বয়স ৪০ হলেই দুই বছর অন্তর নারীর ম্যামোগ্রাম করার প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রে

যুক্তরাষ্ট্রের একটি খসড়া স্বাস্থ্য নীতিতে ৪০ থেকে ৭৪ বছর বয়সী নারীদের প্রতি দুই বছরে অবশ্যই ম্যামোগ্রাম পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2023, 10:00 AM
Updated : 18 May 2023, 10:00 AM

পঞ্চাশ নয়, বরং বয়স ৪০ বছর হলেই নারীর ম্যামোগ্রাম পরীক্ষা করানোর পরামর্শ এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে একটি স্বাস্থ্য পর্ষদের করা খসড়া নীতিতে।

তাদের ভাষ্যে, ১০ বছর এগিয়ে এনে স্তনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা গেলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর স্তন ক্যান্সারে হাজার হাজার মৃত্যু ঠেকানো যাবে।      

ইউএস প্রিভেনটিভ সার্ভিস টাস্ক ফোর্স নামের এই পর্ষদ খসড়া স্বাস্থ্য নীতিতে বলছে, বয়স যদি হয় ৪০ থেকে ৭৪, তবে অবশ্যই নারীদের প্রতি দুই বছর পর পর ম্যামোগ্রাম পরীক্ষা করাতে হবে।

এর আওতায় থাকবেন সিসজেন্ডার বা রূপান্তরকামী এবং জন্মের পর যাদের লৈঙ্গিক পরিচয় নারী নির্ধারণ করা হয়েছে তারাও।

ওই খসড়া নীতির খবর দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রে চল্লিশে পৌঁছানো নারীদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়ে গেছে।

টাফটস ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক জন ওং এই খসড়া স্বাস্থ্য নীতি কমিটিতে রয়েছেন। তিনি জানান, প্রতিবছর স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা দুই শতাংশ করে বেড়ে চলেছে।

এই পর্ষদ বলছে, চিকিৎসকরা আগেভাগে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারলে আরও অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব।

ওং বলেন, “এখন তো বিষয়টা একেবারেই স্পষ্ট, বয়স যখন ৪০, তখন প্রতি বছর অন্তর অন্তর পরীক্ষা করালে অন্তত ২০ শতাংশ বেশি নারীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।

”কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের জন্য এতে আরও উপকার হবে। কারণ স্তন ক্যান্সারে তাদের মারা যাওয়ার ঘটনা অনেকটা বেশি।”

যুক্তরাষ্ট্র নারীরা ত্বকের ক্যান্সার ছাড়াও স্তন ক্যান্সারে অহরহ আক্রান্ত হচ্ছে। ক্যান্সারে মৃত্যু হারে স্তন ক্যান্সার রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে।  

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য অনুসারে, শ্বেতাঙ্গ নারীর তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা চল্লিশের আগেই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন; বেশিরভাগ সময়ই তা ট্রিপল-নেগেটিভ স্তন ক্যান্সার পর্যায়ে চলে যায়।

শরীরে ইআর, পিআর এবং এইচইআর২ প্রোটিন নেগেটিভ হলে অর্থ্যাৎ শরীরে না পাওয়া গেলে এই ধরনকে ট্রিপল নেগেটিভ স্তন ক্যান্সার বলা হয়। সাধারণ স্তন ক্যান্সার থেকে এই ক্যান্সার ভয়ঙ্কর হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৪৩ হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে ভুগে মারা যায় বলে জানাচ্ছে ওয়াশিংটন পোস্ট।

স্তন ক্যান্সার শনাক্তে ম্যামোগ্রাম উচ্চ পর্যায়ের মান সম্মত পরীক্ষা। মূলত ম্যামোগ্রাম এক ধরনের এক্সরে। স্তনের এই এক্সরে পরীক্ষা থেকে লক্ষণ ও ল্যাম্পস বা পিণ্ড শনাক্ত করা সম্ভব।

প্রতি বছর বনাম দুই বছর অন্তর স্তন পরীক্ষা

প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হওয়া এবং সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়েও নির্দেশনা রয়েছে সরকারি খসড়ায়। কারণ অনেক সময় ফলস পজিটিভ বা ভুল রিপোর্ট আসতে পারে। তাতে করে মানসিক চাপ তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় আরও অনেক পরীক্ষা, চিকিৎসকের খরচ বহন করতে হয়।

