আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: আমরা কি আপনাকে ভুলিতে পারি?

তিনি জীবনভর যা লিখেছেন তার সবগুলোর জন্য না হলেও মাত্র একটি কবিতার জন্য তাঁকে বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে, স্মরণ করবে। বলবে, গাফ্ফার চৌধুরী, আমরা কি আপনাকে ‘ভুলিতে পারি'?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 18 May 2023, 06:29 PM
Updated : 18 May 2023, 06:29 PM

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম শোনেননি, এমন সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে তিনি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে ছিলেন। ৮৮ বছরের জীবনে সম্ভবত ৭০ বছরই সাংবাদিক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। এতগুলো বছর ধরে কত রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন তা হিসাব করে বের করতে যে রীতিমতো একটি গবেষণার প্রয়োজন হবে। দুই হাতে লেখা বলে একটি কথা আছে। কথাটা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ক্ষেত্রে যেন শতভাগ সত্য। তিনি যেন দুই হাতেই লিখতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ছাত্রাবস্থায় ‘দৈনিক ইনসান' পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যে জীবনের শুরু তার সমাপ্তি ঘটেছে ২০২২ সালের ১৯ মে, নিজের দেশ থেকে বহু বহু দূরে সুদূর লন্ডনের একটি হাসপাতালে। আর কোনোদিন হাতে কলম তুলে নেবেন না। কিন্তু তিনি জীবনভর যা লিখেছেন তার সবগুলোর জন্য না হলেও মাত্র একটি কবিতার জন্য তাঁকে বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে, স্মরণ করবে। বলবে, গাফ্ফার চৌধুরী, আমরা কি আপনাকে ‘ভুলিতে পারি'? 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চরম নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়ে গুলিবর্ষণ করেছিল। শহীদ হয়েছিলেন বরকত, রফিক, জব্বারসহ বেশ কয়েকজন। গাফ্ফার চৌধুরী মাথার খুলি উড়ে যাওয়া এক শহীদের রক্তাক্ত শরীর দেখেছিলেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ১৮ বছরের এক তরুণ গাফ্ফার চৌধুরীর হৃদয়ে তখন যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, তাই তাঁকে রচনা করতে প্রাণিত করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'? অতি সাধারণ সব শব্দ দিয়ে গাঁথা এই মালা কেন বাঙালির কণ্ঠে মণিহার হলো? কারণ এতে ধ্বনিত হয়েছে বাঙালির মনের কথা। শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুর দিয়ে এই শব্দগুলোকে করে তুলেছেন এমন এক গান, যা বাঙালির জন্য যেকোনো সংকটে, সংগ্রামে উত্তরণের অভয়বাণী হয়ে উঠেছে। তাই পরবর্তী সময়ে আর কিছু না লিখলেও গাফ্ফার চৌধুরীকে ভুলে যাওয়া বাঙালির পক্ষে অসম্ভব। 

১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া চৌধুরী বাড়িতে জন্ম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। একেবারে স্কুল জীবনেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। একটি বামপন্থী দলের সঙ্গে জড়িতও হয়েছিলেন। কিন্তু সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী না হয়ে হয়ে উঠেছেন রাজনীতি পরিচালনার মন্ত্রগুরু, পরামর্শক এবং সেটা রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক কলাম লিখে। 

গাফ্ফার চৌধুরী সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ডানপিটে শওকত। তারপর একে একে লিখেছেন কৃষ্ণপক্ষ, সম্রাটের ছবি, চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, সুন্দর হে সুন্দর, নাম না জানা ভোর, নীল যমুনা, শেষ রজনীর চাঁদ ইত্যাদি। 

গাফ্ফার চৌধুরী রাজনৈতিক লেখালেখির প্রতি বেশি মনোযোগী বা আগ্রহী হওয়ায় সাহিত্যের পথে হাঁটা কমিয়ে দিয়ে ভালো করেছেন না খারাপ করেছেন, সেটা অন্য বিতর্ক। কিন্তু বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনার সঙ্গে তিনি নিজেকে যেভাবে জড়িয়েছেন তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। কলমযোদ্ধা ছিলেন আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বন্দুক হাতে না নিয়ে তিনি ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ছিল অত্যন্ত নিবিড় যোগাযোগ। বঙ্গবন্ধুর তাঁর আত্মজীবনীর ডিকটেশনও দিয়েছেন গাফ্ফার চৌধুরীকে। 

