবে ভুল এবং মিথ্যাচার স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন?

শহীদদের সংখ্যার ব্যাপারে তিনি তার বইতে যা লিখেছেন, সে সম্পর্কে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে তার প্রতিবাদলিপিতে উল্লেখ করেছেন তিনি এ ব্যাপারে বিভিন্ন গবেষকের দেয়া তথ্য তুলে ধরেছেন মাত্র। কিন্তু তার বই বলছে অন্য কথা। বইটির ১৫ পৃষ্ঠায় (সংযুক্ত) অন্যদের মতামত প্রকাশের আগে তিনি নিজেই প্রশ্ন করে লিখেছেন, “এ মুট কোয়েশচেন ইজ, (অর্থাৎ বিতর্কিত প্রশ্ন) ছিল এই যে আসলেই কি ৩০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল নাকি মৃতের সংখ্যা আরও কম ছিল।” তিনি তার বইতে আরও লিখেছেন “৩০ লক্ষ মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যাটির দাবি এসেছে বাংলাদেশী এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের থেকে।” উপরের লিখিত কথাগুলো যে তার নিজের, সেটা সামান্য ইংরেজি জানা মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হবে না এবং সেখানেও ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই। কেউ ভুলে যাননি যে কিছুকাল আগে খালেদা জিয়া শহীদদের সংখ্যা নিয়ে একই ধরনের প্রশ্ন তুললে, তাকে তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ তার বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় (সংযুক্ত) লিখেছেন, “যদিও স্বয়ং মুজিবসহ সরকার ঘোষণা করেন যে ৩০ লক্ষ বাঙালি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে খুন হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচারের কথা উত্থাপিত হলে তাদের (সৈন্যদের) সংখ্যা ৪০০ থেকে ১৯৫ এবং পরে ১১৮ তে নেমে যায়। ৯ মাসে ৩০ লক্ষ খুনের দাবি একটি পরিসংখ্যানগত (স্ট্যাটিসটিক্যাল) দুঃস্বপ্ন হওয়া ছাড়াও এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিহতদের সংখ্যা নির্ধারণের পূর্ব-জ্ঞান, এমনকি তা নিশ্চিতকরণের পদ্ধতি জানা না থাকা ছাড়াও সরকার তাদের বিচার করতে ইচ্ছাকৃতভাবে সময় নষ্ট করছিল। অবশেষে ১৯৭৪ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে মুজিব এদেরকে ক্ষমা করে দেন। ... ঘটনাক্রমে ক্ষমা করে দেয়া মুজিবের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশে কোনো গণপ্রতিবাদ হয়নি, আর গণহত্যা বিষয়টিও অসন্তোষজনকভাবে পর্দার আড়ালে চলে যায়, অন্তত সে সময়ের জন্য।”

ওই একই পৃষ্ঠা ও এর পরবর্তী পৃষ্ঠা মিলিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, “১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে জন্ম নেয়া ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পক্ষপাতিত্বের লোভ সামলাতে পারেনি এবং বস্তুত সে সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগের লোকদের তাদের সঙ্গে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়, যার জন্য তাদেরকে ক্ষমতাসীন বিএনপির বিরাগভাজন হতে হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে কৌশলগত আঁতাত করে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হলে, নির্মূল কমিটির কর্মকাণ্ড প্রায় থেমে যায়, যখন গণহত্যা বিষয়টি পক্ষপাতিত্বের স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে জোরালো করার জন্য, এমন সময় যখন বিএনপি-জামায়াতের সখ্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। বিষয়টি তখন দলতান্ত্রিক (রেজিম) হয়ে যায় এবং আওয়ামী লীগ (১৯৯৬-২০০১) আমলে এবং বোধগম্যভাবে বিএনপি আমল (২০০১-২০০৬) পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে এবং সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এমন কিছু সদস্যের আগ্রহে, যারা মুক্তিযুদ্ধকালে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নতুন প্রেরণা পায়। ১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনও প্রণয়নের দাবি ওঠে। ... জনমতে নতুন জোয়ার জাগে, গণমাধ্যমসমূহ সরকারের কাছে দাবি তোলে, যে আইনের উদ্দেশ্য ছিল বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নেয়া যাতে কম্বোডিয়া অথবা রুয়ান্ডা ধরনের মতো বিচারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ পাওয়া যায়, সেটি বাস্তবায়িত করা। কিন্তু কার্যকর কিছুই লাভ করা যায়নি, যার জন্য মূলত সরকারের ব্যর্থতাই দায়ী।”

