নারীর স্তন ক্যান্সার যখন মনেরও যুদ্ধ

স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর জন্য এই ধাক্কা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকও। অনেকের চিকিৎসার খরচ চালানোর সামর্থ্য থাকলেও সুস্থ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাতে হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেরুন নাহার মেঘলা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2021, 04:51 PM
Updated : 12 June 2021, 06:31 PM

নিজে ভুগেছেন এবং পরিবারের মানুষটিকে স্তন ক্যান্সারে ভুগতে দেখেছেন, এমন দুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন তাদের অভিজ্ঞতার আদ্যোপান্ত।

নিজেকে এই যুদ্ধে এখন জয়ী বলতে চান খন্দকার শাহানা বিলকিস। দুই বছর আগে ৩৫ বছর বয়সে স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে তার।

শরীরে এই ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে তা কি শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন?

খন্দকার শাহানা বিলকিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৮ সালের ঘটনা। সে সময় আমার টুইন বেবি ব্রেস্ট ফিডিং করত। এর আগে আমার ছেলে ওর দুই বছর বয়স পর্যন্ত ব্রেস্ট ফিডিং করেছে। এখন ওর বয়স ১৬। জমজ মেয়ে বাচ্চা দুটো দেড় বছর এক্সট্রিম ব্রেস্টফিড করেছে।

“একসময় খেয়াল করলাম আমার ডান হাতের আর্মপিট (বগল) অস্বাভাবিকভাবে ফুলতে শুরু করলো। ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। ব্রেস্ট ফিডিং বন্ধ করলে ডান স্তনে দুটি চাকার মতো হলো। মাসখানেক পরে একটা চাকা মিলিয়ে গেলেও আরেকটা চাকা রয়ে যায়। সেটা কিছুটা ডান দিকের কলারবোনের কাছাকাছি। আর ডান হাতের আর্মপিট যথারীতি ফুলেই থাকে।”

এরপরও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বেশ সময়ই লেগেছিল তার; প্রায় বছরখানেক। কিন্তু কেন?

“যেহেতু স্তন একটা গোপন অঙ্গ হিসেবেই বিবেচিত এবং যেহেতু ব্যাপারটি আমাকে তেমন একটা যন্ত্রণা দিত না, অতিরিক্ত ব্যথাও ছিল না, তাই আমি ব্যাপারটি নিয়ে আর ডাক্তারের শরণাপন্ন হইনি।”

সেই সঙ্গে কাজ করেছে লজ্জা ও জড়তাও।

শাহানা বলেন, “হাজবেন্ডকে বিষয়টি জানানোর পর তিনিও ততটা গুরুত্ব দেননি।

“প্রথমে ভেবেছিলাম ভালো কোনো সার্জনের কাছে যাব। কিন্তু পরে ভাবলাম এক্ষেত্রে স্পর্শ করা লাগতে পারে বিধায় কোনো পুরুষ ডাক্তারের কাছে না যাওয়াই ভালো। এভাবেই দোনোমনা করতে গিয়ে এক বছর কেটে গিয়েছিল।”

শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে প্রথমবার চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন এই নারী।

“পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঢাকা মেডিকেলের একজন ডাক্তার বললেন, লক্ষণগুলো বেশি ভালো না। উনি আমাকে এফএনএসি এবং একটা আলট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দিলেন।”

ক্যান্সার শনাক্তে সুই দিয়ে শরীর থেকে কোষ ও তরল নিয়ে দেখা হয় 
এফএনএসি বা 
ফাইন নিডল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি পরীক্ষায়। আর এতে ‘ইনফেকশন’ ধরা পরে শাহানার।

এরপর চিকিৎসা শুরু হলেও এই চিকিৎসা নিয়েই নানা বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে থাকেন তিনি।  .

প্রথমে একজন চিকিৎসক তাকে ১৫ দিন করে তিন দফায় ৪৫ দিনের অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন। কিন্তু তাতেও স্তন আর বগলের চাকার কোনো পরিবর্তন আসেনি। এরপর তাকে অস্ত্রোপচার করে ডান স্তন থেকে লাম্প অপসারণের পরামর্শ দেওয়া হয়।

সাহানা বলেন, “তখনও বায়োপসিও করানো হয়নি। আমাকে তখনও ক্যান্সারের উপস্থিতির ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি যদিও সেই ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে আমি লিফলেটে পড়েছিলাম স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ সম্পর্কে; যেগুলোর বেশিরভাগই আমার মধ্যে ছিল।”