স্ত্রীর দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য তাঁকে লন্ডন যেতে হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ঘটে সবচেয়ে বড় মর্মন্তিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ‘কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করবে না'-কে ভুল প্রমাণ করে একদল বিশ্বাসঘাতক বাঙালি তাঁর বুকে গুলি চালায়। বঙ্গবন্ধুশূন্য বাংলাদেশে বসবাসের জন্য গাফ্ফার চৌধুরী আর ফিরে আসেননি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক। তিনজন সাংবাদিককে বঙ্গবন্ধু আপদ বিপদ মসিবত বলতেন। এঁদের দুজন এ বি এম মূসা ও ফয়েজ আহমেদ আগেই চলে গেছেন। ত্রিরত্নের শেষ জন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও চলে গেলেন।

গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন মনেপ্রাণে একজন অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতার মানুষ। তাঁর অবস্থান ছিল সবসময় যুক্তির পক্ষে, কূপমণ্ডূকতা ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। তাঁর লেখা ছিল অত্যন্ত সুখপাঠ্য। তাই পাঠকদের টানত। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রাজনৈতিক কলাম যে কয়েকজনের লেখার গুণে জনপ্রিয় হয়েছে, তারমধ্যে গাফ্ফার চৌধুরীর নাম নিঃসন্দেহে শীর্ষে থাকবে। তাঁর মতের সঙ্গে যারা একমত হতে পারতেন না, তারাও তাঁর লেখা পড়তেন। গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা পড়া অনেকের কাছেই ছিল নেশার মতো। 

গাফ্ফার চৌধুরী বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, ইউনেসকো পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তবে অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসার চেয়ে বড় প্রাপ্তি ও পুরস্কার আর কী হতে পারে। 

তিনি দেশে থাকতে অনেক পত্রিকায় কাজ করেছেন। তবে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার স্নেহধন্য হয়ে দৈনিক ইত্তেফাকই ছিল হয়তো তাঁর সেরা কর্মক্ষেত্র। স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা জয়বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জনপদ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে, তেমনি দেশের বাইরে গিয়েও গাফ্ফার চৌধুরী সংবাদপত্র থেকে দূরে থাকেননি। লন্ডন থেকেও তিনি পত্রিকা বের করেছেন। 

লেখালেখির বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক একটি ডকুড্রামা ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নির্মাণ করেছেন ২০০৭ সালে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে সফল হননি। 

গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৭৪ সালে। তখন তিনি জনপদ নামের একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। পত্রিকা যেখান থেকে বের হতো, সেখানকার প্রেসেই ছাপা হতো ছাত্র ইউনিয়নের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়ধ্বনি’। আমি জয়ধ্বনির কাজে সপ্তাহে তিনদিন প্রেসে যেতাম। তখনই গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা এবং পরিচয়। তবে তাঁর লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় আরও আগেই। 

অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সত্তর দশকের মাঝামাঝি তিনি লন্ডনে চলে গেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। তারপর গত শতকের আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন বাজারে এসেই ঝড় তোলে। গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর বন্ধু শফিক রেহমানের যায়যায়দিনে লেখা শুরু করেন। বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে গাফ্ফার চৌধুরীকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যায়যায়দিন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমিও যায়যায়দিনে রাজনৈতিক প্রতিবেদন লিখতাম। সামরিক স্বৈরশাসকের লাল চোখের জন্য তখন আমাকে ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল– তারিখ ইব্রাহিম। যায়যায়দিনের মাধ্যমে আমাদের সেই যে সম্পর্কের ঝালাই হয়, তাতে আর ছেদ পড়েনি।

গাফ্ফার চৌধুরী আমার লেখা পছন্দ করতেন। আমাকে তাঁর প্রিয়জনদের তালিকায় নিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। আমি যখন যে পত্রিকায় কাজ করেছি ওই পত্রিকাতেই গাফ্ফার ভাই সানন্দে লিখতে সম্মত হয়েছেন, লিখেছেন। আমার নতুন কর্মস্থল ‘আজকের পত্রিকা’তেও লিখতে শুরু করেছিলেন। গতবছর মৃত্যুর দুইদিন আগেও হাসপাতাল থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন। তার মাসখানেক আগে তাঁর এক মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন, আমিও বুঝি আর বেশিদিন বাঁচব না বিভু। 

