শরবত, পরোটা, পুরি, বড়া কিংবা পায়েস- সবই করা যায় মিষ্টি কুমড়া দিয়ে।
Published : 18 Apr 2022, 10:54 AM
বিকালের নাস্তা কিংবা ইফতারে বিভিন্ন পদের ভাজা খাবার ও শরবত থাকে।। তবে কখনও কি ভেবেছেন শুধু মাত্র একটা সবজি দিয়েই তৈরি করা যাবে প্রায় সব ধরনের খাবার। আর সেগুলো যেমন হবে মজাদার তেমনি স্বাস্থ্যকর।
তার ভাষায়, “খোসা ছাড়িয়ে কাটলে উজ্জ্বল আভা ছড়ানো রংয়ের মিষ্টি কুমড়া শুধু দেখতেই মনোরম তা নয়; এই সবজি দিয়ে রান্না করা যায় হরেক রকম পদ।”
তার রেসিপিতে তৈরি করে নিতে পারেন মিষ্টি কুমড়া দিয়ে নানান খাবার।
মিষ্টি কুমড়ার প্রাণ জুড়ানো জুস
গরমে টাটকা ফলের পানীয় শরীরকে শীতল রাখে। আর সারাদিন রোজা রেখে ইফতারে এক গ্লাস মিষ্টি কুমড়ার জুস হলে নিমিষেই নিজেকে তরতাজা বোধ করবেন।
এই পুষ্টিকর ও প্রাণ জুড়ানো জুস বানানো হয়েও যায় ঝটপট।
ডুমো ডুমো বা যে কোনো মাপে টুকরা টুকরা করে কাটা মিষ্টি কুমড়া পানি দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। চাইলে সিদ্ধ করার সময় খুবই সামান্য লবণ দেওয়া যায়। সেদ্ধ করা মিষ্টি কুমড়া ঠাণ্ডা হলে জুসার মেশিনের জগে ঢেলে দিতে হবে।
এক কাপ মিষ্টি কুমড়ার টুকরা হলে দুই গ্লাস পানি দেওয়া যেতে পারে।
এরপর জুসার জগে একটা লেবুর রস দিতে হবে। এক আঙ্গুল সমান দারুচিনি টুকরা দিতে হবে। বেশ কয়েকটি পুদিনা পাতা দিতে হবে। কয়েক টুকরা বরফ জুসার জগে দিতে হবে।
সব উপকরণ দেওয়া হলে এবার জুসার মেশিন চালিয়ে দিতে হবে যেন সব উপকরণ পানির সঙ্গে গুলে মিশে যায়।
একটি গ্লাসে দু’তিনটা বরফ দিয়ে মিষ্টি কুমড়ার জুস ঢেলে নিন।
সাজানোর জন্য একটি লম্বা টুথ পিকের ওপরের দিকে ছোট ছোট গোল বা কিউব করে কাটা কাঁচা মিষ্টি কুমড়ার তিনটে টুকরা গেঁথে দিন। টুথ পিকটি গ্লাসে বসিয়ে দিন।
মিষ্টি কুমড়ার রুটি
মিষ্টি কুমড়া টুকরা করে কেটে নিয়ে সামান্য লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। এক কাপ পরিমাণ সেদ্ধ মিষ্টি কুমড়া মিহি করে চটকে নিতে হবে; হাত দিয়েও করা যায় অথবা কাটা চামচ দিয়ে চটকে নেওয়া যায়।
দুই থেকে আড়াই কাপ আটা বা ময়দার সঙ্গে এই মিষ্টি কুমড়া ভর্তা মিশিয়ে অল্প অল্প করে পানি ঢেলে খামির করতে হবে।
তারপর ছোট ছোট লেচি বেলে রুটি বানাতে হবে। তাওয়াতে রুটি সেঁকে নিতে হবে।
মিষ্টি কুমড়ার পরোটা
মিষ্টি কুমড়ার রুটি বানাতে খামির করার সময় তাতে পানি সঙ্গে একটু তেল মিশিয়ে নিতে হবে। চাইলে ঘি দেওয়া যায়। খামির কিছুক্ষণ রেখে দিয়ে আবার মেখে নিয়ে তারপর লেচি কেটে রুটি বেলতে হবে।
রুটি তাওয়াতে খুব সামান্য সেঁকে নিতে হবে। তারপর তাতে ঘি অথবা সাদা তেল দিয়ে দুই পাশ উল্টেপাল্টে ভেজে নিতে হবে। কেউ চাইলে সরিষার তেল দিয়েও পরোটা ভেজে নিতে পারেন।
মিষ্টি কুমড়ার পুরি
ময়দাতে সেদ্ধ মিষ্টি কুমড়া ভর্তা মাখিয়ে তাতে তেল বা ঘি, একটু কালোজিরা ও অল্প অল্প করে পানি ঢেলে খামির করে নিতে হবে। তারপর লুচির চেয়ে ছোট গোল রুটি বেলে নিতে হবে। চাইলে কোনো গোলাকার টিন দিয়ে রুটি কেটে কেটে নেওয়া যায়।
কেউ চাইলে একটু সেদ্ধ কুমড়া কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা আর পেঁয়াজ দিয়ে মেখে নিয়ে পুর বানাতে পারেন।
