ভাঙা বন্ধুত্ব মেরামত করা উচিত। তবে বিষাক্ত বন্ধুকে ছুঁড়ে ফেলতে হয়।
Published : 27 Jun 2023, 05:26 PM
হোঁচট খাওয়া বন্ধুত্বের রাস্তা ঠিক করবেন, না-কী অন্য রাস্তা ধরবেন?
এরকম প্রশ্ন যখন নিজের মাঝেই খেলতে থাকে তখন সিদ্ধান্তহীনতার ভুগতে হয়। তবে পুরানো বন্ধুত্ব মেরামতের চাইতে, সম্পর্কটা ঝাপসা করে দেওয়ার লোভটাই বেশি জাগে, বিশেষ করে যদি জীবনে অন্য কোনো নতুন আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়।
আর কষ্ট পাওয়ার চাইতে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলাটাই বেশিরভাগের ক্ষেত্রে মুখ্য হয়।
তবে এটাও যে ঠিক না, সেটা আমরা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছি লকডাউনে একাকিত্বে ভুগে। তাই বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধারে মনের মধ্যে উতলাভাব কাজ করবেই। জৈবিকভাবেও আমরা সেভাবে তৈরি।
‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’য়ের প্রদায়ক-সম্পাদক ও বিজ্ঞান-বিষয়ক মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেনওর্থ তার বইতে লিখেছেন, “বন্ধুত্ব: বিবর্তন, জৈবিকতা এবং অসাধারণ শক্তি- জীবনের মৌলিক বন্ধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন। এভাবেই আমরা যুক্ত থাকি, এটা আমাদের ডিএনএ’তেই আছে। তাই বন্ধুত্ব কোনো বিলাসিতা নয়। বরং সফলতা এবং উন্নতির জন্য এটা আমাদের প্রয়োজন।”
যদি ভালো একজন বন্ধুর ছোঁয়া হারিয়ে যায় বা গত কয়েক বছরে চলে যায় দূরে, তবে ভুল বোঝাবুঝির অবসানে কষ্ট দূর করার এখনই সময়। মনে করতে হবে এটা নিজেকেই যত্ন করার একটি পন্থা। কারণ দ্বন্দ্বে আটকে থাকলে নিজেরই ক্ষতি।
তাই বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধাতে ৫টি ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে- আর বিষাক্ত হলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।
ভালো বিষয় লিখে ফেলা
বন্ধুর সঙ্গে কঠিন আলাপে যাওয়ার আগে একটু থামুন আর ভাবুন।
“মনে করুন বন্ধুত্বের সেই মুহূর্তগুলোর কথা, যা আপনার মনে আনন্দ বা উত্তেজনা খোরাক হিসেবে কাজ করে”, সিএনএন ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন মার্কিন মনোবিজ্ঞানি, ‘ফ্রেন্ডশিপ ইন দ্য এইজ অফ লোনলিনেস’ বইয়ের লেখক অ্যাডাম স্মাইলি পসোলস্কি।
অনুপ্রেরণার আঁধার হিসেবে বন্ধুর গুণগাণ করতে এই স্মৃতিগুলো লিখে ফেলতে হবে। আর আলাপের সময় সেগুলো বলতে হবে বন্ধুকে- পরামর্শ দেন তিনি।
আরও বলেন, “কৃতজ্ঞতা আর ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কথাবর্তা শুরু করলে অনেক কিছুই অর্থবহ হয়।”
ফলাফল যাই হোক, ইতিবাচক বিষয়টা থেকে যাবে। এমনকি আলাপের পরেও যদি খটোমটোভাব থেকেই যায়, যদি এখনও মনে হয় বন্ধুত্বে আপাতত দাড়ি টানা থাক, কিংবা দীর্ঘসময় বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধুত্ব বন্ধ হলেও, সেই কৃতজ্ঞতা থেকে তৈরি হবে সহানুভূতি।
ভিন্নভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা
ক্ষতি পোষানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ কাজ না করলে অন্যভাবেও চেষ্টা করা যেতে পরে।
পসোলস্কি বলেন, “ক্যাটালগ বা ‘বিল’য়ের চিঠি ছাড়া, পত্র পাওয়ার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে। এই ডিজিটাল যুগেও অ্যানালগ পদ্ধতিতে বন্ধুকে পোস্টকার্ড পাঠানো, চিঠি লেখা বা তার কোনো ভালো লাগার বই উপহার দেওয়া যেতে পরে।”
তিনি আরও পরামর্শ দেন, “কথা বলার আগে বরং দুজন দুজনকে চিঠি লেখার চেষ্টা করা উচিত। যেখানে উল্লেখ থাকবে কেনো এই বন্ধুত্বকে পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন।”
এই প্রস্তাব আপনার প্রতি সহানুভূতি জাগাতে সাহায্য করবে। আর বাড়াবে যোগাযোগের পারদর্শিতা।
“হয়ত আপনার বন্ধু এমন কিছুর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যেটার সম্পর্কে আপনি জানতেনই না। গুরুত্ব দিয়ে বন্ধুর কথা শোনারও দরকার, সেটার প্রশিক্ষণও হয়ে যাবে। তাই সামনা সামনি আলাপের আগে এটা আত্মস্থ করা দরকারী”, বলেন এই লেখক।
সময় নেওয়া তারপর আবার চেষ্টা করা
