কী মনে হয়, এই তরুণ-তরুণীরা সবাই রাজাকার হয়ে গেছে, আর আমরা সবাই দেশপ্রেমী! এই আমরা কারা? এই আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, আধমরাদের দল।
Published : 04 Aug 2024, 08:46 PM
লেখাটা শুরু করি একটা কাহিনি দিয়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে কিছু লিখব। তবে যাকে কাহিনি বলছি, সেটা ঠিক কাহিনি নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আজ থেকে কয়েক বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে হজে গিয়েছিলাম। মূল হজের তিন দিন আগে মক্কার নিকটবর্তী আজিজিয়াতে এক হোটেলে উঠেছি। একই হোটেলে দেখা হয়ে গেল আমার অনুজসম সুহৃদ সুমন খানের সঙ্গে। হারাম শরিফ থেকে আজিজিয়ার দূরত্ব ৬-৭ কিলোমিটারের মতো। ফজরের নামাজ শেষে নাস্তা পর্ব সেরে, আমি আর সুমন আজিজিয়ায় প্রথম দিনের ভোরেই হোটেলের সামনে দুটো চেয়ার নিয়ে বসে আছি।
চারিদিকে দেখছি আর কথা বলছি। একটু পরই প্রখর রোদে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে তার পূর্বাভাস। আমরা যেখানে বসে আছি তার থেকে একটু দূরেই এক তরুণ রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে আর একটু পর পর আমাদের দুজনের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটি ঝাড়ু দিতে দিতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই চোখাচোখি হলো। দেখেই বোঝা যায় বাংলাদেশি। আমি খেয়াল করেছি মক্কা-মদিনাতে যে সমস্ত শ্রমিক কাজ করে তাদের ভেতর থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সহজেই চিনে নেওয়া যায়। এদের চাহনি, চলাফেরার ভেতর একটা আড়ষ্টতা থাকে। মলিন চেহারা, চোখে মুখে সার্বক্ষণিক একটা বিষণ্ণভাব।
আমি সরাসরি জানতে চাইলাম, তুমি বাংলাদেশি? বলল, জ্বি স্যার। আমি আবার প্রশ্ন করি, বাড়ি কোথায়? বাড়ি কোন জেলায় তা-ও বলল। নামও বলেছিল। কিন্তু নামটা ভুলে গেছি। ধরে নিই ছেলেটা বলেছিল তার নাম আরমান।
এভাবে টুকটাক করে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলছি। তার পরনে পুরোনো একটা জিন্স হাঁটু পর্যন্ত গোটানো। গায়ে চেক প্রিন্টের একটা হাফ হাতা শার্ট। মাথা ভর্তি ঘন ঝাঁকড়া চুল, ধুলোয় রুক্ষ আর এলোমেলো। মাঝারি গড়ন, একদম শুকনা পাতলা না। দেখেই বোঝা যায়, নিম্ন মধ্যবিত্ত ভদ্র ঘরের সন্তান। একই সঙ্গে শিক্ষিত। আসলেও তাই। বাবা কোনো এক সংস্থায় অফিস সহকারীর কাজ করত। হঠাৎ স্ট্রোক করেন, প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী। চার ভাই-বোনের ভেতর আরমান সবার বড়। দুই বোন, ছোট একটি ভাই আর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে মায়ের কোনোরকমে দিন চলে যায়। আরমান স্থানীয় কলেজে স্নাতক পর্যায়ে পড়ত। পরে আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। আরও অগণিত শ্রমিক যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বা বিদেশে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে দেশ ছাড়ে, আরমানেরও এই পবিত্র নগরীতে সেভাবে আসা। অল্প-স্বল্প সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে, ধার-দেনা করে, দালাল ধরে এদেশে আসা।
ছেলেটি আমাদের সঙ্গে কথা বলছে আর ভীত চোখে বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। গাড়ির দিকে তাকিয়ে তার মুখ কালো হয়ে গেল। সে দ্রুত রাস্তার ওইপারে চলে গেল। আমার আর সুমনের কিছু কেনার প্রয়োজন ছিল। আমরা ভেবেছিলাম ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করব কোথায় পাওয়া যাবে। যাই হোক, রোদ বাড়ছে। আমরা ভেতরে যাওয়ার জন্যে দাঁড়িয়েছি। ছেলেটা আবারও আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। সুমন ছেলেটির কাছে আমরা যা চাচ্ছি তা কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাইল। ছেলেটি বলল তাকে টাকা দিলে সে এনে দিতে পারবে। বিকেল পাঁচটার দিকে তার কাজ শেষ হলে এনে দিতে পারবে। তাকে সৌদি রিয়েলের একটা নোট দেওয়া হলো। বিকেলে আমরা আছরের নামাজ শেষে আবার চেয়ার নিয়ে ওই জায়গাটাতে বসে আছি। ছেলেটা এসে আমাদের জিনিসগুলো দিয়ে দাঁড়াল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা সকালে তুমি একটা গাড়ি দেখে ওইভাবে ভয় পেয়ে চলে গেলে কেন?
