নিজেদের রক্ষার জন্যই ইনডেমনিটি করেছিল জিয়া-মোশতাক

ইতিহাস বলে সত্য কখনো ঢেকে রাখা যায় না, জিয়া-মোশতাক কর্তৃক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ/আইন প্রণয়নের ব্যাপারেও এই অবধারিত সত্যটিই প্রকাশ পেয়েছে।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 14 Nov 2022, 10:18 AM
Updated : 14 Nov 2022, 10:18 AM

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এক মাস এক দিনের মাথায়ই বিশ্বের অন্যতম কলঙ্কিত বিধান বলে পরিচিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে সে সময়ে বাংলাদেশে আগ্নেয়াস্ত্রের বলে ক্ষমতা দখলকারি জিয়াউর রহমান এবং জিয়ার পুতুল খন্দকার মোশতাক।

একটি অধ্যাদেশ জারি করতে হয় রাষ্ট্র প্রধানের নামে এবং তার স্বাক্ষরে। তাই সেদিনের কথিত অধ্যাদেশটিতে ছিল খোন্দকার মোস্তাকের দস্তখত। কেননা, অবৈধভাবে হলেও তাকেই সেদিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেখানো হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত সমস্ত তথ্য প্রমাণ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেদিন এবং পরবর্তী দিনগুলোতে আসল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিল জিয়াউর রহমান, যাকে দেওয়া হয়েছিল সেনাপ্রধানের দায়িত্ব, আর জিয়াউর রহমান মোশতাককে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসিয়েছিল। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংবিধান অনুযায়ী মোস্তাকের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ছিল না, কেননা তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যে কথাটি বঙ্গবন্ধু হত্যার কলঙ্কিত কালো দিবস অর্থাৎ ১৫ অগাস্টই বঙ্গভবনে জৈষ্ঠ আইনজীবী সেরাজুল হক সাহেব প্রকাশ্যে এবং নির্ভয়ে উচ্চস্বরে বলেছিলেন।

কিন্তু হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী কাউকে রাষ্ট্রপতির পদে না বসিয়ে খন্দকার মোশতাককে বেছে নিয়েছিল। কেননা, সেও বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল এবং সেও জিয়াউর রহমানের মতো বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানে পরিণত করার স্বপ্নে বিভোর ছিল। এ পদক্ষেপ নিতে পাকিস্তানি, চীনা এবং সে সময়ের মার্কিন প্রভুদেরও ইঙ্গিত ছিল। তবে জিয়া নিজে পোষণ করছিল অন্য পরিকল্পনা, যা সুচতুর সেই ব্যক্তি প্রকাশ করে নি। লোকের চোখকে ধন্দ দিতে এবং ক্ষমতালিপ্সু নন বলে প্রমাণিত করার জন্য সে তখন ৮১ দিনের জন্য মোশতাককেই ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তার সুপ্ত পরিকল্পনা ছিল অচিরেই মোশতাক এবং আর এক পুতুল বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমকে অপসারণ করে নিজেই রাষ্ট্রপ্রধানের গদি দখল করা। ১৫ অগাস্ট থেকে জিয়াই যে বস্তুত সকল ক্ষমতার অধীশ্বর ছিল, অর্থাৎ ‘কিং-মেকার’ ছিল তা বহু নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেই জানা গেছে।

ভারতে বহু বছর পালিয়ে থাকার পর ধরা পড়ে অবশেষে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম ঘাতক ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদকে। ফাঁসিতে ঝোলার কিছু আগে মাজেদ একাধিকবার বলেছিল ১৫ অগাস্ট পুরোদিন বঙ্গভবন দাবড়িয়ে বেড়িয়েছিল জিয়াউর রহমান এবং সে-ই ছিল সেদিন সকল কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক। মাজেদ আরো বলেছিল, ১৫ অগাস্টের সব অঘটনের হুকুমদাতা ছিল জিয়াউর রহমান।

কিছুদিনের জন্য পুতুল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি আবু সাদাত সায়েম এর লেখা পুস্তক ‘বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি’-এর লেখনি থেকেও এটা পরিষ্কার যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এবং পরবর্তী সময়গুলোতে সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হতো জিয়াউর রহমানের ইচ্ছা এবং নির্দেশে, এবং এমনকি সায়েম সাহেবকে অপসারণ জিয়াই করেছিল ভয়ভীতি দেখিয়ে, মাঝরাতে সশস্ত্র অবস্থায় তার ঘরে প্রবেশ করে।

এসব থেকে পরিষ্কার যে, জিয়া নামেমাত্র মোশতাককে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসালেও পেছনের সিট থেকে তিনিই ছিল সর্বনিয়ন্ত্রা এবং সেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশও হয়েছিল জিয়া এবং মোস্তাকের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। পরে অবশ্য ১৯৭৯ সালে জিয়া এককভাবে এটিকে আইনের রূপ দিয়েছিল। অনেকেরই প্রশ্ন জিয়া-মোশতাক কেন এই অধ্যাদেশটি জারি করেছিল এবং কেনই বা ১৯৭৯ সালে জিয়া এটিকে আইনে রূপান্তরিত করে একে সংবিধানের অংশে পরিণত করার অপচেষ্টা করেছিল? তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল শুধু বন্দুকধারী খুনিদেরই বিচারের হাত থেকে রক্ষা করা?

পুরো অধ্যাদেশটি পড়লে কিন্তু বোঝা যায় এটি শুধু বন্দুকধারী ঘাতকদেরই রক্ষার জন্য করা হয়নি, করা হয়েছিল ১৫ অগাস্ট হত্যা ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারী এবং সে পরিকল্পনা যারা  বাস্তবায়িত করেছিল, তাদেরও রক্ষার জন্য। অধ্যাদেশের নিম্নলিখিত অংশ পাঠ করলেই এ ব্যাপারে আর সন্দেহ থাকতে পারে না, “১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট প্রাতঃকালে সাধিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তনের এবং সামরিক আইন ঘোষণার প্রসঙ্গে বা এরূপ পরিবর্তন এবং ঘোষণার জন্য কোন পরিকল্পনা প্রস্তুত বা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, যা এরূপ পরিবর্তন এবং ঘোষণার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে কোন ব্যক্তি কর্তৃক সম্পন্ন কোন কাজকর্ম, বিষয় যা ঘটনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে কোনও ব্যক্তি কর্তৃক সম্পন্ন, বিষয় বা ঘটনার জন্য যা কারণে বা প্রসঙ্গে এরূপ ব্যক্তির বিরুদ্ধে- ... কোন মামলা, ইত্যাদি হবে না।”

অধ্যাদেশটিতে লিপিবদ্ধ উপরে মুদ্রিত ভাষা থেকে এ বিষয়ে সন্দেহ করার উপায় নেই যে শুধু বন্দুকধারী নয়, রক্ষাকবচ দেয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল তাদেরকেও যারা ‘কোন পরিকল্পনা প্রস্তুত এবং বাস্তবায়ন করতে গিয়েছিল, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিল’। বঙ্গবন্ধু মামলার শুনানিতে বিশেষ করে ৪৬ নং সাক্ষী জেনারেল সফিউল্লা, ৪৫ নং সাক্ষী কর্নেল সাফায়েত জামিল এবং ৯ নং সাক্ষী কর্নেল হামিদের সাক্ষ্য থেকে পরিষ্কার যে, হত্যা পরিকল্পনায় জিয়াই ছিল মুখ্য খেলোয়াড়। শুধু তাদের সাক্ষ্যই নয়, লন্ডনের এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে বন্দুকধারী ঘাতক কর্নেল (বহিস্কার) ফারুক এবং রশিদ অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ভাষায়ই বলে ছিল যে তারা জিয়ার থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই হত্যাযজ্ঞে নেমেছিল। এ ছাড়াও কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক ১৯৭৬ সালের ৩০  মে লন্ডনের বহুল প্রচারিত সানডে টাইমস পত্রিকায়ও এক দীর্ঘ নিবন্ধে একই কথা লিখেছিল। এমনকি জিয়ার অতি ঘনিষ্ঠজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদও তার পুস্তকে লিখেছেন, জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করতো। বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক লরেন্স লিপসুলজও তার বাস্তবধর্মী লেখনীর মাধ্যমে জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা যুক্তি-তর্ক দিয়ে প্রকাশ করেছেন। জিয়া-মোশতাক জানতো কোন একদিন বঙ্গবন্ধুহত্যার পরিকল্পনাকারী এবং তা বাস্তবায়নে তাদের ভূমিকার সাক্ষ্য প্রমাণ থলের বিড়ালের মতোই বেরিয়ে যাবে এবং তখন বঙ্গবন্ধু হত্যার হুকুমের আসামি হিসেবে তাদের বিচার হবে। আর সেটি যেন না হয় সে জন্যই তারা ওই অধ্যাদেশটি শুধু বন্দুকওয়ালা খুনিদের রক্ষার জন্যই করেনি, বরং নিজেদের রক্ষার জন্যও করেছিল। তাছাড়া যারা জিয়া-মোশতাকের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, তাদের বিচারের কাঠগোড়ায় তোলা হলে স্বভাবতই তাদের ভাষা থেকে বেরিয়ে যেত যে তারা জিয়া-মোশতাকের পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত করেছে। আরো একটি কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি অধ্যাদেশের বয়সসীমা পার্লামেন্টের পরবর্তী অধিবেশন পর্যন্ত। তখন অধ্যাদেশটি আইনে রূপান্তরিত না করলে তার স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, আর তা যেন না হয়, অর্থাৎ এটি যেন জন্ম-জন্মান্তর বেঁচে থাকে সে উদ্দেশ্যে জিয়া ১৯৭৯ সালে এটিকে শুধু আইনেই পরিণত করে নি, বরং সংবিধানের অংশে পরিণত করেছিল। সংবিধানের অংশে পরিণত করা হয়েছিল এ কারণে যেন স্বাভাবিক আইন দ্বারা এটি অপসারণ বা রহিত করা না যায়।

জিয়া অবশ্য বুঝতে পারেনি যে অধ্যাদেশটি এবং পরে এটি আইনে পরিণত করা, সবই ছিল অবৈধ। আর তাই ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর এটিকে রহিত করতে কোন অসুবিধা হয়নি এবং হাইকোর্টও তাই রায় দিয়েছে। ইতিহাস বলে সত্য কখনো ঢেকে রাখা যায় না, জিয়া-মোশতাক কর্তৃক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ/আইন প্রণয়নের ব্যাপারেও এই অবধারিত সত্যটিই প্রকাশ পেয়েছে।