দ্বন্দ্ব, ঝগড়া, মনোমালিন্যের ক্ষেত্রে একেক মানুষ একেকভাবে প্রতিক্রিয়া দেয়। তাই পুনরায় চেষ্টা করার আগে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় দিতে হবে।
এই বিষয়ে ওয়াশিংটন ডিসি’র মনোবিজ্ঞানি ও বন্ধুত্ব-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মারিয়া ফ্রাঙ্কো বলেন, “বন্ধুত্বে বিবাদের পর স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। আর সেই দীর্ঘস্থায়ী অস্বস্তিকর অনুভূতির ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হতে পারে।”
“যদি এখনও বিব্রত বোধ হয় তবে ধরে নিতে হবে, সবাই নিজের কথা বলতে পারে না এবং কারও ক্ষেত্রে কঠিন”, বলেন ফ্রাঙ্কো।
তাই এই মনোবিজ্ঞানি সৎ ও উচ্ছাসময় অনুভূতিতে প্রস্তাব দেওয়ার পরামর্শ দেন। যেমন- ‘হেই- ঝগড়ার পর থেকে কিছু বিষয় কেমন বিষণ্ন লাগছে। আমাদের বন্ধুত্বটাকে আবার এক জায়গায় নিয়ে আসি চল। আমি সত্যি এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কথাবর্তা বলে চল সমাধান করি সব।’
এটাও মনে রাখতে হবে, আপনার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ততটুকুই করেছেন। তারপরও সেই বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধার না হলে নিজের সাধুতার জন্য অন্তত গর্ব করতে পারবেন।
ফ্রাঙ্কো বলেন, “মনে রাখতে হবে, আপনি কখনও অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তবে আপনার দিকে থেকে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা ঠিকই করেছেন।”
‘বন্ধুত্বের আসবাব’ রদবদল করা
একটি সম্পর্ক কেমন ছিল সেই ধারণায় আটকে গেলে, দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তবতা হল, পরিস্থিতি এবং অগ্রাধিকার পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা সবাই পরিবর্তিত হই।
তাই বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে গিয়ে যদি মনে হয়, আগের মতো আর হচ্ছে না- তবে সেই বন্ধুত্বকে হালকাভাবে নেওয়ার পরামর্শ দেন, ডেনওর্থ।
তিনি বলেন, “আমি একে সামাজিক জীবনের ‘আসবাবপত্রে রদবদল’ হিসেবে দেখি। সব বন্ধুত্ব সারাজীবন টেকে না। আর সেটাতেই ‘সন্তুষ্ট’ থাকতে হয়।”
উচ্চমাত্রায় শক্তিশালী বন্ধনের জন্য তিনটি উপাদান খুঁজে পেয়েছেন বিবর্তন-বিজ্ঞানীরা; সেগুলো হল- দীর্ঘসময় ধরে, সহযোগিতা ও ইতিবাচক মনোভাব। সম্পর্কের দৃঢ়তায় তিনটাই প্রয়োজন।
বিপজ্জনক সংকেত খেয়াল করতে হবে
কোনো সময় ভুল বোঝাবুঝি আবার কোনো ক্ষেত্রে অনেক গভীর কারণে বন্ধুত্বে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
তাই ফ্রাঙ্কো উৎসাহ দেন, “মাত্র একটি কারণের জন্য বন্ধুত্ব নষ্ট করা ঠিক না। ‘দ্বন্দ্ব’- বিষয়টাকে পুনরায় বিবেচনার মাধ্যমে বন্ধুত্বের মাত্রাকে উন্নত করার মাধ্যম হিসেবে ধরতে হবে। যা কি-না দুই পক্ষের মধ্যেই থাকবে। কোনো একটা সমস্যা হয়েছে বলেই বন্ধু ত্যাগ করো না।”
তবে বিপজ্জনক সংকেতের দিকেও নজর দিতে বলেন এই মনোবিজ্ঞানি।
তার কথায়, “বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে এক পা পিছিয়ে আসার পর যদি দেখেন, সেটা ভালোর চাইতে বেশি খারাপ হচ্ছে- হতে পারে সেই বন্ধু আপনার সাফল্যে খুশি হচ্ছে না, পেছনে বাজে কথা বলছে, সহানুভূতিহীন ও অবিবেচক অথবা তাদের কারণে নিজেকে নর্দমার পোকা মনে হয় বা তারা ভুল বুঝে- তবে রক্ষার চাইতে শেষ করাই হবে ভালো সময়।”
ভালো এবং খারাপের ভারসাম্য বিবেচনা করা জরুরি।
ডেনওর্থ বলেন, “দি সায়েন্স অফ ফ্রেন্ডশিপ’ দেখিয়েছে, প্রতিকূল সম্পর্ক আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। অন্যভাবে বললে- খুব বেশি খারাপ থাকলে ভালোটা খারাপের চেয়ে বেশি হয় না।”
“তাই স্বাস্থ্যকর বন্ধুত্বের জন্য নিজের ক্ষেত্রে সৎ থাকুন। আর যদি সত্যি কষ্ট দেয়, তবে শুধু পুরানো কথা চিন্তা করে এই সম্পর্কে লেগে থাকবেন না”, পরামর্শ দেন তিনি।
যখন জীবনে কঠিন সময় আসে তখন বিব্রতকর বা বেদনাদায়ক কথোপকথনের কারণে কী করতে হবে সেটার বুঝ থাকে না। তবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; বাজে বিষয়কে আলিঙ্গন করেও, সৎ হয়ে অনুভূতি প্রকাশে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় কখনও শেষ হয় না।
আরও পড়ুন