“স্যার! ওই গাড়িতে আমার কাজের সুপারভাইজার ছিল। আমার সুপারভাইজারও বাংলাদেশি। সে যদি দেখে আমি আপনাদের সাথে কথা বলতেছি, বার বার আমার কাছে জিজ্ঞাসা করবে, কেন আপনাদের সাথে কথা বলছিলাম, কী কথা বলতেছিলাম, আপনারা আমাকে কোনো টিপস দিয়েছেন কিনা এইসব। হজ করতে আসা কারও সঙ্গে কথা বলতে দেখলেই আমাদের সুপারভাইজাররা ধরে নেয় তারা আমাদের কিছু অর্থ দিয়েছে আর ওই অর্থের ভাগ তাদেরও দিতে হবে। অর্থ পাই বা না পাই সুপারভাইজারের কেউ যদি দেখে আমরা কোনো হাজির সাথে কথা বলছি, আমাদের কাছে এসে অর্থ চাইবেই। যদি কেউ না দেয় তাহলে তাকে দূরে মরুভূমির ভেতর কোনো এক নির্জন জায়গায় কড়া রোদের ভেতর ঝাড়ু দেওয়ার কাজে পাঠিয়ে দেবে।
“এখানকার স্থানীয় সৌদি নিরাপত্তা রক্ষীরাও সুপারভাইজারদের হয়ে স্পাইং করে। এরাও যদি দেখে যে আমরা বাংলাদেশি শ্রমিকেরা কোনো ভিজিটর বা হাজিদের সাথে কথা বলছি তারা সুপারভাইজারদের কাছে রিপোর্ট করে দেয় বিনিময়ে সুপারভাইজাররা তাদের অর্থ দেয়। স্থানীয় নিরাপত্তারক্ষীরাও বাংলাদেশি সুপারভাইজারদের দেখে আমাদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া শিখে গেছে। আমরা আর পাকিস্তানিরা একই ধরনের চুক্তিতে আসি একই ওয়ার্ক পারমিটে আসি, তারপরেও ওরা আমাদের থেকে বেশি বেতন পায়। আমরা বাংলাদেশিরা কাজ করি খোলা রাস্তায়, খোলা চত্বরে, প্রচণ্ড রোদের ভেতর। আর ওরা কাজ করে শপিংমলের ভেতরে, মসজিদের ভেতরে, হারাম শরিফের ঠান্ডা পরিবেশে বিল্ডিংগুলোর ভেতরে।
“স্থানীয় নিরাপত্তারক্ষীরা ওদেরকে কিছুই বলে না, বলার সাহসই নাই। ওদের কোনো সমস্যা হলে সবাই এক হয়ে যায়, তাদের অ্যাম্বাসির লোকজন ছুটে আসে। আর আমি আজ পর্যন্ত আমাদের অ্যাম্বাসির কাউকে চোখেই দেখিনি। ওরা আর আমরা একই কাজ করি, ওদের অনেক শ্রমিক আছে যারা কোনো লেখাপড়াই জানে না, ওই পাহাড়ের কাছাকাছি গ্রামগুলো থেকে আসে। তারপরও তাদের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি।”
আরমান একটু থামে। তাকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়। সে তার সঙ্গে বয়ে বেড়ানো জীর্ণ মলিন ব্যাগ থেকে একটা পানির বোতল বের করে কয়েক ঢোক পানি খেল। বোতলটা ব্যাগে না ঢুকিয়ে হাতেই ধরে রাখে। আরমান বলে, “একটা কথা বলব স্যার?”
“কী, বল!”
আরমান বলে, “স্যার আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা বোধহয় পাকিস্তানের সাথে থাকলেই ভালো থাকতাম!”