এছাড়া খুব অল্প পরিমাণে হলেও পরীক্ষায় এক্সরে রশ্মি শরীরে প্রবেশের ঝুঁকি থেকে যায়।

স্তন ক্যান্সার পরীক্ষার বয়স কমিয়ে আনার জন্য সরকারি কমিটির প্রশংসা করেছেন অনেক স্তন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ।

এর সঙ্গে অবশ্য অনেক পেশাদার সংস্থা ও চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু পরামর্শই পর্যাপ্ত নয়। তাদের দাবি, কমিটি যেন প্রতি বছর ম্যামোগ্রাফি করানোর নির্দেশনা দেয়। 

দুই বছর পর পর পরীক্ষা করানোর চেয়ে নারীর পক্ষে প্রতি বছর ম্যামোগ্রাম করানোর বিষয়টি মনে রাখাও সহজ হবে।

মাঝের বছরে যদি পরীক্ষা করা না হয় তবে ক্যান্সার স্তনে ছড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট সময় পেয়ে যাবে।  

মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারের ব্রেস্ট ইমেজিং সার্ভিসের প্রধান ম্যাক্সিন জোচেলসন বলেন ”স্তন পরীক্ষায় দুই বছরের বিরতিতে কারো ক্যান্সার শরীরে ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে ‍উঠতে পারে।

”ফলে পরে চিকিৎসায় সেরে ওঠার সম্ভাবনা কমে যাবে। তাতে করে বাড়তি চিকিৎসা দেওয়ার মত পরিস্থিতি দেখা দেবে।”

অন্যদিকে এক বছর পর পর পরীক্ষা করানো গেলে ফলস পজিটিভ রিপোর্ট আসার সম্ভাবনাও কমে আসে।

দেখা গেছে, ১২ শতাংশ ম্যামোগ্রাফি পরীক্ষায় অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ার কারণে নারীদের বাড়তি পরীক্ষার জন্য সুপারিশ করা হয়।

এর মধ্যে চার দশমিক ৪ শতাংশ অথবা সব মিলিয়ে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশের ক্যান্সার শনাক্ত হয়। ৩০ লাখ পরীক্ষার রিপোর্ট বিশ্লেষণ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

বাড়তি পরীক্ষা করানো নারীর জন্য চাপের হলেও এই কারণে বছর বছর পরীক্ষা না করানোর পরামর্শ থেকে সরে আসা সঠিক বলে মনে করছেন না জোচেলসন।

তিনি বলেন, “হ্যাঁ, ম্যামোগ্রাম করার বিষয়টি নারীকে অস্থির করে তোলে। কিন্তু বেশিরভাগের রিপোর্ট স্বাভাবিক আসে। তারপর তো জীবন জীবনের মতই চলতে থাকে।”

স্তন ক্যান্সার শনাক্তের নানা পরীক্ষার পরামর্শ

যুক্তরাষ্ট্রে বেশির ভাগ চিকিৎসক ও বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো টাস্ক ফোর্সের পরামর্শকেই অনুসরণ করে থাকে।

এই টাস্ক ফোর্স চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠন করা হয়, যাদের নিয়োগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হেলথ ও হিউম্যান সার্ভিস অধিদপ্তর।

আর এই টাস্ক ফোর্স গঠন করার উদ্দেশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত করা অথবা প্রতিরোধ করা।

কিন্তু আরও অনেক সংস্থা ম্যামোগ্রাফি পরীক্ষা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে বলে জানাচ্ছে ওয়াশিংটন পোস্ট।

এতে করে দ্বিধা দেখা যাচ্ছে নারীদের মাঝে। এমনকি চিকিৎসকরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি বলছে, সব নারীরই উচিত ৪৫ বছর বয়স থেকে প্রতি বছর পরীক্ষা করা।

আর যাদের ঝুঁকি রয়েছে, তাদের বেলায় অবশ্যই ৪০ বছর বয়স থেকে ম্যামোগ্রাফি করাতে হবে।

