ভিসানীতির মতো শুধু হাল্কা পদক্ষেপ নয়, কঠোর স্যাংশন দিয়েও কোনো রাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তন বা রেজিম চেঞ্জ করা যায়নি। শুধু ওই সমস্ত রাষ্ট্রেরই সরকার পরিবর্তন করা গেছে, যেখানে স্যাংশনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে।
Published : 18 Jun 2023, 06:44 PM
মে মাসের ২৪ তারিখ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করবার পর সরকারের কঠোর নীতির কারণে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে আশাবাদ তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২১২ (এ) (৩) ধারা অনুযায়ী এ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এই নতুন নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশে যদি কেউ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। নির্বাচনকে বাধা বা প্রভাবিত করবার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকারি এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন।
সিপিবি এবং আরও দু-তিনটি ছোটখাটো বামপন্থী দল ছাড়া সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রায় সব রাজনৈতিক দলের কর্মীরা একে ইতিবাচক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, যারা মতাদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সমর্থন করেন না, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তাদের প্রায় সবাই আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন ভিসানীতিতে উৎসাহিত বোধ করছেন। তারা সবাই মনে করছেন, এতে সরকার বাড়তি চাপের মুখে পড়বে।
সিভিল সোসাইটি এবং দেশে-বিদেশে বসবাসকারী বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশও এ নীতির ফলে আশান্বিত হয়ে উঠেছেন। তাদের মতে, এ নীতি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বিপদ ডেকে আনবে এবং আখেরে হয়তো দলটির দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটাবে।
সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে যে সমস্ত সরকারবিরোধী সক্রিয়, তারা নানা ধরনের প্রচারণা চালাতে বাড়তি উৎসাহ বোধ করছেন। এসব প্রচারণার মূল বিষয়বস্তু হলো, আগামী দিনগুলোতে সরকারের ওপর আরও নানাবিধ কঠিন নিষেধাজ্ঞা আসতে যাচ্ছে।
সিভিল সোসাইটি এবং বুদ্ধিজীবীদের সরকারবিরোধী অংশও তাই মনে করেন।তাদের আকাঙ্ক্ষাও সেরকম। তারা চাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি করুক। নানাবিধ স্যাংশন বাংলাদেশের ওপর জারি করা হোক।
তারা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন যত কঠোর করবে, সরকারের অবস্থান তত দুর্বল হবে এবং একপর্যায়ে তা সরকারের পতন ডেকে আনবে। যদিও কেউই এখন পর্যন্ত পরিষ্কার না, মার্কিন চাপ বা স্যাংশন কী মেওয়া নিয়ে আসবে। এই ভিসানীতি সমর্থনকারী প্রায় সব মহলের আকাঙ্ক্ষা ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে হাঁটুক।
অন্তর্ভুক্তিমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করায় সরকারবিরোধীরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে নিজেদের বিছিন্ন মনে করছেন। দীর্ঘ প্রায় পনের বছরে সরকারের কঠোর নীতি মোকাবেলা করে তারা ওই অর্থে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। ফলে, হতাশার আবর্তে নিমজ্জিত বিরোধী রাজনীতি কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে এই ভিসানীতির ফলে।
বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাবাহিক যে গতিপ্রকৃতি তার পর্যবেক্ষণ থেকে এটাও অনুমেয় যে, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে, এ দলটির সমর্থক এবং বুদ্ধিজীবীরাও অনেকটা এভাবেই ভাবতেন, যেমন ভাবছেন আজকের সরকার বিরোধীরা। মার্কিন বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকাকে তারাও ইতিবাচকভাবেই দেখতেন। এ থেকে যে বিষয়টা বলা যায় তা হলো, সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি একদিকে বাংলাদেশে যেমন গণতান্ত্রিক চিন্তা, চেতনা এবং চর্চার বিকাশ ঘটায়নি; অপরদিকে, জাতীয়তাবাদী চেতনাকেও বিকশিত হতে দেয়নি। জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত না হওয়ার কারণেই অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে বারবার বিদেশী রাষ্ট্রের মুখোপেক্ষী হতে দেখা যায়।
মার্কিন ভিসানীতি ঘোষিত হবার আগে মে মাসের প্রথম দিকেই সরকারকে বিষয়টা জানানো হয়েছিল বলে জানা গেছে। এ নীতি ঘোষিত হবার পর প্রথমদিকে অনেকের কাছে আওয়ামী লীগকে কিছুটা নার্ভাস মনে হয়েছে।এসময় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার সংশ্লিষ্ট কারও কারও শক্ত মার্কিনবিরোধী বক্তব্য শোনা গেছে, যেটা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটা নতুন সংযোজন। কেননা, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ধারা হচ্ছে বাইরের কোনো রাষ্ট্র সম্পর্কে নেতিবাচক বা তাদেরকে বিরোধিতা করে মন্তব্য না করা। তবে, দলটির প্রাথমিক নার্ভাসনেস খুব অল্প সময়েই কেটে যায় মার্কিন দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত সাক্ষাৎকারের পর।