নিজের অজান্তেই আমার চেহারা থমথমে হয়ে যায়। এই হয় আমার। আমি জীবনে অনেক কিছু সহ্য করতে পারি। কিন্তু কিছু শব্দ যেমন পাকিস্তান, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, স্বাধীনতাবিরোধী যেকোনো শব্দ আমার মাথার ভেতরে গ্রেনেডের পিন খুলে দেয়।
আরমান বোধহয় আমার ভাবান্তর লক্ষ্য করে। সে বলে, “স্যার বেয়াদবি নেবেন না। আমি এমনিই বলে ফেলেছি। আমার বাবারা ছিলেন চার ভাই। আমার তিন চাচাই মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। শুধু আমার বাবাই বেঁচে আছেন। আপনাকে একটা কথা বলি স্যার, আমরা অনেকেই ওদের সঙ্গে কথাও বলি না।”
আমি আর সুমন দুজনেই আরমানের কথা শুনছি। ছেলেটির বোধহয় আজ মন বেশি খারাপ। এই বিকেলে তার চেহারা আরও মলিন লাগছে। চোখ দুটোও লাল।
আরমান আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখে নিল। সে কথা বলছে, আমরা শুনছি। “রাতে ঠিক মতো ঘুম আসে না স্যার। তখন এই আবোল-তাবোল চিন্তাগুলো মাথায় আসে।” ছেলেটা খুব বিমর্ষ হয়ে গেছে। দেখে খুব খারাপ লাগে। প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্যে আমি বলি, “সামনে তো ঈদ। ঈদের দিন কী কর?”
“স্যার ঈদের দিন আমাদের আরও বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। তাছাড়া স্যার ঈদের দিন ভালো সালামিও পাওয়া যায়। কাজেই ঈদের দিন আমরা কেউ কাজ মিস দিতে চাই না।”
আমি জিজ্ঞাসা করি, “ঈদের দিন কী খাও? রান্না করো না?”
“না স্যার, করা হয় না। সারাদিন রোদের ভেতর রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে আর রান্নার ঝামেলায় যেতে ইচ্ছে করে না। ঈদের জামাতে স্থানীয়রা খেজুর দেয়, রুটি দেয় তাই এনে খাই। ঈদের দিন রোদের ভেতর রাস্তায় ঝাড়ু দিই, মা ফোন করে। জিজ্ঞাসা করে, বাবা ঈদের নামাজ পড়ছ? মাকে মিথ্যা কথা বলি স্যার, বলি, পড়ছি মা।”
মা জিজ্ঞাসা করেন, “সকালে কি খাইছিস বাপ।”
“মা আমরা কয়েকজন মিলে সেমাই আর খিচুড়ি রাঁধছি। সেইটা খাইছি। আজ আমরা সবাই ছুটি নিছি। দুপুরে সবাই পোলাও-কোরমা রান্না করব, ঝাল গোস্ত রান্না করব, তাই খাবো।
“কাঁদো কাঁদো গলায় মা আবারও বলেন, ভালো করে খাস বাপ, পেট ভরে খাস।
“আচ্ছা মা। বলে ফোন রেখে দিই।
“আচ্ছা স্যার বলেন তো মার কাছে কি সত্যি বলা যায় যে, মা আমি রোদের ভেতর রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছি। শুনলে মায়ের কেমন লাগবে কন তো স্যার!”