আমি হেসে জবাব দিয়েছি, আপনি সেঞ্চুরি করবেন গাফ্ফার ভাই। আপনার কাজ এখনো শেষ হয়নি। ইতিহাস আপনার কাঁধে যেসব দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তার সবগুলো তো আপনি এখনো শেষ করেননি। 

তাঁকে দেখতে না পেলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, কথা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। তারপরও বললেন, বিভু বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগে। আমার সমবয়সী কিংবা আমার থেকে বয়সে ছোট অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে স্মৃতি হাতড়াই আর ভারাক্রান্ত হই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মনে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে বলেও মনে হলো। বললেন, আওয়ামী লীগ পথ হারিয়েছে। হাসিনার উচিত রেহানাকে তাঁর পাশে নিষ্ক্রিয় দাঁড় করিয়ে না রেখে কিছু দায়িত্ব তার কাঁধেও ছেড়ে দেওয়া। আমার বিশ্বাস আমার মা খারাপ করবে না। 

গাফ্ফার ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যাকেই কন্যার মতো ভালোবাসতেন। তবে বড় বোনের চেয়ে ছোট বোনের প্রতি তাঁর নৈকট্য বেশি বলে আমার ধারণা। শেখ রেহানা লন্ডনে কয়েক বছর থাকায় তাঁর সঙ্গে গাফ্ফার ভাইয়ের হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল বেশি। শেখ রেহানাকে গাফ্ফার ভাই ‘মা' বলে সম্বোধন করেন। 

আমি গাফ্ফার ভাইকে বলি, আপনি ‘আজকের পত্রিকা’য় লিখুন আপনার ইচ্ছের কথা। তিনি বলেন, শুক্রবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবো। শনিবার আপনি ফোন করবেন। আমি পরের সপ্তাহ থেকেই আপনাদের পত্রিকায় লিখব। আমি শুনেছি আজকের পত্রিকা ভালো হচ্ছে। 

হায়! এ কি ঘটে গেল। সেই শুক্রবার আসার আগেই, বৃহস্পতিবার, ১৯ মে ২০২২ গাফ্ফার ভাই চলে গেলেন। তাঁর আরও কত কথা বলার ছিল। সে সব আর বলা হলো না। 

তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর হাজার হাজার লেখার মধ্য থেকে ২০২০ সালে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে একটি লেখার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি। এখানেও সম্ভবত তাঁর শেষ ইচ্ছেটির প্রতিফলন ঘটেছে। নিচের পুরো অংশটুকই গাফ্ফার চৌধুরীর সেই লেখা। 

‘‘রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও একটা ব্যক্তিজীবন থাকে। রাজনীতিটাই তাদের জীবনে বড় হয়ে ওঠে বলে রাজনৈতিক জীবনের আড়ালে তাদের ব্যক্তিজীবন ঢাকা পড়ে যায়। এই ব্যক্তি জীবনটি জানা না গেলে এই নেতা-নেত্রীদেরও আসল চরিত্রটি খুঁজে পাওয়া যায় না। আজ ২৮ সেপ্টেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। তিনি ৭৩ পেরিয়ে চুয়াত্তর বছরে পা দেবেন। এই একই সেপ্টেম্বর মাসে শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার জন্ম। বড় বোনের চাইতে তিনি দশ বছরের ছোট। তার জন্ম ১৯৫৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর।

বাংলাদেশের রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্ত্রী এখন এই দুই বোন। শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে আছেন। শেখ রেহানা থাকেন নেপথ্যে। শেখ রেহানা রাজনীতিতে নেই বলে যারা ভাবেন তারা সঠিক তথ্যটি জানেন না। শেখ হাসিনা দেশ চালান। আর শেখ রেহানা পেছনে বসে প্রতিটি সমস্যা ও সংকটে বোনকে সাহস জোগান। রাজনৈতিক জীবনের আড়ালে এই দুই বোনের ব্যক্তিজীবন। তাদের কৈশোর থেকে কিছুটা জানি বলে শেখ রেহানার নেপথ্য রাজনৈতিক ভূমিকার কথাও কিছু জানি।

