Published : 08 Feb 2017, 12:43 PM
এক দল আরেক দলকে মানবে না, একে অপরের বিরোধিতা করবে, শুধু এই একটা ইস্যু ছাড়া আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো ইস্যুতেই কখনও একমত হয় না। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়েও হয়নি। ইতোমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির হতাশা ও ক্ষুব্ধতার আভাস মিলেছে। বিতর্কিত ও দলীয় আস্থাভাজনদের দিয়ে কমিশন পুনগর্ঠন করা হয়েছে বলে মনে করছে দলটি।
বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়েই বেশি আপত্তি তাদের। নতুন কমিশনে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। 'রকিব-মার্কা' আরেকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন দলের নেতারা। তাদের অভিযোগ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেই নুরুল হুদা জনতার মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তাঁর নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত উপস্থিত থেকেছেন। কাজেই তাঁকে মানা যাবে না!
এ ধরনের অভিযোগের সমস্যা হল, এখন যদি বিএনপি প্রস্তাবিত কমিশনার সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আপত্তি জানায় এবং এভাবে পাল্টাপাল্টি চলতে খাকে, তাহলে কি আদৌ কোনো 'অবিতর্কিত' কমিশন গঠন সম্ভব?
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এ কে এম নুরুল হুদা ও কমিশনার হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী, সাবেক সচিব রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব তালুকদার ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কবিতা খানমকে নিয়োগ দিয়েছেন। যথারীতি নতুন এই নির্বাচন কমিশনকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। আর বিএনপি সমালোচনা ও বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন:
"নতুন নির্বাচন কমিশনে বিএনপির প্রস্তাব করা নাম থেকে যেমন একজন নিয়োগ পেয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত নাম থেকেও তেমন একজনই নিয়োগ পেয়েছেন। তবুও বিএনপির সমালোচনা ছাড়তে পারেনি। এটা তাদের পুরনো অভ্যাস। তারা যেসব নাম প্রস্তাব করেছে তাদের সবাইকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলেও বিএনপি বলত, মানি না।"
ওবায়দুল কাদের মিথ্যে বলেননি, যদিও এটা আওয়ামী লীগের জন্যও প্রযোজ্য। এখন বিএনপি যদি ক্ষমতায় থাকত এবং এই নির্বাচন কমিশনই গঠন করত, তাহলে আওয়ামী লীগের ভূমিকা বিএনপির চেয়ে পৃথক হত বলে মনে হয় না। আসলে আমাদের দেশে 'বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা' করা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সমালোচনা থাকবেই। স্বর্গের দেবতাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করলেও কেউ-না-কেউ তার খুঁত বের করবে।
নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য যে প্রক্রিয়ার অনুসরণ করা হয়েছে, তাতে সমালোচনা করার তেমন কিছু নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে ১১৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আর চার জন কমিশনার নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে নির্বাচন কমিশন গঠনই রীতি। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনার পর সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। সার্চ কমিটিও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনের সদস্য হিসেবে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করে।
সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নাম থেকে রাষ্ট্রপতি এ কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর চারজন কমিশনারকে নিয়োগদান করেন। কাজেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। তবে কারও কারও ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক দলের আপত্তি থাকতেই পারে। থাকাটা অস্বাভাবিকও নয়। কেননা কোনো মানুষই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। দলের লোক হয়েও কেউ দলবাজির ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আবার 'দলনিরপেক্ষ' ব্যক্তিও আকস্মিক বিশেষ কোনো দলের জন্য জান কোরবানে প্রস্তুত হতে পারেন।
আসল বিষয় হল ব্যক্তির নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা– পদ ও দায়িত্বের প্রতি সৎ ও দৃঢ় থাকার অঙ্গীকার। যদি মেরুদণ্ড সোজা করে কেউ চলতে চান, তাকে নোয়ানো সহজ কাজ নয়। আর কারও মেরুদণ্ড সোজা না ক্ষমতাসীনদের প্রতি নোয়ানো, তা চেহারা দেখে, অতীতের ছিটেফোঁটা ভূমিকা দেখে হলপ করে বলে দেওয়া যায় না। এর জন্য পরীক্ষা প্রয়োজন। কর্মের মধ্য দিয়েই তা প্রমাণিত হবে।
মনে রাখতে হবে, 'বিড়াল কালো না ফর্সা, লম্বা কি খাটো, বিছানায় শোয় না খড়ের গাদায়, তাতে কিছুই যায়-আসে না– বিড়ালটি ইঁদুর ধরে কি না সেটাই আসল'।
বিতর্কিত করতে চাইলে যে কাউকেই বিতর্কিত করে তোলা যায়। কারও নামে একটা অভিযোগ তুলে কিংবা কোনো একটা কলঙ্ক রটিয়ে দিয়ে বলা যায় যে, লোকটি বিতর্কিত। এটা সভ্য সমাজের আচরণ হতে পারে না। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়, নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সহযোগিতা করা উচিত। কমিশনকে তাদের আরাধ্য কাজ যথাযথভাবে করার সুযোগ সবাই মিলে করে দিতে হবে।
মনে রাখা দরকার যে, নির্বাচন কমিশন যেনতেন প্রতিষ্ঠান নয়। এ দেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় তার ভূমিকা আক্ষরিকভাবেই বিশিষ্ট। সেখানে যারা নিযুক্ত হবেন, তারা কেবল যোগ্য হলেই চলবে না, বহুজনসম্মতভাবে যোগ্য হতে হবে। অর্থাৎ তিনিই যে উপযুক্ত ব্যক্তি, এ বিষয়ে যেন সাধারণ মহলে কোনো প্রশ্ন বা সংশয়ের জায়গা না থাকে, সেটা তাদের আচরণ ও কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠানটি কেবল গুরুত্বপূর্ণই নয়, অনেক সংবেদনশীলও বটে। নির্বাচন কমিশন সব সময় বিরোধীদের টার্গেট। হারলে তো কথাই নেই। লোকসমক্ষে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের কারসাজিতে হারতে হল। পরাজয়ের লজ্জা থেকে রেহাই পাওয়ার এমন সহজ রাস্তা আর কোথায়? যেন জেতা গেম জোচ্চুরি করে হারাল রেফারি।
রাজনীতিতে সত্যি-মিথ্যে এমনভাবে মিশে থাকে যে, আলাদা করা কঠিন। অ্যাডলফ হিটলারের সাগরেদ গোয়েবলস বলতেন, একটা মিথ্যা তিন বার বললে সত্যি হয়ে যায়। মানুষকে বোকা বানানো খুব একটা কঠিন নয়। আমাদের রাজনীতিতে এখনও সেই গেয়োবলসীয় তত্ত্বেরই প্রয়োগ চলছে। অথচ কাগজে-কলমে দেশটা এখনও গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। তাকে আঘাত করে ভাঙার চেষ্টা অমার্জনীয় অপরাধ। তবু আমরা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে সব সময়েই বিরোধিতাকে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করি।
পৃথিবীর খুব কম দেশেই এটা দেখা যায়। আসলে সমস্যা আমাদের মানসিকতায়। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ভারতের নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি হলেও তাদের মতো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছে না। কেন? কারণ আমরা হেরে যাবার, পরাজয় মেনে নেবার মানসিকতা অর্জন করতে পারিনি। আমরা কেবলই জিততে চাই। কিন্তু নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই।
এ কথা ঠিক যে, নির্বাচন কমিশন অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করে। অনেক জায়গায় জাল-জোচ্চুরি-প্রহসনের ভোট চলে। পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে থাকে। সেই অনিয়ম বন্ধ করার যৌথ দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। যে দল যে এলাকায় শক্তিশালী সেখানে জুলুম চালালেই এটা হয়। সব দল যদি নিজেদের নেতা-কর্মীদের সংযত রাখতে পারে তা হলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এখানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা গৌণ।
রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা পরিবর্তন ছাড়া আমাদের রাজনীতিতে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না। তা সে স্বর্গের যে দেবতাকেই নির্বাচন কমিশনারের চেয়ারে বসানো হোক না কেন।
পুনশ্চ: অনেকে বলতে পারেন, বিএনপি যদি বর্তমান নির্বাচন কমিশন মেনে নেয়, এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যায়, তারপর এই কমিশন যদি আওয়ামী লীগের বশংবদ হয়ে প্রহসনের নির্বাচন করে বিএনপিকে হারিয়ে দেয়, তাহলে কী হবে? তখন তো পুলিশ-র্যাব আর আওয়ামী লীগের ঠ্যাঙারে বাহিনী বিএনপিকে দেশছাড়া করে ছাড়বে।
তেমন অবিচার যদি সত্যি হয়, আমি বলব, দেশের সাধারণ মানুষই তখন রুখে দাঁড়াবে। অন্যায়-জুলুম-অত্যাচারকে মানুষ দীর্ঘদিন মেনে নেয় না। আপাতত বিএনপিকে রাজনীতির ইতিবাচক ধারায় শামিল হতে হবে। বিরোধিতা আর সমালোচনার নেতিবাচক রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে। গঠনমূলক বিরোধিতা দিয়ে আওয়ামী লীগকে কাবু করতে হবে।
রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণে এবার ভুল হলে গত নির্বাচনের মতো বিএনপিকে আম-ছালা দুটোই হারাতে হতে পারে।