তিনি বইয়ের ৪১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, বাঙালিরা ১৫ থেকে ৫০ হাজার বিহারিকে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের মার্চ পর্যন্ত হত্যা করেছে। লিখেছেন “এটা ঠিক হলে, মানবাধিকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়ে থাকলে এবং বেআইনি হত্যাকাণ্ড চালানো হয়ে থাকলে, বিষয়টি তদন্ত করে দায়ী বাঙালিদের বিচার না করার এবং সাজা না দেয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না।”

সত্যকে মারাত্মকভাবে হত্যা করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ তার বইটির ১১ পৃষ্ঠায় (সংযুক্ত) লিখেছেন “এটা জানা কঠিন নয় যে শুধু যে বাংলাদেশী যোদ্ধারা ভারতীয় সামরিক নেতৃত্বের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন, তা নয়, বরং চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগ্রাম একান্তই ভারত-পাকিস্তান বিষয়ে পরিণত হয়েছিল।” শুধু তাই নয় তিনি চরম অজ্ঞতা অথবা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে লিখেছেন “১৬ ডিসেম্বর সই করা আত্মসমর্পণ দলিলও সেটি (ভারত-পাকিস্তান বিষয়) প্রমাণ করে, যাতে লেখা ছিল পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চল কমান্ড এই মর্মে সম্মত হয় যে বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল পাকিস্তানি সৈন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করবে।”

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আত্মসমর্পণ দলিল পড়ে থাকলে তার না জানার কারণ নেই যে সে দলিলে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে “পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চল কমান্ডের সৈন্যরা ভারতীয় এবং বাংলাদেশী সৈন্যদের (ফোর্সেস) পূর্বাঞ্চল কর্মক্ষেত্রের (থিয়েটার) সর্বাধিনায়ক, জগজিত সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করবে।” আত্মসমর্পণ নথিতে যে বাংলাদেশী যোদ্ধাদেরও উল্লেখ রয়েছে, অধ্যাপক ইমতিয়াজের কি তা জানা ছিল না, নাকি ভারত বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যই তিনি আত্মসমর্পণ দলিলে বাঙালি সৈন্যদের কথা এড়িয়ে গেছেন? “বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যায়ে ভারত-পাকিস্তান বিষয়ে রূপ নেয়” বলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ যা বলেছেন, সেটি জামায়াতসহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষেরই কথা।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ প্রতিবাদলিপিতে দাবি করেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোনো অবমাননাকর কথা তার বইতে নেই। উপরে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিকৃত করা ছাড়াও, তার বইটির ১২ এবং ১৩ পৃষ্ঠায় (সংযুক্ত) তিনি লিখেছেন যে শেখ মুজিব (তার ভাষায়) জনগণের কঠোর দুর্দশার কথা জেনেও গণহত্যার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন (“শেখ মুজিবুর রহমান ফলোয়িং হিজ রিটার্ন ফ্রম পাকিস্তান অন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ অ্যান্ড টেকিং দ্য রেইনস অব গভর্নমেন্ট পাওয়ার, কুড নট হেলপ বাট কুইকলি স্লাইড ইনটু দ্য টাস্ক অব লোকেটিং দ্য ইস্যু অব জেনোসাইড অন সিমিলার স্টেটিক কনসিডারেশন”)। জে এন দীক্ষিতের উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ লিখেছেন (পৃষ্ঠা সংযুক্ত) “শেখ মুজিব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার সিদ্ধান্ত হয়তো এ জন্য নিয়েছিলেন যে তিনি এমন কিছু করতে চাননি যা কিনা পাকিস্তান এবং মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।” দীক্ষিতের এই কথা পুনর্মুদ্রণ করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ নিজের মন্তব্যে লিখেছেন, “কিন্তু তাহলে মুজিব কেন সে সময়ে প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে এবং তাদের গভীর যাতনা (সাফারিং) সত্ত্বেও স্টেটিস্ট ডিসকোর্সের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?”

তিনি আরও লিখেছেন, “এ প্রশ্নের উত্তরে তিনটি আরগুমেন্ট সহজেই তুলে ধরা যায়। প্রথমত ৯ মাসব্যাপী কারারুদ্ধ এবং হত্যাযজ্ঞের স্থানে অনুপস্থিত থাকায়, এটি এমনি একটি বিষয় যাকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেয়া হয়নি। নেলসেন ম্যান্ডেলা অন্তরীণ থাকলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাদি তিনি জানতেন, কিন্তু শেখ মুজিব ৯ মাসকাল ছিলেন পুরোপুরি অন্ধকারে, জানতেন না বাংলাদেশে কি হচ্ছিল। গণহত্যা পরবর্তী তার জ্ঞান মূলত দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল, বিশেষ করে তার দলের চাটুকারদের দ্বারা ভাষ্য শোনার পর, যারা নিজেরাও তথ্যের অভাবে অথবা ইচ্ছাকৃত চাটুকারিতায় গা ভাসিয়েছিলেন।” তিনি তার বইতে আরও লিখেছেন “এ বিষয়ে (তথ্য) শূন্যতার কারণে চাটুকারেরা একটি দুঃখজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, নির্যাতন এবং মৃত্যুর সংখ্যার পক্ষে কোনো প্রমাণ ছাড়াই। বরং মুজিব গণহত্যা বিষয়ে যা বলতেন (তারা) তারই পুনরাবৃত্তি করতেন।”

