Published : 06 May 2025, 06:01 PM
শৈশবের ক্ষত অনেকেরই অজান্তে প্রভাব ফেলে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে। কখনও বাবা-মার ভালোবাসার অভাব, কখনও কঠোর আচরণ, আবার কখনও পারিবারিক অশান্তির স্মৃতি। এসব মিলেই তৈরি হয় ‘ইনার চাইল্ড’ বা শিশুর ভেতরের কষ্ট।
এই কষ্টের উপশম হতে পারে এক নতুন মনোচিকিৎসা পদ্ধতিতে। যার নাম ‘রিপ্যারেন্টিং’।
রিপ্যারেন্টিং কী?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মনোচিকিৎসক ও পেশাদার সেবাপ্রদানকারী নিকোল জনসন সিএনএন ডটকম’কে বলেন, “রিপ্যারেন্টিং’ মানে হল নিজেকে এমনভাবে ভালোবাসা ও যত্ন দেওয়া, যেমনটি একজন সঠিক অভিভাবক দিতেন।”
অনেকে ভাবতে পারেন এটি হয়ত নিজেকে আহ্লাদে ভরিয়ে দেওয়ার ছুতো; কিন্তু তা নয়।
এটি এক ধরনের থেরাপি, যেখানে নিজের ভেতরের শিশুটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় এবং তার পুরানো ক্ষত সারিয়ে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়।
শৈশবের প্রভাব প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে
ধরা যাক, ছোটবেলায় আপনার বাবা ছিলেন একজন রাগী ও কঠোর মানুষ। তিনি হয়ত আপনাকে কখনও আদর করে বলেননি, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
বরং সব সময় আপনাকে দোষারোপ করতেন।
এই অভিজ্ঞতা হয়তো মনে এক ভয় তৈরি করেছে।
বিশেষ করে পুরুষদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে ভয় হয়, না বলে দিতে অস্বস্তি হয়, সব সময় মানুষকে খুশি রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতে হয়।
এভাবে ব্যাখ্যা করে নিকোল জনসন বলছেন, “অনেকে বুঝতেই পারি না যে আমাদের বর্তমান সম্পর্ক বা আচরণগুলোর পেছনে ছোটবেলার কষ্ট লুকিয়ে আছে।”
রিপ্যারেন্টিং আসলে কী করে?
‘রিপ্যারেন্টিং’ শেখায়— কীভাবে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে হয়। মানে, নিজের ‘ইনার চাইল্ড’ বা ভেতরের শিশুর সুলভ সত্তার অভাব পূরণ করতে হবে দায়িত্বশীল, সহানুভূতিশীল অভিভাবক হিসেবে।
নিকোল জনসনের ভাষায়, “এটি এক ধরনের নতুন বিশ্বাস ও অভ্যাস গড়ে তোলার প্রক্রিয়া, যা নিজের প্রতি আরও দয়ালু হতে শেখায়।
এই পদ্ধতিটি কাজ করে কীভাবে?
‘সান ফ্রান্সিসকোর বে এরিয়া সিবিটিই সেন্টার’-এর ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী ডা. অ্যাভিগেইল লেভ বলছেন, “অনেকেই নিজেদের সঙ্গে এমন আচরণ করি, যেমনটি বাবা-মা করতেন। যদি তারা কড়া হতেন, আমরাও নিজেদের ভুলের জন্য নিজেকেই কঠিন শাস্তি দিই।”
এই প্যারেন্টিং পদ্ধতিতে নিজের অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভয়, দুঃখ, রাগ বা চাপকে স্বীকার করা, বিচার না করে তা বুঝে নেওয়া এবং নিজেকে বুঝিয়ে বলা হয়, “তুই ঠিক আছিস, আমি তোকে ভালোবাসি।”
এটি কোনো শিশুসুলভ আচরণ নয়
‘রিপ্যারেন্টিং’ মানে এই নয় যে আবার শিশুর মতো আচরণ করতে হবে। বরং এতে শিখবেন কীভাবে নিজের ভুলগুলো বুঝে নিজেকেই ক্ষমা করবেন, আবার কীভাবে নিজের সীমারেখাও ঠিক রাখবেন।
নিকোল জনসন বলেন, “একজন সঠিক অভিভাবক যেমন শিশুকে মারধর না করে বুঝিয়ে বলেন, ঠিক তেমনি আপনিও নিজেকে বোঝাবেন।”
কেন দরকার রিপ্যারেন্টিং?
ভার্জিনিয়ার ‘ফলস চার্চ’-এর মনোচিকিৎসক ডা. ব্রায়ান রাজিনো বলছেন, “শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, বাবা-মায়ের আবেগগত দূরত্ব বা পারিবারিক বিশৃঙ্খলাও এক ধরনের ‘ট্রমা’ তৈরি করে।”
যদি আপনি বুঝতে পারেন—
না বলতে গিয়ে অপরাধবোধ হয়
মনে হয় আপনি যথেষ্ট নন
কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সামনে ভীত হয়ে পড়েন
ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন
এগুলোর ইঙ্গিত হতে পারে যে ভেতরের শিশুটি এখনও সাহায্যের অপেক্ষায় আছে।
শুরু করবেন যেভাবে
এই মুহূর্ত থেকেই ‘রিপ্যারেন্টিং’ শুরু করা যায়। আর শুরুটা হতে পারে ছোট কিছু দিয়ে।
এখন নিজেকে একটু বেশি সহানুভূতিশীলভাবে দেখুন। আর এতে করে যদি বোঝেন, “আমি তো মায়ের মতো নিজের সঙ্গে কঠোর আচরণ করি”— তবে সেটিই প্রথম ধাপ।
নিজেকে বলুন, “আমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য, আমি নিজেকেই গ্রহণ করি।”
নিজের ভেতরের শিশুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়া
নিকোল জনসন বলেন, “ধরে নিন, আপনি ৯ বছর বয়সি, বিছানায় কাঁদছেন, কারণ বাবা কোনো কারণে বকেছে। আপনি তখন পাশে বসে তাকে বলছেন, ‘তোমার কষ্ট আমি বুঝি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।"
এভাবেই নিজের ভেতরের কষ্টকে জড়িয়ে ধরে, নিজের ভালোবাসা দিয়ে নিজেকে বড় করে তুলতে পারেন।
যেভাবে আরও গভীরে যাবেন
অনেকেই তাদের শৈশবের ছবি দেখে বা গান দিয়ে নিজেদের ‘ইনার চাইল্ড’-কে চিহ্নিত করেন। কেউ কেউ ছোটবেলার প্রিয় খাবার রান্না করেন বা বৃষ্টিতে দৌড়ান। এই ছোটখাটো আনন্দগুলোও হতে পারে ‘রিপ্যারেন্টিং’-এর অংশ।
চূড়ান্ত ভাবনা
এই কাজ সহজ নয়, অনেক সময় আবেগপ্রবণ করে তোলে। তবে ধীরে ধীরে এটি আত্মবিশ্বাস, নিরাপত্তাবোধ এবং সম্পর্কের মান উন্নত করতে সাহায্য করবে।
ডা. অ্যাভিগেইল লেভ বলেন, “যখন নিজেকে ভালোবাসতে শিখবেন, তখনই অন্যদেরও ভালোবাসতে পারবেন।”
আরও পড়ুন