পোষা প্রাণী নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম মানতে হয়।
Published : 09 Jan 2024, 12:05 PM
যার বাসায় অন্তত একটা আদরে পালা প্রাণী আছে, সেই একমাত্র জানেন এর জন্য ঠিক কতটা মায়া এবং ভালোবাসা দিনে দিনে গড়ে ওঠে। এদের ছেড়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়াও খুব মর্মান্তিক মনে হয়।
অথচ সাথে করে নিয়ে যেতে পারলে সেই শান্তির আবার কোনো তুলনা বা বর্ননা করা যায় না।
নিজের পোষা প্রাণীকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চাইলে খরচ এবং নানার প্রতিকূল অবস্থার কথা চিন্তা অনেকেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। অথচ কিছু নিয়ম মেনে এবং পদ্ধতি অনুসরণ করে খুব সহজেই সেই ভালোবাসার প্রাণীকে যে কোনো দেশেই সাথে করে নিয়ে যাওয়া যায়।
আর এই বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বিস্তারিত জানিয়েছেন প্রাণীপ্রেমি, পরিব্রাজক, রন্ধনশিল্পী সায়মা সিদ্দিকা।
ইদানিং আমাদের দেশে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিভিন্ন পরিমাণ টাকার বিনিময়ে এই কাজে আন্তরিকভাবে সাহায্য করেন।
“অনেকের সাথে কথাও বলেছি। তবে আমার কাছে নিজের করাটাই সাশ্রয়ী মনে হয়েছে। যদিও তাদের কাছ থেকে অনেক রকম পরামর্শ পেয়েছি। তবুও খরচটা কম করার জন্য কাগজপত্রের সব কাজ নিজেই একা করেছি”- বলেন সায়মা।
প্রতিটি দেশের জন্যই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণত একই নিয়ম মেনে প্রাণী পরিবহন করা যায়। যেহেতু আমাদের দেশে পোষা প্রাণী বলতে কুকুর অথবা বিড়ালের প্রচলনই বেশি, তাই এই দুটোর জন্যই প্রায় একই রকম নিয়ম প্রযোজ্য।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কানাডাতে কীভাবে আমার কুকুরকে সাথে নিয়ে এসেছি সেটা এখানে ধাপে ধাপে বর্ণনা করলাম।
খাঁচা কেনা
বিমানে নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ধরনের খাঁচা কাঁটাবন বা গুলশান ডিসিসি’র পশু পাখির দোকানেই পাবেন। বিড়ালের খাঁচার দাম কম হলেও কুকুরের বড় খাঁচার দাম অনেক বেশি।
তাই আমি চায়না থেকে অর্ডার করে শিপিং এজেন্সি দিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। কাঁটাবনে আমি কুকুরের মাপে খাঁচা পাইনি এবং ডিসিসিতে যেটা ৫০ হাজার টাকা চেয়েছে সেটা কেনার জন্য আমার প্রায় ২০ হাজার টাকা (শিপিংসহ) খরচ হয়েছে।
টিপস: মনে রাখতে হবে যে, প্রাণীর চেয়ে খাঁচাটা অবশ্যই কমপক্ষে ৪/৫ ইঞ্চি বড় মাপের হতে হবে।
টিকা ও মাইক্রোচিপ
প্রাণীটির সকল টিকার তথ্যগুলো তারিখসহ একটি কার্ডে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে এবং শরীরে মাইক্রোচিপ দেওয়া থাকতে হবে। তাছাড়া ‘ডি-ওয়ার্মিং’ করানো হলে সেইসব কাগজও সাথে রাখতে হবে।
টিপস: ঝামেলা এবং খরচের চাপ কমানোর জন্য প্রানীটির বন্ধ্যাত্বকরণ প্রক্রিয়া দেশ থেকেই করে নিয়ে যাওয়া সুবিধাজনক।
হেল্থ সার্টিফিকেট
টিকা, মাইক্রোচিপ এবং অন্য কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট থাকলে সেগুলো নিয়ে রাজধানীর কাজী আলাউদ্দিন রোডের বাংলাদেশ ‘কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতাল’য়ের মহাপরিচালকের কাছ থেকে একটি সার্টিফিকেট নিতে হবে। যা মূলত ফর্ম আকারে থাকে এবং মহাপরিচালকের ‘পিএস’ বা সহকারী সেটা পূরণ ও প্রিন্ট করে সাক্ষর সংগ্রহ করে দেন। এই একই সার্টিফিকেট বাইরের যে কোনো ভেটের কাছ থেকে নিতে গেলে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ পরতে পারে।
টিপস: এখানে সরকার নির্ধারিত কোন ফি নেই। তবে সহকারী হয়ত নাস্তা-পানি খাওয়ার খরচ চেয়ে বসতে পারেন সরকারি খরচ বলে। আপনাকে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জানতে চাইতে হবে কোথায় সেই খরচের টাকার কথা লেখা আছে!
অনাপত্তি পত্র বা এনওসি
প্রাণীর হেল্থ সার্টিফিকেট বা স্বাস্থ্য সনদ সাথে নিয়ে যেতে হবে ফার্মগেটের পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়ে। যদিও অনলাইনে আবেদনের নিয়ম রয়েছে। তবে অধিকাংশ সময় দেখা যায়, সার্ভার ডাউন। ফলে স্বশরীরে গিয়ে কাজ করাই ভালো।
লিঙ্কটা এখানে দেওয়া রইলো। যদি কেউ এর মাধ্যমে চেষ্টা করে কাজ করতে পারেন তাহলে তো খুবই ভালো আর না হলে গিয়ে দুয়েকদিন সময় দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হবে।
অনলাইন লিঙ্ক: https://dls.ussbd.net/
টিপস: চেষ্টা করবেন সকাল ১০টার দিকে যেতে। তাহলে বিকাল পাঁচটার মধ্যে কাজ সেরে চলে আসা সম্ভব হবে। না হলে তারা যতটা ‘ব্যস্ত’ থাকেন সেজন্য হয় আপনাকেই দুদিন যেতে হতে পারে।
এক্সপোর্ট সার্টিফিকেট
বাংলাদেশ থেকে যে কোনো জিনিস বাইরে পাঠানোর ক্ষেত্রে অনুমতি দেওয়ার যে বিভাগ রয়েছে সেই ‘এক্সপার্ট সার্টিফিকেট’য়ের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আমি নিজেও তাই করেছিলাম। আর অনলাইনে ফি বাবদ ১ হাজার ১শ’ ৫০ টাকা দিয়েছিলাম।
তবে এরা আমার টাকা জমার অনলাইন রিসিট নিজেদের পোর্টালে আপডেট না করে রেখে দিয়েছে, কবে আমি গিয়ে কথা বলবো সেই অপেক্ষায়। যথারীতি আমি গিয়ে শুধু কথাই বলেছি এর কয়েকদিন পর অনলাইনেই সার্টিফিকেট চলে এসেছে।
অনলাইন লিঙ্ক: https://olm.ccie.gov.bd/login
টিপস: অবশ্যই ফোন করে তাদের সাথে কথা বলবেন এবং নিজের কাজের আপডেট জেনে নেবেন। দরকার হলে সরাসরি যাবেন। না হলে কাজ পড়ে থাকবে এবং আপনিও অপেক্ষায় থেকে যাবেন।
প্রাণীর টিকিট বুকিং
আজকাল আন্তর্জাতিক সব বিমানেই পশুপাখি নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। মাস দুতিন খোঁজ খবর নিয়ে আমি প্রাধান্য দিয়েছিলাম বাংলাদেশ বিমানকে।
প্রথম কারণ ছিল দেশের আয় রোজগার আরও একটু বাড়তে দেওয়া আর দ্বিতীয় কারণ হল, আমাদের দেশের মানুষকে এই ব্যবস্থার সাথে আরেকটু অভ্যস্ত করে নেওয়া। কারণ বিমান বাংলাদেশে প্রাণীর সিট বা টিকেট বুকিং করার জন্য একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
অনলাইনে কোথাও কোনো তথ্য দেওয়া নেই। মতিঝিলের বিমান অফিসে গিয়েও এই বিষয়ে জানে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সেলস বা বিক্রয় বিভাগে ফোন করলে তারা বলে কার্গোতে ফোন করতে। এরপর অনলাইন থেকে বিমানের ‘সেলস’য়ের মহা ব্যবস্থাপকের ফোন নম্বার সংগ্রহ করে, তার সাথে কথা বলে এই কাজের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম এবং ফোন নাম্বার সংগ্রহ করলাম।
এরপর মতিঝিলের বিমান অফিসে গিয়ে ৫শ’ ডলার দিয়ে (তাদের অখুশি করে) আমার কুকুরের জন্য একটা লাগেজ চেম্বার বুক করলাম। এই পরিমাণ অর্থে ৪৩ কেজি পর্যন্ত (খাঁচাসহ) যে কোনো প্রাণী নেওয়া যায়।
টিপস: খুঁজে নেবেন সবচেয়ে কম সময়ে কোন ফ্লাইটে যাওয়ার সুযোগ আছে। আর যদি এক টানা যাওয়ার কোনো টিকিট পেয়ে থাকেন তাহলে সেটাই করে নেবেন, আপনার প্রাণীর স্বার্থে।
আইসোলেশন রিপোর্ট
পশুপাখী পরিবহনের সবচেয়ে শেষ ধাপ হচ্ছে এটা। যখন এনওসি নেবেন তখনই আপনাকে ওই অনাপত্তিপত্রে একজন সরকারি ভেটের সাথে যোগাযোগের নির্দেশনা দেওয়া থাকবে। ফ্লাইটের কয়েকদিন আগেই সেই ভেটের সাথে কথা বলে নেবেন যেন তারা সঠিক সময়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকেন। কেননা ঠিক বিমানবন্দরে গিয়ে আপনার প্রাণীকে দেখিয়ে এই রিপোর্টটা নিতে হবে। এই রিপোর্টের সরকারি খরচ হচ্ছে ৫৭৫ টাকা।
টিপস: সরকারি কর্মকর্তা যখন আপনার প্রাণীকে পরীক্ষা করবেন তখন চা খাওয়ার জন্য আরও কিছু বাড়তি তিন-চার হাজার টাকা চেয়ে বসতে পারেন। এজন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রতিটি সরকারি কাজে যাওয়ার আগে এমনকি এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় পর্যন্ত আপনার পাসপোর্ট, ভিসা এবং টিকিট (যখনই করে থাকেন, তখন থেকে) কয়েক কপি করে সাথে রাখবেন।
এর বাইরে কোথাও কোনো খরচের খাত নেই। আর আপনার কাছে কেউ দাবী করলে অবশ্যই যাচাই করে টাকা দেবেন।
সমস্যাটা হয়- হয়ত আপনার দেওয়ার সামর্থ্য আছে তাই খুশি হয়ে দিয়ে দিলেন আর যার দেওয়ার সাধ্য কম তার কাজ এরপর আর কেউ টাকা ছাড়া করে দিতে চাইবে না।
এরপরও কোনো প্রশ্ন থেকে গেলে ইনবক্সে জানাতে পারেন: https://www.facebook.com/sitrang22/
ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল প্রাণী এবং তাদের রক্ষাকারী অভিভাবকেরা।