অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছেন, তার বইটি ভুলভাবে পড়া হচ্ছে।
Published : 02 Apr 2023, 06:58 PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের লেখা এক বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ‘ইতিহাস বিকৃতির’ অভিযোগ তুলে তার শাস্তির দাবি জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি সংগঠন।
তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণ এবং একটি উচ্চ ক্ষমতার তদন্ত কমিটি গঠন করে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে সংগঠনটি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে স্মারকলিপিও দেয় তারা।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ ১৪ বছর আগে লেখা তার ওই বই নিয়ে তোলা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ধরনের অভিযোগে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, এক্ষেত্রে তার বইটি ভুলভাবে পড়া হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি মতামত কলাম লেখেন। ওই লেখায় তিনি সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজের লেখা ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’ (২০০৯) বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলেন।
মানববন্ধনে বিষয়টি তুলে ধরে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, বইটির ৪০ পৃষ্ঠায় তিনি (অধ্যাপক ইমতিয়াজ) লিখেছেন- ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিজে হাজির হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বক্তব্যের শেষে ‘জয় বাংলা’ বলার পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে শুনেছেন।
“বইটিতে এমন কথাও লিখেছেন, যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, ১৯৭১-এ বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের আওতায় পড়ে না। জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞাভুক্ত হতে হলে একটি মানবগোষ্ঠী কর্তৃক অন্য এক মানবগোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে হয়। বাঙালির ক্ষেত্রে নাকি তা ঘটেনি।”
সাবেক এই বিচারক বলেন, “অধ্যাপক ইমতিয়াজ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি চরম অবমাননা করে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘একটি মৌলিক প্রশ্ন হল, আসলেই কি ত্রিশ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, নাকি মৃতের সংখ্যা কম ছিল?’
“তিনি প্রশ্ন তুলেছেন আসলে কত বাঙালি একাত্তরে শহীদ হয়েছিলেন, বলেছেন বাঙালিরা ১৫ থেকে ৫০ হাজার বিহারি হত্যা করেছে। তার এমন দুঃসাহসিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ লেখনীর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
অধ্যাপক ইমতিয়াজকে অপসারণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি এ ধরনের বিভ্রান্তিকর কথা তার বইয়ে লিখেছেন, তিনি কী করে জেনোসাইড সেন্টারের মতো একটি সেন্টারের প্রধান থাকেন? গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইত্যাদি বিষয়ে যিনি নিজেই অজ্ঞতা এবং ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত, তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের কী শেখাবেন?”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা মনে হচ্ছে, তারা লেখাটা ভুল বুঝেছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে আমি শিগগিরই একটি ব্যাখ্যা লিখিত আকারে দেব।”
পরে লিখিত বিবৃতিতে তিনি বলেন, যে বই লেখার উদ্দেশ্য ছিল একাত্তরের গণহত্যার বিচারের, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ খোলার পথ তৈরি করা, সেই বইয়ে গণহত্যার বিষয়টি অস্বীকার করা হয় কীভাবে?
“তাই এই ধরনের অভিযোগ আমার কাছে অবাস্তব ঠেকছে। আমার বিশ্বাস, আমার লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।”
বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোনো অসম্মান করেননি উল্লেখ করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেছেন, ৭ মার্চ না হয়ে ২৬ মার্চ কেন স্বাধীনতা দিবস, বইটিতে তার ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্ব খাটো করতে তার সেই লেখা ব্যবহৃত হওয়ায় তা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করছে।
একাত্তরের গণহত্যা খাটো করার কোনো প্রয়াস চালাননি দাবি করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, পাকিস্তানিরা কত সংখ্যক বাঙালিকে হত্যা করেছিল, সে বিষয়ে বিভিন্ন গবেষকের বিভিন্ন তথ্য থাকার বিষয়টি বইয়ে শুধু উল্লেখ করা হয়েছিল।
এই বইটি পাকিস্তান নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল এবং এর লেখক হিসেবে তাকে ২০১৪ সালে করাচি ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে যেতে বাধা দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
এদিকে মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, “অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ যে অপরাধ করেছেন, সেটা অমার্জনীয়। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
“অধ্যাপক ইমতিয়াজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে চরমভাবে অবমাননা করেছেন। তার জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে পারে না। গণহত্যা গবেষণা কেন্দ্রে সে থাকতে পারে না। তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, “স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসেও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র দেখতে হচ্ছে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আমরা কোনো আপস করব না। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা মানে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অবমাননা করার শামিল।
“মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিরা নানাবিধ ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এদের বিরুদ্ধে একাত্তরের ন্যায় তরুণ প্রজন্মকে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট আহ্বান জানাই, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণ না করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশব্যাপী কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।”
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন বলেন, “বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে অধ্যাপক ইমতিয়াজ চরমভাবে অবমাননা করে দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এই বইয়ের প্রকাশক ইউপিএলকেও এর দায়ভার নিতে হবে।
“সরকারের নিকট দাবি, অবিলম্বে এই বই বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সুতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কর্তৃক মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড কখনোই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি মেনে নিবে না।”
আরও পড়ুন
ঢাবি অধ্যাপকের বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর উপর অমার্জনীয় লেখনী