আমেরিকান কলেজ অফ রেডিওলজি অ্যান্ড সোসাইটি অফ ব্রেস্ট ইমেজিং বলছে, যেসব নারীর গড়পড়তা ঝুঁকি রয়েছে, তাদের ৪০ বছর বয়স থেকে প্রতি বছর পরীক্ষা করতে হবে।

কিন্তু তাদের সবারই ২৫ বছর বয়সে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নিজের ঝুঁকি সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। 

আমেরিকান কলেজ অফ অবস্টেট্রিশিয়ানস থেকেও বলা হচ্ছে, বয়স ৪০ হলে প্রতি দুই বছর পর পর পরীক্ষা করাতে হবে তাদের, যারা স্তন ক্যান্সার হওয়ার গড় ঝুঁকিতে রয়েছেন।

তবে পরীক্ষা শুরুর বয়স বলা হলেও নারীরা কোনো বয়সে পরীক্ষা করানো বন্ধ করবে এ নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই।

স্তনের ঘন টিস্যু নিয়ে আরও অনেক গবেষণা বাকি

৭৪ বছর বয়সী নারীর বেলায় স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ও নিয়মিত পরীক্ষা করানোর উপকারিতা নিয়ে সুষ্পষ্ট কোনো প্রমাণ পায়নি টাস্ক ফোর্স। খসড়ায় এই সীমাবদ্ধতার উল্লেখ রয়েছে।

বংশগতভাবে যাদের স্তন ক্যান্সারে ইতিহাস রয়েছে এবং যাদের স্তনে ঘন টিস্যু রয়েছে, টাস্ক ফোর্সের পরামর্শ মূলত তাদের জন্য। 

কিন্তু যাদের স্তন বায়োপসি হয়েছে, স্তন ক্যান্সার হয়েছে অথবা বিআরসিএ১ ও বিআরসিএ২ জিনের রূপান্তর হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের জন্য এই পরামর্শ নয়।

ওং বলেন, এই নির্দেশনা প্রতিরোধমূলক ওষুধের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে।

“যেসব নারী উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের অবশ্যই স্তন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসায় থাকতে হবে। এ ধরনের রোগী সম্ভবত বিশেষজ্ঞের কাছ থেকেই ভালো নির্দেশনা পাবেন।”

নতুন পরামর্শে অবশ্য আলট্রাসাউন্ড অথবা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং বা এমআরআই কিংবা এমন অন্যান্য সম্পূরক পরীক্ষা নিয়ে কিছু বলা নেই।

স্তনে ঘন টিস্যু যাদের রয়েছে, অথবা ম্যামোগ্রাম করানোর মত পর্যাপ্ত টিস্যু যাদের নেই তাদের জন্য পরামর্শ জরুরি ছিল।

যারা মাসটেকটমি করে স্তনের সব টিসু অপসারণ করেছে, তাদের জন্যও খসড়ায় থাকা পরামর্শ কার্যকর হবে।

একই সঙ্গে নন-বাইনারি অথবা ট্রান্সজেন্ডার, যারা স্তনের টিস্যু অপসারণ করেছেন কিন্তু নিয়মিত পরীক্ষা জরুরি, তাদের জন্যও এই পরামর্শ কাজে কাজে দেবে।

গত মার্চে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রিশন তাদের ম্যামোগ্রাফি নীতিমালা হালনাগাদ করেছে।

এতে বলা হয়েছে, রোগীকে স্তনের ঘন টিস্যু নিয়ে জানাতে হবে এবং যাদের স্তনে ঘন টিস্যু রয়েছে তাদের প্রত্যেকের চিকিৎসকের কাছ থেকে নিজ নিজ ঝুঁকি নিয়ে জানতে হবে। 

ওং বলেন, “আমরা জরুরি ভিত্তিতে আরও আরও গবেষণা আহ্বান করছি। কারণ নারীদের এসব জানার অধিকার রয়েছে।”

যে কোনো পেশাদার সংস্থা, চিকিৎসক, ব্যক্তি টাস্ক ফোর্সের ওয়েব সাইটে গিয়ে আগামী ৫ জুন পর্যন্ত এই প্রস্তাবিত খসড়া পড়ে দেখার সুযোগ পাবেন।

খসড়া চূড়ান্ত হলে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নাল জেএএমএ তা প্রকাশ করবে।