সিদ্ধান্ত নিতে তখন অন্য এক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি, যিনি তার খালু। এই চিকিৎসক তাকে বিএসএমএমইউর একজন সার্জনের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং সার্জারি করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোর বায়োপসি করানোর কথা বলেন।

কিন্তু সাহানা আগের চিকিৎসককে বিষয়টি জানালে তিনি এতে গুরুত্ব না দিয়ে অস্ত্রোপচার করে ফেলেন। তারপর ধরা পড়ল যে তার স্তনে ক্যান্সার।

তিনি বলেন, “(সার্জারির পর) আর্মপিট আগের মতোই রয়ে গেল। বায়োপসি করতে দেওয়া হল। ১২ অগাস্ট বায়োপসির রিপোর্টে ধরা পড়ল আমার ক্যান্সার তৃতীয় ধাপের একদম কাছাকাছি।

“এই অসম্পূর্ণ অপারেশনের পর আমার শরীরে ক্যান্সার দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। পরবর্তীতে অন্য চিকিৎসকের কাছে গেলে তারা বললেন, আমার ক্যান্সার এরিয়া মূলত ছিল আর্মপিটে। সেখানে তারা প্রায় ২৭টি গ্ল্যান্ডের সন্ধান পেলেন।”

ঝুঁকি এড়াতে এরপর সাহানার ডান স্তনটি কেটে ফেলে দিতে বাধ্য হন। এরপর ওরাল কেমো নিয়ে ২০২০ সালে ক্যান্সারমুক্ত হন তিনি।

“তারপরেও পুরোপুরি বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য আমাকে কিছু ইঞ্জেক্টেবল কেমো নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হল, যার মাধ্যমে ক্যান্সারের  ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যাবে।”

এ বছর ২৮ জানুয়ারি থেকে সেই কেমো নেওয়াও শুরু করেছেন শাহানা।

এখন নিজেকে স্তন ক্যান্সার ‘জয়ী’ বলা এই নারীকে সুস্থ হতে চিকিৎসার নানা ধাপে সহ্য করতে হয়েছে শারীরিক যন্ত্রণা।

তিনি বলেন, “ওরাল কেমো নেওয়ার সময় শরীর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। হাত-পা কালো হয়ে গিয়েছিল, মুখে র‌্যাশ হয়েছিল এমনকি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। ইঞ্জেক্টেবল কেমোও আমাকে কষ্ট দিয়েছে।”

পাশাপাশি আর্থিক খরচের কথাও বলেন তিনি।

“শুরু থেকে এই পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ টাকা চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়েছে।”

তবে তারপরও নিজেকে নিয়ে এখন ‘আনন্দিত’ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ইনফোসিস্টেম সলিউশন লিমিটেডের পরিচালক শাহানা।

তবে শাহানার মতো যুদ্ধজয়ের গল্প বলতে পারলেন না আফসানা কিশোয়ার লোচন। স্তন ক্যান্সারে মা হারিয়েছেন তিনি।

আফসানা কিশোয়ার লোচনের মা রোকেয়া সুলতানা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা। স্তন ক্যান্সারে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি ৬৫ বছর বয়সে মারা যান তিনি।

বর্তমানে কানাডা প্রবাসী আফসানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৯৯১ সালে মায়ের হিস্টেকটোমি বা জরায়ুর অপসারণ অপারেশন করা হয়।

“এরপর উচ্চ রক্তচাপ আর হার্ট এনলার্জ ছাড়া আর সব ঠিকই ছিল। ডায়াবেটিস নেই, ৬৫ বছরের মানুষটা রিটায়ারমেন্টের পর থেকে কাজ করে যায় বাসায়। মামুলি কিছু অসুখ-বিসুখ ছাড়া তেমন কোনো শারীরিক অভিযোগ নেই।”

২০১৩ সালে মায়ের ডান স্তনে ছোট লাম্প হয় বলে জানালেন মেয়ে আফসানা। তখন অস্ত্রোপচার করে তা ফেলে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আবারও লাম্প দেখা দেয় একই স্তনে। তখন পরীক্ষা করে ক্যান্সার ধরা পড়ে।

আফসানা বলেন, “মাথায় মোটামুটি আকাশ ভেঙে পড়ল। ভারতের ভিসার জন্যে অ্যাপ্লাই করা হলো মেডিকেল গ্রাউন্ডে। কিন্তু ভিসা হল না। পরে দেশেই অপারেশন করানো হয়।”