সাক্ষাৎকারে লু বেশ কয়েকবার বিরোধী দলের কেউ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করলে তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বেন বলে স্মরণ করিয়ে দেন। বিষয়টি আওয়ামী লীগ ইতিবাচকভাবে দেখে এবং ক্রমাগত বলতে থাকে যে, এ নীতি দ্বারা বিএনপিসহ যারা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে তারাই বিপদে পড়বে। এ নীতি আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে নয়, কেননা তাদের ভাষায় অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তারা বদ্ধপরিকর।
আওয়ামী লীগ মার্কিন এই ভিসানীতি বাংলাদেশের সরকারকে উদ্দেশ্য করে নয় বলে দাবি করলেও ভারতীয় বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রকাশিত মতামতভিত্তিক কলামে মার্কিন নীতি ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মতামত প্রদানকারীরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে ফেলবার কৌশল হিসেবে এ নীতি নেওয়া হয়েছে।
মূলত দুটো বিষয়ে ভারতীয় বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন। এর একটি হচ্ছে ভিসানীতির ফলে সরকার পরিবর্তন হলে বাংলাদেশে ‘ইসলামপন্থী’ রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বাড়তে পারে, যা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। অপরটি হচ্ছে, মার্কিন চাপ অব্যাহত থাকলে আওয়ামী লীগ সরকার আরও অধিক গণচীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে, যা তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে। তারা সবাই প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন এ মর্মে যে, ভারত সরকার যেন বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ হ্রাসে জোরালো ভূমিকা পালন করে।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে কেন চাপ দিচ্ছে এ নিয়ে দুটো মত আছে। এর একটি হলো, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটা ভিশন এবং মিশন রয়েছে। তাদের ভিশন হচ্ছে সারা বিশ্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সারা দুনিয়ায় এ সমস্ত লক্ষ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত। বিষয়টা অনেকটা একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি যেমন সারা বিশ্বে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হতো, অনেকটা সেরকম। বস্তুত সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার গ্র্যান্ড মিশনের অংশ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়।মার্কিন এই নীতির বৈপরীত্যও নেহায়েত কম নয়। এমন অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য রয়েছে, যে সব রাষ্ট্রে গণতন্ত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই এবং ওই রাষ্ট্রগুলো ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। সেসব রাষ্ট্রকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো চাপ না দিয়ে জাতীয় এবং ভূ-রাজনীতির স্বার্থে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রকে।
বাংলাদেশের ওপর মার্কিন চাপকে বিশ্লেষকদের আরেকটি অংশ ভিন্ন আঙ্গিক থেকে বিশ্লেষণ করেন। তাদের মতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা নয়। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রাধান্য বজায় রাখা হলো এর আসল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য হাসিল করতে গিয়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যে সমস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়, বেছে বেছে ওই সমস্ত রাষ্ট্রের বিষয়েই এ সমস্ত বিষয় জোরেশোরে সামনে আনা হয়, চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে।
এ তত্ত্বের আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল সমস্যা অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক নয়, ভূ-রাজনৈতিক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং রাজনীতি দুই ক্ষেত্রেই গণচীনের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিকসহ নানাভাবে রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়েছে। এ দুটো বিষয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ পরবর্তী বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী গণচীন এবং রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব খর্ব করা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। বস্তুত এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশে যাতে এ দুই রাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধি না পায় ওই ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সচেষ্ট। এজন্যই বাংলাদেশ সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ দেয়ার কৌশল হিসেবে এ ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। এরকমভাবে যারা বিশ্লেষণ করেন তারা মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে এ ধরনের চাপ বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে রাখবে এবং বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে সমস্ত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ তা পূরণে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন বাংলাদেশের ওপর গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি প্রশ্নে তেমন কোনো চাপ ছিল না। ট্রাম্প বহির্বিশ্বে ক্রমান্বয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়ে এনে অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে মনোযোগী হতে চাচ্ছিলেন যেটা মার্কিন Establishment পছন্দ করেনি। বস্তুত এ কারণেই আজকে তাকে একের পর এক মামলার মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলে ট্রাম্প সমর্থকরা মনে করেন।
বাইডেন ক্ষমতায় আসলে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কে আবার টানাপোড়েন শুরু হতে পারে বলে অনেকে মনে করছিলেন, যেমনটা হয়েছিল তার পূর্বসূরি ওবামার সময়ে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেকে আশঙ্কা করছিলেন, এরকম কিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে ডেমোক্র্যাটরা আবার ক্ষমতায় ফিরে এলে। লিবারেল রাজনীতির কথা বললেও বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরানো ভূমিকায় যে আবারও দেশকে নিয়ে যেতে চান, এটা তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময়েই পরিষ্কার করেছিলেন।
বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর শুধু বাংলাদেশ নয়, কিছু আফ্রিকান এবং মুসলিমপ্রধান বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের একটা অস্থিরতা, টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। এদের সবাইকে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের স্বভাবিক মিত্র বলে মনে করা হতো। এ সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, পাকিস্তান ইত্যাদি। ফলে এ সমস্ত রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক ইত্যাদি সহযোগিতা জোরদার করবার জোর উদ্যোগ নিয়েছে।
যে সমস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে তাদের প্রায় সবগুলোই স্বৈরতান্ত্রিক এবং কোনো কোনোটি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক। চীন এবং রাশিয়া কোনো রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। ওই বিবেচনা এ সমস্ত রাষ্ট্রসমূহকে চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে প্ররোচিত করছে।
বাইডেন প্রশাসন নির্বাচনকে ঘিরে আফ্রিকার তিনটি দেশ উগান্ডা, সোমালিয়া এবং নাইজেরিয়ার কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ সমস্ত দেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে ধাপে ধাপে। যেমন, ২০১৯ সালে নাইজেরিয়াতে নির্বাচনে অনিয়মের কারণে দুই ধাপে বেশ সময় নিয়ে কয়েকজন ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাদের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এটাও বলা হয়েছে, এ নিষেধাজ্ঞা নাইজেরিয়ার সরকার এবং জনগণের ওপর নয়।
ভিসা নিষেধাজ্ঞা এ তিনটি দেশের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। তিনটি দেশের কোনোটিতেই ভিসানীতির জন্য সরকারেরও পরিবর্তন ঘটেনি। তবে সোমালিয়াতে এ ভিসানীতি জনগণের অংশগ্রহণমূলক ভোটের ব্যাপারে কিছুটা ভূমিকা পালন করেছে, সেখানকার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বল হবার কারণে।
ভিসানীতির মতো শুধু হাল্কা পদক্ষেপ নয়, কঠোর স্যাংশন দিয়েও কোনো রাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তন বা রেজিম চেঞ্জ করা যায়নি। শুধু ওইসমস্ত রাষ্ট্রেরই সরকার পরিবর্তন করা গেছে, যেখানে স্যাংশনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন, বর্বর আফগান তালেবান শাসক মোল্লা ওমর বা লিবিয়ার একনায়ক মোয়াম্মার গাদ্দাফি— এদের কাউকে স্যাংশন দিয়ে টলানো যায়নি। বরং স্যাংশনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং তাদের নিজেদের সমস্ত ব্যর্থতার দায়ভার তারা আমেরিকার ওপর চাপিয়ে নিজেদের শাসন নিশ্চিত করেছে। ফলে এসব স্বৈরশাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক অভিযান চালাতে হয়েছে।