আমি আর সুমন স্যাতস্যাতে মন নিয়ে হোটেলের ভেতর চলে আসি।
পরদিন সকালেই মিনায় চলে যাব। গেটের সামনে আমি আর সুমন বসে আছি। আরমান গুটি গুটি পায়ে কাছে এল। সঙ্গে আরেকটি ছেলে। সৌদিদের কথা জিজ্ঞাসা করি, শ্রমিকদের কফিলদের নিয়েও অনেক কথা শোনা হলো। বার্মিজদের কথা জিজ্ঞাসা করি, টুকিটাকি জিজ্ঞাসা করি। মিনায় যাওয়ার বাস এসে গেছে। আমি ওয়ালেট থেকে রিয়েলের দুটো নোট বের করে একটা ওকে দিলাম আরেকটা ওর সঙ্গের ছেলেটাকে। বললাম, “এতদিন এই প্রবাসে আছো নিশ্চয়ই ঈদের দিন নিজের জন্যে কিছুই কেনোনি। এই টাকা দিয়ে তোমরা নিজেদের জন্যের ঈদের পোশাক কিনবে, রাতে ভালো কোনো হোটেলে খাবে। মনে থাকবে? তিনদিন পর মিনা থেকে আসব, তোমাদের দুজনকেই তখন দেখতে চাই। দুজনই নতুন পোশাক পরে আসবে।”
হাতে ধরা নোটটার দিকে তাকিয়ে আমাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল, দুজনেই। আমি দেখতে পাচ্ছি আরমানের দুই চোখের নিচের পাতা পানিতে ভরে গেছে। কিছু বলবে হয়তো। ঠোঁট দুটি কাঁপছে। আমি ওর পিঠে হাত রেখে বললাম, “এই পবিত্র নগরীতে আছো। দেখো আল্লাহ তোমাদের সহায় হবেন। তোমাদের সব কষ্ট, ক্ষোভ একদিন দূর হবেই।”
এ বছর মধ্য জুলাই থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা বেশ কয়েকদিন ধরে দেশের তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন করছে। গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে। এরা নিজেদের ‘আমি রাজাকার’ ‘আমি রাজাকার’ বলে স্লোগান দিয়েছে। কারফিউ দিয়ে সেনাসদস্যদের নামিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। রাস্তায় রাস্তায় ধ্বংস চিহ্ন এখনও দৃশ্যমান। আজও চলছে সংঘর্ষ।
নিহত ও আহতের সংখ্যা কত সেটা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। তবে সংবাদপত্রে শনিবার পর্যন্ত রিপোর্টেই দুইশর ওপর মানুষ নিহতের খবর এসেছিল। রোববার রাত আটটার দিকে আশি ছাড়িয়ে গেছে।
জীবন যাদের এখনো শুরুই হয়নি, তাদের অনেকেরই নির্মমতার শিকার হয়ে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে। ঢাকার মিরপুরের ১১ বছরের শিশু সাফকাত সামির। মিরপুরে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘাত চলছিল। বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ওই ধোঁয়া ঘরের মধ্যে ঢুকলে জানালা বন্ধ করতে যায় সামির। গুলি এসে তার চোখ ফুঁড়ে মাথায় বিদ্ধ হয়। সামির তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান।
নারায়ণগঞ্জের সাড়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। দুপুরে খাওয়ার পর খেলতে গিয়েছিল ছাদে। বাড়ির সামনে সংঘর্ষ বাধলে বাবা দীপক গোপ দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে ছাদ থেকে আনতে যায়। ভয় পাওয়া শিশুটিকে কোলে তুলে নিতেই বুলেট এসে আঘাত করে তার মাথায়। তিন দিন হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মৃত্যুর কাছে হেরে যায় শিশুটি।
তেরো বছরের কিশোর মোবারক ঢাকার পান্থপথের বক্স কালভার্ট এলাকায় গরুর খামার বস্তিতে মা-বাবার সঙ্গে থাকত। চারটা গাভি ছিল তাদের। ওই গাভির দুধ বিক্রি করেই সংসার চলত। ক্রেতাদের বাসায় দুধ পৌঁছে দিতে দুপুরের পর বের হয়েছিল মোবারক। গ্রিনরোডের ওইখানটায় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মাথায় গুলি লাগে তার।
দশম শ্রেণির নাইমা সুলতানা। ঢাকার মাইলস্টোন কলেজে পড়ত। উত্তরার ৫ নম্বর সড়কের ভাড়া বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ গুলি এসে বিদ্ধ হয় নাইমার মাথায়। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ফারহান ফাইয়াজ, যে তার ফেইসবুক ওয়ালে লিখেছিল, “এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে।” ২০০৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর আলোয় চোখ রাখা ফারহানের বয়স আঠারোও হয়নি। মুখ ও বুকে রাবার বুলেটের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে মারা গেছে ফারহান।
আরমান যখন বলেছিল পাকিস্তানে থাকলেই ভালো হতো, তার কথায় এতটুকু রাগ হয়নি। বুকের ভেতরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। কোটা আন্দোলনকারীদের মুখে আমি রাজাকার, আমি রাজাকার বলে স্লোগানে আমার বুকের ক্ষত মুহূর্তেই ক্যান্সার হয়ে যায়। একি সর্বনাশের কথা! যাদের আজ স্বাধীনতার সুফলভোগ করার কথা তাদের মুখে এ কি বুলি! এ কি বলছে এরা! এরা কি বুঝে শুনে বলছে? মন থেকে বলছে, নাকি তীব্র অভিমান আর ক্ষোভ থেকে? এদের বিক্ষুব্ধ তীব্র অভিমান ভরা স্লোগানে একজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী তো বলেই ফেললেন তিনি এই শিক্ষার্থীদের আর মুখও দর্শন করতে চান না।