অধ্যাপক ইমতিয়াজ পুনরায় দীক্ষিত সাহেবের সেই বক্তব্য উদ্ধৃত করেন, যাতে দীক্ষিত সাহেব ব্যক্ত করেছেন “মুজিবুর রহমান স্বয়ং হাকসারকে বলেছেন যে সাক্ষী-প্রমাণ সংগ্রহে অসুবিধার কারণে তিনি (শেখ মুজিব) যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সময় এবং শক্তি ক্ষয় করতে চান না।” তারপর অধ্যাপক ইমতিয়াজ তার নিজস্ব মন্তব্যে লিখেছেন, “কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সাক্ষী-প্রমাণের অভাব হলো? অন্যভাবে বলতে গেলে, বোদ্ধা সমাজের (সিভিল সোসাইটির) সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ, মুজিবকে এমন সব উপাদান প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যেগুলো যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের জন্য প্রয়োজন ছিল। সরকার এবং জনগণ স্টেটিস্ট ডিসকোর্সের পথে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর গণহত্যা বিষয়টি আগ্রহহীন বিচারে শেষ হয়েছে।”

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ তার বইয়ের XII পৃষ্ঠায় দাবি করেছেন যে ১৯৭১-এ বাংলার মানুষের ওপর আক্রমণ হয়েছিল শুধু রাজনৈতিক কারণে, কেননা ভাষাগত এবং গোত্রগত কোনো বিরোধ ছিল না। এ দাবির পক্ষে তার যুক্তি অতি অর্বাচীনসুলভ। তিনি বলেছেন বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা ছিল এবং দুই প্রদেশে প্রচুর আন্ত-গোত্রীয় বিয়ের কারণে, ভাষাগত বা গোত্রগত বিরোধ ছিল না। তার ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দাবি পাকিস্তানিরা কখনো মেনে নেয়নি এবং ৭১-এও তার প্রতিফলন ছিল। আর কিছু সংখ্যক বিয়ে হলেও গোত্রগত বিরোধও সবসময় বিরাজ করেছে। পাকিস্তানিরা যে মাছ-ভাতের বাঙালিদের ঘৃণার চোখে এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বংশধর বলে দেখত, যে কথা এমনকি আইয়ুব খানও লিখেছেন, সে কথা কারও অজানা থাকার কথা নয়। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সৈন্যরা ভাষা, সংস্কৃতি এবং গোত্রগত পার্থক্যকে বড় করে দেখে বাঙালি নিধনে ব্যস্ত হয়েছিল বলে অজস্র প্রমাণ রয়েছে। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশী নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার মূল কারণ ছিল তারা ভিন্ন গোত্রের বাঙালিদেরকে ক্ষমতা দিতে চাননি। সুতরাং এটি অস্বীকার করার কোনো পথ নেই যে মূলত বর্ণগত বিদ্বেষপ্রসূত হয়েই রাজনৈতিক সংকট এবং গণহত্যা শুরু হয়েছিল। অধ্যাপক ইমতিয়াজের দাবি ঠিক হলে ৭১-এ বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া প্রবাহকে গণহত্যা কনভেনশনভুক্ত করা যায় না, কেননা সেই কনভেনশন অনুযায়ী এক বৈশিষ্ট্যের মানব গোষ্ঠী কর্তৃক অন্য গোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে হয়, যাদের পার্থক্য হতে হয় জাতিগত, গোত্রগত, বর্ণগত অথবা ধর্মগত।

এ সমস্ত বক্তব্য দিয়েও তিনি গণহত্যা কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে পররাষ্ট্র দপ্তরের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘গণহত্যা বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব পালন করছেন। এ বিষয়ে সিভিল সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো যারা সামান্য কারণেও বিবৃতি দিতে ভুল করেন না তারা নিশ্চুপ। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। তারা কি এসব বক্তব্য এখন ঠিক বলে মনে করেন? অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের বইটি এক দশকেরও আগে লেখা। যেহেতু ওই বইয়ের কোনো বক্তব্য অস্বীকার করেননি বা ভুল বলে প্রত্যাহার করে নেননি, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় অনেকদিন আগের ওই বক্তব্যেই তিনি অটল। সুতরাং এখানে তার ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বা ‘ভুল ব্যাখ্যা’ করা হচ্ছে বলে দাবির কোনো অবকাশ নেই।