বর্তমানেও যেসমস্ত রাষ্ট্রের ওপর দীর্ঘদিন ধরে কঠোর মার্কিন স্যাংশন রয়েছে, যেমন উত্তর কোরিয়া, ইরান, কিউবা, মিয়ানমার, ভেনেজুয়েলা ইত্যাদি রাষ্ট্রেও স্যাংশনের ফলে সরকার ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। উল্লেখ্য, সে সমস্ত রাষ্ট্রের ওপরেই কঠোর স্যাংশন জারি করা হয়েছে, যাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতি, দুটোই গড়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে। তাদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ এবং ‘আধিপত্যবাদী’।
অপরদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এ দুটো রাষ্ট্রকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে। বাংলাদেশের সরকারি এবং বিরোধী দল উভয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। এমনকি জামায়াতের মতো ‘ইসলামপন্থী’ দলও আমেরিকার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে চলার নীতিতে বিশ্বাসী। ফলে এরকম একটি মার্কিনঘেঁষা দেশকে পুরোপুরি চীন-রাশিয়ার বলয়ে ঠেলে দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
যুক্তরাষ্ট্র যে তিনটি রাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক সামগ্রী আমদানি করে থাকে তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। অপর দুটি হলো চীন ও ভিয়েতনাম। পরের দুটি রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শিক শত্রু, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। বাংলাদেশ থেকে আসা ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপর তৈরি পোশাক সামগ্রীর বাজার যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান শত্রু চীনের হাতে তুলে দিয়ে তার অর্থনীতিকে আরও জোরদার করতে কোনোভাবেই আগ্রহী নয়। অপরদিকে, বর্তমান বাংলাদেশ সরকারও কোনোভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিতে উৎসাহী নয়।
এটা বলা যায় যে, বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যতটা সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সুবিধা দেবার পাশাপাশি তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের ব্যাপারেও সজাগ থাকতে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোশিয়েশনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, দেশটিতে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করা। দেখা গেছে, যে সমস্ত রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, সে সমস্ত রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তভাবে দেশের স্বার্থের প্রশ্নে দেনদরবার করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসানীতিতে যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়টির উল্লেখ নেই, সেক্ষেত্রে এটা অনুমান করা যায় যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আপত্তি নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি বলা এ কারণে সম্ভব নয় যে, তাদেরসহ বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় না। তদুপরি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশে ‘অসাংবিধানিক’, সেহেতু এর পক্ষে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জটিল।
যুক্তরাষ্ট্র যেটি দেখতে চাচ্ছে তা হলো, নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হচ্ছে কিনা। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের বিষয়টি তারা জোর দিয়ে বলছে না। বস্তুত, এ বিষয়টি বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে, তারা কি মার্কিন ভিসানীতির ওপর ভরসা করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে, নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার থাকবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা হয়েছে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সফলতার মধ্য দিয়ে এবং এর পুনঃপ্রতিষ্ঠাও হয়েছিল ৯৬-এর আন্দোলনের মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, একমাত্র আন্দোলনের সফলতার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব, সাংবিধানিক বা অন্য কোনো উপায়ে নয়।
যদি বিরোধী দল আগামী নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তাহলে এটা অনুমেয় যে, আগামী নির্বাচনও অনেকটা ২০১৪ বা ২০১৮-এর মডেলে হবে। নির্বাচনের আগে কিছুটা সংস্কার হয়তো হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই তা পূর্ববর্তী দুটি নির্বাচনের বৈশিষ্টের মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে নয়।
আর এ মৌলিক পরিবর্তন যদি না ঘটে, তাহলে এটা অনেকটাই অনুমান করা যায় যে, মার্কিন ভিসানীতি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের শাসনের যে দীর্ঘ ধারাবাহিকতা, সেটি আগামী নির্বাচনের পরেও অব্যাহত থাকবে।