Published : 07 Jun 2008, 01:10 PM
খাদ্য সবার কাছেই রসনাকর। দেহে রসনেন্দ্রিয়র সংখ্যাও বেশী। অথচ খাদ্য দিন দিন আতংকের বস্তু হযে দাঁড়াচ্ছে। কিনতে গেলে দাম শুনে আতংক। কেনার পর ভেজাল হওয়ার আতংক। কিনতে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে আতংক। অদুর ভবিষ্যতে একেবারেই খাদ্য পাওয়া যাবে কি না সেটা ভেবেও আতংক। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও পত্রিকায় প্রতিনিয়ত খাদ্যে ভেজালের খবর পড়ে এই আতংকের মাত্রাও বাড়ছে।
জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের স্থান বলা যায় সারা বিশ্বে প্রথম। প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় এক হাজার এক শত পঞ্চাশ জনের বাস। ঘনত্বের বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে আরো ৭/৮টি দেশ এগিয়ে আছে। যেমন বারমুদা, মালটা, সিঙ্গাপুর। তবে এগুলোর এক একটার আয়তন শহর থেকেও ছোট। সবগুলো মিলিয়ে ২,৫০০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যায় এক কোটি ৩০ লক্ষ। বাংলাদেশের মোট এলাকা থেকে নদী, খাল, বিল, রাস্তাঘাট, বসতি এলাকা বাদ দেয়া হলে জনসংখ্যার ঘনত্ব দাঁড়াবে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় দুই হাজার।
আমাদের মাথাপিছূ মোট জমির পরিমাণ হল ২২ শতক। একজন অষ্ট্রেলিয়ানের আমাদের তুলনায় মাথাপিছু জমির পরিমান ৩৮৫ গুণ বেশী, কানাডিয়ানের ৩৩২ গুণ, আমেরিকানের ৩৫ গুণ, চায়নীজের ৮ গুণ, পাকিস্তানীর ৫ গুণ, ভারতীয়র ৩ গুণ এমনকি জনাধিখ্য আর একটি দেশের বাসিন্দা একজন ইন্দোনেশীয়ানেরও ১০ গুন বেশী জমির মালিক। মাথাপিছু মোট জমির মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ সর্বসাকুল্যে ১২ শতক। অর্থাৎ ৭২ ফূট বা ২২ মিটার দৈর্ঘ ও প্রস্থের এক খন্ড জমি থেকে প্রতি বাংলাদেশীর খাদ্যের জন্য চাল, গম, সব্জি, মরিচ, পেঁয়াজ, সরিষা, ডাল, মাছ উৎপাদন ও মুরগী, গরু, ছাগল, ভেড়া পালন ও তাদের খাদ্যও উৎপাদন করতে হয়। এই জমির আবার কিছূ অংশ বন্যায় প্লাবিত হয়, কিছু অংশ খরায় আক্রান্ত হয়, কিছু অংশ থেকে বন্যার পানি সময়মত নিষ্কাশিত হয় না এবং কিছু অংশে সেচ পানি পাওয়া যায়না। এছাড়া অতিরিক্ত ও অসম সার ব্যবহারে ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ীঘর, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও শিল্প, কলকারখানা, দোকানপাট ইত্যাদি স্থাপনের জন্য খাদ্য উৎপাদনের জন্য জমির পরিমাণ কমে আসছে।
বর্তমানে আমাদের প্রায় সব ধরণের খাবার অন্যান্য দেশ থেকে কিনে খেতে হচ্ছে। চাল, গম, ভুট্রা, বার্লি, ডাল, সরিষা, সুর্যমুখী, তৈল, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন, হলুদ, এলাচি, গোল মরিচ, লবঙ্গ, আলু, টমাটো, ফুল কপি, বাঁধাকপি, মাছ, ডিম, মুরগী, গরু, মহিষ, মাছ, মাংশ, চর্বি, দুধ, পনির, মাখন, চিনি, নারকেল, লেবু, আপেল, আঙ্গুর, বেদানা, নাশপতি, তরমুজ, চা, কফি, আরো অনেক কিছূ। শুধু আমাদের জন্যে নয়, মুরগী ও মাছের খাদ্যও বিভিন্ন দেশ থেকে কিনতে হচ্ছে। দেশে আমদানী বাবদ খরচ রফতানী বাবদ আয়ের তুলনায় ১০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ বেশী। আমদানী বাবদ এতো অর্থ কোথা থেকে আসছে? হয়তবা বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ থেকে, গার্মেন্টস তৈরী বাবদ মজুরীর অর্থ থেকে বা অন্য আয় বা উৎস্য থেকে।