ডান স্তনটি কেটে ফেলার পর বায়োপসি করলে ক্যান্সারমুক্তির তথ্য আসে। তবে দুজন চিকিৎসক বিপরীত কথা বললে ‘মানসিক শান্তির’ জন্য ২০১৫ সালের মার্চ মাসে থাইল্যান্ডের কিং চুলালংকর্ন হাসপাতালে যায় আফসানার পরিবার। 

সেখানে ২৪ মার্চ হাইটেক ল্যাবের রিপোর্টে ম্যালিগনেন্ট টিউমার ধরা পড়ে, যা দ্রুত শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছিল।

আফসানা বলেন, থাইল্যান্ডের চিকিৎসকরা রেডিওথেরাপি সাজেস্ট করার জন্য প্রথম অস্ত্রোপচারের স্লাইড চেয়ে বসেন। ২০১৩ সালের স্লাইড পাওয়া গেলেও পরেরটির স্লাইড তারা সংগ্রহ করতে পারেননি।

এর মধ্যে দেশে আগের এক চিকিৎসককে থাইল্যান্ডের সব রিপোর্ট দেখান তারা।

আফসানা বলেন, “তিনি (চিকিৎসক) আবার বলেন, দেশে-বিদেশে অনেক রিভিউ হয়েছে, পেশেন্টের কোনো ক্যান্সার নেই। তিন মাস পর দেখা করলেই হবে।

“এদিকে থাইল্যান্ডের কিং চুলালংকর্ন হাসপাতাল থেকে বাংলাদেশেই ৩০টি রেডিওথেরাপি দিতে বলা হয়। কিন্তু আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দেশের সেই চিকিৎসকের উপদেশ আঁকড়ে ধরে রেডিওথেরাপি দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।”

এদিকে রোকেয়া সুলতানার শরীর ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে।

মায়ের চিকিৎসা নিয়ে গড়িমসির দিনগুলো মনে করে আফসানা বলেন,  “এত কিছুর ভেতর তখনও কোনো ডাক্তার একটি সিম্পল পেট সিটিস্ক্যান করার পরামর্শও দেননি।”

২০১৫ সালের জুলাই মাসে দেশের আরেক হাসপাতালে রেডিওথেরাপির জন্য নেওয়া হয় রোকেয়াকে। রেডিওথেরাপি দেওয়ার আগে সিটি সিমুলেশন করে দেখা যায়, তার ফুসফুসে অনেক ‘স্পট’। অর্থাৎ ক্যান্সার তার ডান স্তন থেকে ফুসফুসের দিক পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।

রোকেয়ার শারীরিক অবস্থার উত্তরণে কেমোথেরাপি দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু এরপরও শরীর দিন দিন অসুস্থ হতেই থাকে।

আফসানা বলেন, “প্রতি ২১ দিন পরপর চারটি কেমো দিয়েও সিটিস্ক্যান রিপোর্ট সন্তোষজনক না হওয়ায় কেমো বন্ধ করে দেওয়া হয়।”

এরপর মাকে মুম্বাই নিয়ে যান আফসানা। সেখানে কাজ না হওয়ায় দেশে ফিরে আরেক হাসপাতালে ভর্তি করান। তবে চিকিৎসক বলে দেন, রোকেয়ার আয়ু আর বেশিদিন নেই।

এই অবস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন আফসানা।

তিনি বলেন, “ডাক্তারের ওই কথা শুধু আমিই জানতাম। মাকে জানাইনি; এমনকি বাসার কাউকে বলিনি। আমার মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ কাজ করছিল।

“২৮ ডিসেম্বর মাকে আমাদের উত্তরার বাসায় নিয়ে আসি। ২৭ তারিখ রাতে খুব সম্ভবত মায়ের একটা স্ট্রোক হয়; কারণ সেদিন মায়ের মুখ অস্বাভাবিক ভাবে বাঁকা এবং এক চোখ বন্ধ ছিল। সেদিন থেকেই মায়ের কথা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নীরবে নিভৃতে বুকের ভেতর একরাশ কষ্ট নিয়ে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি মা আমাদের ছেড়ে চলে যান।”

রোকেয়া সুলতানা চিকিৎসার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা খরচ হয়।

এই খরচ নিয়ে আফসোস না থাকলেও স্তন ক্যান্সারে মায়ের মৃত্যুকে এখনও মেনে নিতে পারেন না মেয়ে আফসানা।

“আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল হওয়ার পরেও শুধু পরিবারের সদস্যদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তে মাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।”