কী মনে হয় এই তরুণ-তরুণীরা সবাই রাজাকার হয়ে গেছে, আর আমরা সবাই দেশপ্রেমী! এই আমরা কারা! এই আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, আধমরাদের দল। সকলেই জানি, তারপরও আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি তাদেরকে যারা আজ এই তরুণ সমাজকে কলঙ্কের কালিমা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। এদেশের শিক্ষার্থী-তরুণ সমাজ একটি স্বাধীন দেশের জন্যে সেই ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে নিজেদের জীবন দিয়ে বাঙালি জাতির জন্যে ত্যাগ স্বীকার করে আসছে।
১৯৬২ সালে শিক্ষার অধিকার দাবিতে রক্ত দিয়েছে এই তরুণ-তরুণীর দল। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছে, ১৯৭১ সালে সবার আগে তারাই ঝাপিয়ে পড়েছে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্যে। দুঃখের বিষয়, স্বাধীন দেশের বুকে স্বদেশের পুলিশের গুলিতে তাদের রক্ত দিতে হয় ১৯৭৩ সালে। শিক্ষার অধিকার রক্ষার দাবিতে ১৯৮৩ সালে মিলিটারি ট্যাংকের নিচে তাদের প্রাণ যায়। ১৯৯০ সালেও সামরিক সরকারকে হঠানো সম্ভব হয় শুধুমাত্র এদেরই কারণে। এ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসংখ্য শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে, হাজার হাজার শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক পঙ্গুত্ব নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেছে। ২০১৫ সালের শিক্ষায় ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের ত্যাগ ও রক্তদান অব্যাহত আছে।
কাদেরকে আপনি বা আপনারা রাজাকার আখ্যা দিলেন? একটুও বুক কাঁপল না। এদেশ স্বাধীন হয়েছিল এদেরই মতো তরুণ-তরুণীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। রুমি, আজাদ, বদি— এরকম অসংখ্য তরুণরাই সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আপনারা আধমরাদের দল (আমিসহ) সৃষ্টি করেছেন বেনজীর, মতিউর, প্রদীপ হাওলাদার গংদের— যারা এদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, আত্মসাৎ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পিয়নও নাকি চারশ কোটি টাকার মালিক! কেউ কি এতটুকু তথ্য দিতে পারবেন কোন তরুণ-তরুণী কত টাকা বিদেশে পাচার করেছে? দেশকে ভালোবাসেন! দেশের মানুষকে ভালো না বেসে কি দেশকে ভালোবাসা যায়? দেশের মানুষকে কি ভালোবাসেন? কীভাবে?
কখনও কি আপনার কোনো ড্রাইভারকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন বা কোনোদিন একই টেবিলে বসে খাবার খেয়েছেন? রিকশাওয়ালা-ঠেলাগাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কখনও তুই-তুকারি ছাড়া কথা বলেছেন? বাসার গৃহকর্মীর সঙ্গে আপনার/আপনাদের নৈমিত্তিক ব্যবহার ভেবে দেখেন তো! আমাদের তরুণ-তরুণীরা বাসার ড্রাইভার, কাজের লোকের সঙ্গে আপনি ছাড়া কথা বলে না। রিকশাওয়ালা, সিএনজিচালক এদেরকে মামা ছাড়া সম্বোধন করে না। কারণ এদের ভেতর মানুষের জন্যে ভালোবাসা আছে, শ্রদ্ধা আছে। এরা তীব্রভাবে দেশকে ভালোবাসে।
মেলবোর্নের এমসিজিতে বাংলাদেশ বনাম ভারতের খেলা। খেলা শুরুর আগে দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…। আমি বসে কিছু বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীর দিকে তাকিয়ে দেখি এদের অনেকেই রীতিমতো কাঁপছে, বেশিরভাগেরই চোখভরা পানি। অদূরেই একজনের ফোঁপানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। প্রবাসে দেশকে নিয়ে কোনোদিন কোনো তরুণ-তরুণীকে কুৎসা রটাতে দেখিনি বা শুনিনি। বিদেশে দেশকে নিয়ে কুৎসা রটায় এই আধমরাদের দল। আজ তিন যুগের বেশি সময় ধরে তাই দেখে আসছি।
যেখানে সরকারি দলের আধবুড়ো ছাত্র নামধারী নেতাদের চামচার চামচাও গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে যখন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে তাদের রুটি-রুজি, তাদের মেধার মূল্যায়নের জন্য রাস্তায় নামতে হয়, কলঙ্কিত হতে হয়, তাদের বুকের চাপা অভিমান কি অস্বাভাবিক! অভিমান থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে হিতাহত জ্ঞানশূন্য উন্মাদনা। ধমক দিয়ে নয়, বন্দুকের গুলি দিয়ে নয়, আমরা এই আধমরা বুড়োভামের দল কি পারতাম না ভালোবেসে, আদর দিয়ে এদের পাশে এসে দাঁড়াতে?