সবকিছু মিলে ভবিষ্যতে আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে তেমনি খাদ্যের জন্য আমরা অন্য দেশের উপর বেশী বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। অন্য দিকে, উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেশী হওয়া এবং বিদেশ থেকে আমদানী করার কারণে দাম বেড়েই চলেছে। জনাধিক্যের ফলে আমাদের মাথাপিছূ বার্ষিক আয় কিন্তু কমেনি, বরং বেড়েছে। বছরে শতকরা ৫ ভাগেরও বেশী হারে। এতে করে ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে বৃদ্ধির সাথে সাথে, বাজারে খাদ্য চাহিদা বাড়ছে । গরীব দেশে বাস করেও এবং আমাদের গড় আয় উন্নত দেশের তুলনায় নগন্য হওয়া সত্বেও আমরা আমেরিকা, ইউরোপে যে দামে বিক্রি হয় তার কাছাকাছি, কোন কোন ক্ষেত্রে সমান এমনকি বেশী দামেও কোন কোন খাদ্য কিনে খাচ্ছি। দাম বেশী হওয়ার সুযোগে খাদ্যে ভেজালও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। তৈরী, প্রক্রিয়ায় ও সংরক্ষণে নানা ধরণের রসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারে খাদ্য বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। হয়ত এ কারণে নানারোগে আক্রান্ত মানুষে ক্লিনিক ও হাসপাতাল ভরে যাচ্ছে। নতুন নতুন ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার হচ্ছে। ডাক্তারের ফিস আর চিকিৎসার খরচ বাড়ছে। আমরা কেউ কেউ এ ব্যপারে হুশিয়ার হয়ে বিভিন্ন ধরণের ব্যবস্থা নিচ্ছি। কেউ দেশের বাড়ী থেকে চাল ডাল আনছেন। কেউ বা বিদেশী তেল খাচ্ছেন। অগার্নিক খাবার কিনছেন। কেউ কেউ দেখেশুনে যাচাই করে কিনছেন। এতে কতটুকু নিস্তার পাচ্ছেন জানি না। তবে অনেকেই ক্রমান্বয়ে আশংকিত হয়ে পড়ছেন। আলাপ আলোচনা কালে এ প্রসঙ্গ প্রায় স্থান পাচ্ছে। তবে এগুলো কি যথেষ্ট?
খাদ্য সরবরাহ ও সহজ লভ্য করা এবং ভেজাল মুক্ত ও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা সরকারের দায়ীত্ব। যে কোন দেশের একজন নাগরিকের অধিকার রয়েছে সে যেন তার প্রয়োজনীয় খাদ্য সহজে ও আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে নির্ভেজাল খাদ্য ক্রয় করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন দেশে উপযুক্ত নীতি, পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা । তবে এ ব্যপারে নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। উদাহরণ স্বরুপ সরু চালের প্রসঙ্গ তোলা যেতে পারে। সম্প্রতিক কালে সরু ফর্সা চালের চাহিদা বেড়ে গেছে। চালের দোকানগুলোতে পাজাম, নাজিরশাইল, কাটারীভোগের বস্তায় ঠাসা। বাংলাদেশে দেশী জাতের সরু চাল এর উৎপাদন খুব বেশী হলে মোট চাল উৎপাদনের শতকরা ১০ ভাগ। তাহলে এত সরু চাল কোথা থেকে আসছে। মোটা চাল কলে ছাটাই এর সময় সরু করে, ইউরিয়া ব্যবহার করে ফর্সা রূপ দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বলে ক্রেতাদের অভিযোগ। চাহিদা যদি বেশী হয় এবং ক্রেতা যদি না চিনতে পারে তাহলে মোটা চাল সরু চালে রুপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। যারা চিনেন না তারা প্রতারিত হবেন। আর যারা চিনেন তারা প্রতারণা থেকে রেহাই পেতে এই চাল কিনবেন না। নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ভেজাল খাদ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকা। এর জন্য কম খেতে হলেও। বিশ্বে আর কোন দেশে এত ভেজাল খাদ্য আছে কি না জানিনা। তবে এ জন্য আমাদের মত ভোক্তারাও যথেষ্ট দায়ী।
দূষণমুক্ত ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নব্বই দশকের শুরু থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। খাদ্য অধিদপ্তর থেকেও এ ধরণের কার্যক্রম হাতে নিয়ে ভেজাল খাদ্য ক্রয়ে জনগণকে সতর্ক ও অনুৎসাহিত করতে পারে। একই সাথে সরকারী উদ্যোগে প্রয়োজন কৃষি প্রতিবেশ পদ্ধতিতে খামার ব্যবস্থাপনা পুনঃচালু করা। গত শতাব্দির ষাট দশকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লব এর আগে সারা দেশে কৃষি প্রতিবেশ পদ্ধতিতে আবাদ করা হতো। একই জমিতে বছরে দেশী জাতের নানা ধরণের ফসলের আবাদ করে ও গাছের ডালপাতা, শিকড় ও খড়কুটা এবং গোবর পঁচা সার জমিতে প্রয়োগ করে উর্বরতা রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। দেশী জাতের ফসলের রোগ বালাই এর আক্রমণ কম হওযায় কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হতো না। ভালো বীজ বাছাই করে, সময়মত আবাদ করে, হাতে নিড়ানি দিয়ে রোগবালাই আক্রমণ ঠেকানো হত। ফসলের খড়, ধানের ভূষি ও কুড়া, ডালের খোসা, সরিষার খৈল ইত্যাদি ছিলো গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁসমুরগী ও মাছের খাবার। সবার বাড়ীতেই এগুলো পোষা হত।
কৃষি প্রতিবেশ পদ্ধতিতে খামার ব্যবস্থাপনায় ফসলের ফলন হয়ত তুলনামূলকভাবে কম হতে পারে। ফলে ভাত, রুটি, ডাল হয়তোবা কম খেতে হতে পারে। কিন্তু দেশীয় ফল, শাকসব্জি, হাঁসমুরগীর ডিম, গরুর দূধ ও মাছ বেশী করে উৎপাদন করে আমরা পেট ভরাতে পারব। নির্ভেজাল খাবার খেলে শরীর স্বাস্থ ঠিক থাকবে। বর্তমানে বছরে প্রায় ৪০ লক্ষ টন রাসায়নিক সার ও ৩০ হাজার টন কীটনাশকের ব্যবহার ও এ বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমাতে পারব। এত পরিবেশ দূষণও কমবে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এ ব্যপারে সচেতন। জাপান রাসায়নিক সার এর ব্যবহার বেশ কমিয়ে এনেছে। বিগত ১৯৮৬ সালে জাপানে ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সার প্রয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে বছরে ২১ লক্ষ টনে পৌছে। সার্কুলেটিং অর্গানিক ফার্টিলাইজার প্রয়োগ পদ্ধতিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার দশ বছরের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা হয়। এই পদ্ধতিতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সকল পরিত্যক্ত জৈব পদার্থ বা বর্জ্য দ্রব্য জমিয়ে স্তুপ করে, ভিতরে পরিমিত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়ে অফুরন্ত মাইক্রো অর্গানিজম বা ক্ষুদ্র জীবানু উৎপাদনের পর জমিতে প্রয়োগ করে আমাদের দেশেও রসায়নিক সার ব্যবহার কমানো সম্ভব। জাপান ২০০০ সালে টেকসই কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি প্রয়োগে উৎসাহিত করার জন্য আইন প্রণয়ণ করে। এর ফলে রসায়নিক সারের ব্যবহার আরো কমতে থাকে। আমাদের দেশে এখনই এ ব্যপারে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে নীতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
জাপানে জনসংখ্যা ১৩ কোটি, বাংলাদেশের থেকে এক-পঞ্চমাংশ কম। মাথাপিছূ ফসল আবাদি জমির পরিমাণ আমাদের তুলনায় অর্ধেক, সোয়া ৫ শতাংশ। সারা দেশে বছরে সোয়া ১ কোটি টনের কম চাল উৎপাদিত হয় যা আমাদের মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ। সারা বছরে একজন জাপানী গড়ে ৭০ কেজি চালের ভাত খায়। আর আমরা, ১৫৯ কেজি চালের। উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে ভাত খাওয়ার পরিমাণ কমছে। পনের বছর আগেও আমরা গড়ে ১৬৭ কেজি চালের ভাত খেতাম। আমাদের শাকসব্জি, ফলমুল, আলু, ডাল খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে। দেশীয় জাতের চাল, গম, ডাল, ডিম, মুরগী, গরুর দুধ, মাছ, সব্জি, ফলের চাহিদা বেড়েছে ও বেশী দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে করে কৃষি প্রতিবেশ পদ্ধতিতে খামার ব্যবস্থাপনায় ধানের উৎপাদন কমিয়ে আমাদের অন্যান্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অফুরন্ত সুযোগ তৈরী হয়েছে। এখন থেকে সচেষ্ট হলে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন করে, এর মুল্য ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রেখে, ভেজালমুক্ত সরবরাহ করে নিকট ভবিষ্যতে খাদ্যাতংক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশা করতে পারি।
কিউ এস ইসলাম : কৃষি ও পানি বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে জাইকার সহযোগিতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কর্তৃক বাস্তবায়িত ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে কনস্যালট্যান্ট হিসেবে সংশ্লিস্ট আছেন।