বঙ্গবন্ধু যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ৩২ নম্বরে আমার ছিল অবাধ যাতায়াত। তবু আজ কবুল করব, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ সাহচর্য সত্ত্বেও তিনি, ভাবি (মুজিব পত্নী), তাদের ছেলে শেখ কামালের সঙ্গে আমার যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল, তা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে হয়নি। বত্রিশ নম্বরে গেলে মাঝে মাঝে তাদের দেখা পেতাম, শেখ হাসিনা হয়তো বই-খাতার ব্যাগ হাতে কলেজে যাচ্ছেন। রেহানা ছোট ভাই রাসেলের সঙ্গে খেলা করছেন। এর বেশি কিছু নয়।...

শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এই দুটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এজন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে, পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে এই দুই বোনের ভূমিকা অনন্য। শেখ হাসিনার ভূমিকা প্রত্যক্ষ। রেহানার ভূমিকা নেপথ্যের। বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর লন্ডনেই প্রথম বাংলাদেশে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। শেখ হাসিনা আশির দশকের শুরুতেই দিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরে গিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। শেখ রেহানা লন্ডনে অবস্থান করেন এবং বিদেশে আওয়ামী লীগ রাজনীতি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তখন নববিবাহিত; স্বামী-সংসার দেখার পাশাপাশি অভিবাসী বাঙালিদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকেও লক্ষ রাখতেন। তবে নিজে রাজনীতিতে সামনে আসতেন না।...

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন আমিই করেছিলাম। আজ তার চারপাশে লোকলস্করের অভাব নেই। সেদিন তার সঙ্গে আমরা চার-পাঁচ জন ছাড়া কেউ ছিলেন না। প্রথম সংবাদ সম্মেলনটির ব্যবস্থা করেছিলাম লন্ডনের বেকার স্ট্রিটের কাছে ‘লাইট অব ইন্ডিয়া’ রেস্টুরেন্টে। এর মালিক ছিলেন আমাদের বন্ধু। তিনি এই সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশিত খাবারের দাম নেননি।

শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে এখন দেশি-বিদেশি সংবাদিকদের দারুণ ভিড়। কিন্ত সেদিন আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও লন্ডনের ডেইলি মিরর এবং ডেইলি মর্নিং স্টার ছাড়া আর কোনো পত্রিকার সাংবাদিক শেখ হাসিনার প্রেস কনফারেন্সে আসেননি। আর এসেছিলেন বিবিসি রেডিও’র বাংলা বিভাগের সিরাজুর রহমান। তিনি অবশ্য এসেছিলেন নানা অবান্তর প্রশ্ন করে শেখ হাসিনাকে বিব্রত করার জন্য। কিন্তু শেখ হাসিনা বিব্রত হননি। তিনি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিকের মতো তার সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন।...

১৯৮১ সালে লন্ডনের ইয়র্ক হলে শেখ হাসিনাকে দেয়া প্রথম সংবর্ধনা সভায় ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা প্রয়াত পিটার শোর সর্বপ্রথম শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের ভাবি প্রধানমন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। সে কথা সত্য হয়েছে। শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের নন, সারা দক্ষিণ এশিয়ার একজন সেরা পলিটিক্যাল স্টেটসম্যান’ হিসেবে পরিচিত। তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতির আজ অন্ত নেই। তিনি একটানা তিন দফা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। চতুর্থ দফাতেও তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, আশা করা যায়। অন্যদিকে শেখ রেহানাও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। তার এক কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে টিউলিপ নিশ্চিতভাবে মন্ত্রী হবেন। শেখ হাসিনারও জননেত্রী হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ছোট বোন শেখ রেহানার অবদান কম নয়।

আমার গর্ব, আমি এই ইতিহাসের একজন গর্বিত সাক্ষী। এই ইতিহাস সবটা লিখতে গেলে একটা মহাভারত হবে। তাই তার অংশ মাত্র লিখে কলম এখানেই থামালাম। আমি এই দুই বোনের দীর্ঘ আয়ু এবং আরও সমৃদ্ধি কামনা করি।”

ইতিহাসের গর্বিত সাক্ষীর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা!