বিএনপির দলীয় ম্যানিফেস্টোতে শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থার কথা ছিল। সরকার গঠনের পরও তারা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল।
Published : 14 Jul 2024, 06:51 PM
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার পরদিনই, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি সাময়িক সংবিধান আদেশ বলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পদেক্ষপ নেন। যদিও এর তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তিনি দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন এবং একইসঙ্গে পুনরায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় ফিরে যান।
এর ১৬ বছর পরে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়। নির্বাচনের আগে থেকেই অবশ্য বলা হচ্ছিল যে, দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা চালু করা হবে। যে কারণে ক্ষমতাসীন বিএনপি ছাড়া অন্যান্য সব দল প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির পরিবর্তে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির জন্য জোর দাবি জানাতে থাকে।
১৯৯১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদীয় সরকার প্রবর্তনবিষয়ক সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপনের নোটিশ দেয়। ৩ জুন পাঁচ দলের এক সভায় তিন জোটের রূপরেখা পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ৫ জুন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ‘সরকার পদ্ধতি ফয়সালা করে আমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিন’ বলে আহ্বান জানান। অবশেষে ৯ জুন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় সংসদীয় পদ্ধতি সরকারের প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং পরদিন দলের সংসদীয় সভায় ওই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানানো হয়।
১ জুলাই জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ অপরদিকে বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে বিএনপি সরকার পদ্ধতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, বিএনপির দলীয় ম্যানিফেস্টোতে শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থার কথা ছিল। সরকার গঠনের পরও তারা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। সেক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওই পদে তাদের প্রার্থী নিয়ে। কারণ নির্বাচনের পরপর বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদে অন্য কাউকে তারা চিন্তা করতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় অন্যান্য দলের দাবিকৃত সংসদীয় পদ্ধতির সুবিধাটা তাদের উপলব্ধিতে আসে। তারা ভেবে দেখল যে, বেগম জিয়া যেহেতু প্রধানমন্ত্রী হয়েই গেছেন, ফলে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করা হলে আর কোনো নির্বাচনি ঝুঁকিতে যেতে হবে না। কেননা তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং একইসঙ্গে সরকারের নির্বাহী প্রধান হয়ে যাবেন।
১৯৯১ সালের ২ জুলাই সরকার পদ্ধতি সম্পর্কিত সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল এবং বিচারপতি সাহবুদ্দীন আহমদের উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ থেকে শুরু করে তার ক্ষমতা পরিচালনাকালীন সকল কর্মকাণ্ডের বৈধতা প্রদান এবং প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়া সম্পর্কিত বিল উত্থাপন করা হয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের আবদুস সামাদ আজাদ সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন সম্পর্কিত সংবিধান সংশোধনী বেসরকারি বিলটি ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে উত্থাপন করলে স্পিকার একে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী বিল বলে আখ্যা দিয়ে রুলিং দেন। স্পিকারের এই রুলিং নিয়ে সংসদে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় এবং বিরোধী দল ওয়াক আউট করে।
৯ জুলাই সরকারি দল উত্থাপিত সংবিধান সংশোধনী বিল এবং বিরোধী দলের বিলগুলো সর্বসম্মতিক্রমে বিশেষ কমিটিতে পাঠানো হয়। এ সময় সংসদ খুবই উত্তপ্ত থাকে। প্রতি অধিবেশনেই সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং তুমুল বাকবিতণ্ডা চলে।
১৭ জুলাই গণতন্ত্রী পার্টির নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে স্পিকার আবদুর রহমান বিশ্বাসের যুক্তি-পাল্টা যুক্তির একপর্যায়ে স্পিকার সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হাউস থেকে বের করে দেয়ার নির্দেশ দিলে ঘটনাটি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
২৮ জুলাই সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বাছাই কমিটি সংসদে তাদের রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে প্রস্তাবিত ১১ ও ১২তম সংশোধনীর ২৬টি স্থানে পরিবর্তন আনা হয়। ৩০ জুলাই সংবিধান সংশোধনী দুটির ওপর আলোচনা শুরু হলে বিরোধী দল বিলের আরও কিছু গ্রহণ-বর্জনের দাবি করে। ওই দিনই বাকশাল আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়। ৩১ জুলাই জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা সংসদে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের পূর্বপদে ফিরে যাওয়ার বিধান সংবলিত সংবিধানের ১১তম সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করেন।
ইতোমধ্যে সংবিধান সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ সহযোগিতা করবে না বলে বিএনপি অভিযোগ করলে একে ভিত্তিহীন দাবি করে শেখ হাসিনা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। এ সময় সরকার সংবিধান সংশোধনীতে জাতীয় পার্টির সর্মথন আদায়ের লক্ষ্যে সকল নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে কারাগারে এরশাদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাদের এক বৈঠকের আয়োজন করে। ৫ অগাস্ট রাতে এরশাদের সঙ্গে তার সেলে বৈঠক করেন সদ্য কারামুক্ত মিজানুর রহমান চৌধুরী, মওদুদ আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া। ওই বৈঠকে যোগদানের জন্য প্রয়োজন হতে পারে অনুমান করে পিজির (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রিজন সেলে আটক কাজী জাফর আহমেদ ও সরদার আমজাদকে তৈরি হয়ে থাকতে বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের আর আনা হয়নি।
ওই বৈঠকের আগে মওদুদ আহমদ বিএপির সঙ্গে আলাপ করে এসে জানান যে, সংশোধনীতে জাতীয় পার্টি ভোট দিলে বেগম রওশন এরশাদকে পরের দিনই মুক্তি দেয়া হবে। এরশাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো পর্যালোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব তারও জামিনের ব্যবস্থা করা হবে। অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে মামলাগুলো পুনর্বিবেচনা করা হবে। এসব ব্যাপার এরশাদকে জানানো হলে তিনি সংশোধনীতে ভোট দেয়ার পক্ষে মত দেন। ইতোমধ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সমঝোতা হয়ে যায়। ফলে জাতীয় পার্টির ভোট দেয়া না-দেয়ার আর কোনো গুরুত্ব থাকল না।
১৯৯১ সালের ৬ অগাস্ট এক আনন্দঘন ও হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী আইন গৃহীত হয়। স্পিকারের দায়িত্ব পালনকারী ডেপুটি স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী সদস্যদের তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে ৩০৭-০ ভোটে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিলটি গৃহীত হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। সংসদীয় পদ্ধতি সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দ্বাদশ সংশোধনী বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। (ড. সুলতান মাহমুদ, বাংলাদেশ সংবিধান প্রেক্ষিত এবং প্রাসঙ্গিকতা, আলেয়া বুক ডিপো/২০২১, পৃ. ১০৫)।
১২ অগাস্ট নির্বাচন কমিশন সরকার পদ্ধতি প্রশ্নে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর ব্যাপারে গণভোট গ্রহণের দিন ধার্য করার ঘোষণা দেয়। ১৫ সেপ্টেম্বর গণভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই গণভোটে শতকরা ৩৪.৯৩ ভোট পড়ে বলে দেখানো হয়। এর মধ্যে হ্যাঁ ভোট ছিল ৮৪.২৪ এবং না ভোট ১৫.৫৪ ভাগ।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে রাষ্ট্রপতিকে নামসর্বস্ব প্রধান রেখে রাষ্ট্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চালু হয়ে গেলে সামনে আসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রসঙ্গ। নির্বাচন কমিশন ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে বিএনপি ২৪ সেপ্টেম্বর সংসদের স্পিকার আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ওই পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়। ২৫ সেপ্টেম্বর হঠাৎ আওয়ামী লীগ বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে জাতীয় ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী জানাচ্ছেন, উভয় প্রার্থী একপর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন আদায়ের জন্য গোলাম আজমের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। ঐকমত্যের প্রার্থী হয়েও বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধরী ৫ অক্টোবর বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যদিও ৮ অক্টোবর সংসদে প্রকাশ্য ভোটে বিএনপির আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৭২ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বিপরীতে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী পান ১২ ভোট। ৯ অক্টোবর আবদুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তবে এই শপথ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নেতারা অনুপস্থিত ছিলেন। (রাজনীতির তিনকাল, অনন্যা/২০০৩, পৃ. ২৭০)।
১২ অক্টোবর সংসদীয় পদ্ধতির সংসদের প্রথম অধিবেশনে শেখ রাজ্জাক আলী স্পিকার এবং ১৩ অক্টোবর হুমায়ুন খান পন্নী ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। সরকার পদ্ধতি পরিবর্তিত হলো। নতুন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব নিলেন।