তিনি, (প্রমাণ উপস্থাপন না করে) দাবি করেছেন তার বই নাকি পাকিস্তানে বেআইনি করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি নিজেই তার বইটির শুরুতে লিখেছেন যে সাবা খাট্টাক নামক তার এক পাকিস্তানি বান্ধবীর দেয়া উৎসাহক্রমেই তিনি বইটি লিখেছেন। ওই মহিলা পাকিস্তানি একটি ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক। কেন এমন একজন পাকিস্তানি মহিলা, যিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনস্টিটিউটের পরিচালিক ছিলেন, ড. ইমতিয়াজকে বাংলাদেশে গণহত্যার ওপর বই লিখতে বললেন এবং কেনইবা ড. ইমতিয়াজ তার ওই পাকিস্তানি বান্ধবীর উপদেশ গ্রহণ করে বইটি লিখলেন, সে ব্যাপারে গণমনে প্রচুর প্রশ্ন অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই ঘুরপাক খাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, অতীতে শর্মিলা বসু নামক একজন পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর অর্থ সহায়তা পেয়ে বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারে অনেক নেতিবাচক কথা লিখেছিলেন।

বইটিতে বহু তথ্যগত ভুল রয়েছে, যেমন ৫ পৃষ্ঠায় (সংযুক্ত) তিনি জেমস স্টুয়ার্ট মিলের জায়গায় জন স্টুয়ার্ট মিলের ছবি ছেপেছেন, জন্ম তারিখও ভুল লিখেছেন। তিনি লিখেছেন ১৯৭৩-এর আইন নতুন করে প্রণয়নের কথা। এ আইনটি সাময়িক সময়ের জন্য প্রণীত হয়নি বরং সর্বকালের জন্য, তাই এটি নতুন করে প্রণয়নের কথা বলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আইন সম্পর্কে তার ভ্রান্ত জ্ঞানেরই পরিচয় দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন ১৯৭৩-এর আইনটির নাকি দুটি উদ্দেশ্য ছিল, একটি দেশে ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করা এবং অন্যটি জাতিসংঘকে এমনভাবে প্রভাবিত করা যাতে তারা কম্বোডিয়া এবং রুয়ান্ডার মতো বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করে। আন্তর্জাতিক আইনে যার সামান্য জ্ঞানও আছে, তিনিও বলবেন না যে আমাদের ১৯৭৩-এর আইনটির একটি উদ্দেশ্য ছিল কম্বোডিয়া বা রুয়ান্ডার মতো আন্তর্জাতিক অ্যাডহক বিচারালয় প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেয়া। আইনটি নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য করা হয়েছিল এবং সে বিচার বাংলাদেশেই হয়েছে এবং হচ্ছে (যে বিচারে আমিও একজন বিচারক ছিলাম, আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসাবে)।

যুগোস্লাভিয়া, রুয়ান্ডা প্রভৃতি দেশে গণহত্যা বিচারের জন্য অ্যাডহক বিচারালয় গঠন করেছিল নিরাপত্তা পরিষদ, আর সেই পরিষদেরই রয়েছে এ ধরনের অস্থায়ী বিচারালয় গঠনের ক্ষমতা। সুতরাং আমাদের ১৯৭৩-এর আইন দেখে নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের অস্থায়ী বিচারালয় গঠন করবে, এমন যুক্তি সত্যিই অজ্ঞতাপ্রসূত। তাছাড়া নিরাপত্তা পরিষদ যে সব ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে, এবং এমন কি স্ট্যাচুট অব রোম দ্বারা সৃষ্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেরও মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই, যা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না। ড. ইমতিয়াজ আইনস্টাইন, হেগেল, লরেন্স অলিভার প্রমুখ ব্যক্তিদের ছবি এবং সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বইটি পূরণ করেছেন, বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারে যাদের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নেই।

উল্লেখিত প্রতিবাদলিপির মাধ্যমে ড. ইমতিয়াজ জনমনে ধাঁধা সৃষ্টির জন্য যে অপকৌশল এবং মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন, তার ফলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায় নামতে বাধ্য। বাংলাদেশে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মতো ‘হলোকাস্ট ডিনায়েল’ আইন থাকলে, শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অপরাধে তার বিচার এবং সাজা হতো। ১৯৭৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য কোনো অ্যাডহক বিচারালয় গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে নিশ্চিতভাবে চীন এবং সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র তা ভেটো দিয়ে নাকচ করে দিত।