অতীতে কোনো আন্দোলনেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দিয়ে কখনোই এরকম ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি, এবারের আন্দোলনের সময় যা হয়েছে। মাত্র ২-৩ দিনে ঢাকাসহ দেশের আনাচে-কানাচে যে ধ্বংস, ভস্ম, নাশকতা হয়েছে তা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। দেশের ন্যাশনাল হেরিটেজ সমতুল্য টিভি ভবন, জেলখানার মতো স্থাপনা, পুলিশ ফাঁড়ি, এমনকি হাসপাতাল কোনোটাই হামলার কবল থেকে রক্ষা পায়নি। বিটিভি ভবনে ৩ বার হামলা হয়েছে। পুরো ভবনের ৪২টি কক্ষ সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়েছে। মিরপুরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ডিপোতে পার্কিং করা ৩০টি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
যে সরকারের সময়ই হোক, যেভাবেই হোক, মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আমাদের দেশের গর্ব। আর এই গর্বে সবচেয়ে গর্বিত হতে দেখেছি আমাদের তরুণ সমাজকে। মেট্রোরেল চালুর প্রথম দিকের সংবাদগুলো পড়ুন, ভিডিওগুলো দেখুন, দেখতে পাবেন কি পরিমাণ আনন্দ আর উচ্ছ্বাস এই তরুণেরাই করেছে। ধ্বংসস্তূপ দেখছি ভষ্ম হয়ে যাওয়া স্থাপনা দেখছি, আর আঁতকে উঠছি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এগুলো এরা করেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এই ধ্বংস এই নাশকতা আবু সাইদ, মুগ্ধ, নুসরাত, আসিফ, এরকম লাখো কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাজ! আমাদের মেধাবী তরুণ-তরুণীরা জানে এগুলো দেশের সম্পদ। কারও ব্যক্তিগত গর্বের সম্পদ নয়। এই আইকনিক সম্পদ ও স্থাপনার মূল্যও তারা জানে। তারা এটাও জানে আমরা এই আধমরাদের দল অচিরেই চলে যাব, বিদায় নেব, হয়ত আস্তাকুড়ে অথবা পরপারে। রেখে যাওয়া স্থাপনার বিশাল ঋণ তাদেরই কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে। এই সম্পদ ও স্থাপনা ধ্বংস, ভষ্ম করার পেছনে বাইরের কোনো চক্রের প্ররোচনা ভাবাটা কি একেবারেই অমূলক?
অতীতে কিছুটা ঠাওর করতে পারলেও, এখন এই বয়সে আমাদের দেশের সত্যিকারের কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী দেশ আছে কিনা তা ভাবতে গোলক ধাঁধায় পড়ে যাই। এতটুকু বুঝতে পারি বাংলাদেশের উন্নয়ন অন্য কোনো দেশই সুনজরে দেখছে না। সম্পদ ও স্থাপনা ধ্বংস, ভষ্ম করার পেছনে অন্য কোনো দুষ্ট স্বার্থান্বেষী চক্র আছে। ওই চক্রটিকে খুঁজে বের করাই হবে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের কাজ। শিক্ষার্থীদের খোঁজা বা শিক্ষার্থীদের ডিটেনশনে নেয়া নয়। তরুণ সমাজের ক্ষোভের উন্মাদনা ভয়াবহ, যার প্রমাণ আমরা অতীতে বহুবার দেখেছি। এদের ভেতরের হতাশা ক্ষোভ দূর করতে না পারলে, দেশ ও জাতির উন্নয়ন সুদুর পরাহত হবে। মুখে উন্নয়নের বুলি আউড়িয়ে কোনোই লাভ নেই। সকলই গরল ভেল।