ডালপুরি বা আলুপুরির মতোই পুরি বেলে নেওয়ার সময় তাতে সামান্য মিষ্টি কুমড়ার পুর দিয়ে পুরির রুটি ভাঁজ করে আবার হালকা হাতে বেলে নিতে হবে। এরপর ভেজে নিতে হবে।
মিষ্টি কুমড়ায় ডিম
প্রথম কড়াইতে সরিষার তেলে ফোড়ন দিতে এক চা-চামচ মৌরি, জিরা, আধা ইঞ্চি আকারে দু’তিনটে দারুচিনি, আধা চা-চামচ কালোজিরা, মেথি ও চার-পাঁচটা কারিপাতা ছেড়ে নেড়ে দিন।
সুন্দর গন্ধ ছড়ালে তাতে আধা কাপ পেঁয়াজ কাটা দিতে হবে।
পেঁয়াজ নরম হয়ে আসা পর্যন্ত নাড়তে হবে। এরপর দুই টেবিল-চামচ আদা-রসুন বাটা দিয়ে নাড়তে হবে। এসময় সামান্য লবণ দিতে হবে।
বাটা মসলা একটু নেড়ে নিয়ে তাতে এক চা-চামচ করে হলুদ, জিরা, ধনে গুঁড়া দিতে হবে। মসলা যেন পুড়ে না যায় তাই সামান্য করে পানি একটু পর পর ছিটিয়ে দিয়ে ভুনা করতে হবে।
মসলা ভুনা হলে টুকরা করে কাটা কুমড়া ছেড়ে দিয়ে নাড়তে হবে। তারপর পানি দিতে হবে। কুমড়া সেদ্ধ হতে মাঝে মাঝে ঢেকে দিতে হবে। লবণ দিতে হবে স্বাদ মতো।
কুমড়া সেদ্ধ হয়ে এলে তাতে একটা একটা করে ৪টি ডিম ভেঙে দিতে হবে। চাইলে সেদ্ধ ডিম একটু ভেজে নিয়ে পরে কুমড়ার ভুনাতে মিশিয়ে দেওয়া যায়। অথবা ডিম ভেঙে গুলে নিয়ে সেটা লবণ-হলুদ দিয়ে ভাজার সময় চামচ দিয়ে নেড়ে নিতে হবে যেন ঝুরি ঝুরি হয়ে যায়; মানে ‘স্ক্রামবলড এগ’ যাকে বলে।
এই ঝুরি ডিম ভাজিও মিশিয়ে দেওয়া যায় কুমড়া ভুনাতে।
নামানোর আগে কাঁচা মরিচ ভেঙে দিতে হবে; এতে সুবাস ভালো হয়। ধনে পাতা ও সরিষার তেল একটু ছড়িয়ে দিতে হবে চুলার আঁচ বন্ধ করার ঠিক কিছুক্ষণ আগে।
মিষ্টি কুমড়ার ঝাল ঝাল ভর্তা
মিষ্টি কুমড়া চৌকো করে বা একটু পাতলা করে কেটে নিয়ে তাওয়াতে সেঁকে নিতে হবে, যেন সামান্য পোড়া পোড়া হয়। একই ভাবে গোটা রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও শুকনা মরিচও পোড়া পোড়া করে ভেজে নিতে হবে।
এভাবে সেঁকে নেওয়ার সময় সামান্য করে সরিষার তেলও দেওয়া যায়।
এরপর সব উপকরণ হামান দিস্তায় পিষে নিতে হবে। এই ভর্তা পাটায় বাটলে বেশি মিহি হয়ে যাবে, একটু এবড়োথেবড়ো হলে সেটা দেখতে ভালো হয়। ভর্তায় লবণ ও সরিষার তেল মাখিয়ে পরিবেশন করতে হবে।
মিষ্টি কুমড়ার বেগুনি
একে কুমড়ানি অথবা মেগুনি এমন অনেক নাম দেওয়ার চেষ্টা হলেও বেগুনি নামটিই সবকিছু ছাপিয়ে টিকে রয়েছে; তাতে বেগুনিতে বেগুন থাকুক বা কুমড়া!
বেগুন যেভাবে লম্বা ও পাতলা করে কেটে নেওয়া হয়, কুমড়াও একই রকম করে কেটে নিতে হবে। যদি সামান্য মোটা লাগে কাটার পর, তাহলে একটি টুথপিক দিয়ে কুমড়ার একেকটি ফালিতে ছিদ্র ছিদ্র করে দিতে হবে।
আসলে বেসনের গোলা বানানোর ওপরেই বেগুনির স্বাদ বাড়ে।
গোলা বানাতে বেসনে কিছুটা চালের গুঁড়া মেশাতে হবে; এক কাপ বেসন হলে আধা কাপেরও কম চালের গুঁড়া লাগে।
এরপর তাতে আধা চা-চামচ বেইকিং সোডা বা খাওয়ার সোডা মেশাতে হবে।
এরপর এক চা-চামচ করে কালোজিরা, ধনে গুঁড়া, জিরা গুঁড়া, লাল মরিচের গুঁড়া (কেউ চাইলে কাঁচা-মরিচ বেটে খুব সামান্য পরিমাণে দিতে পারেন; বেশি দিলে ঝাল হয়ে যাবে), লবণ, হলুদ গুঁড়া মেশাতে হবে।
একবারে পানি না দিয়ে একটু একটু করে পানি মেশাতে হবে গোলা বানাতে। ঘন গোলা হবে যেন কুমড়ার গায়ে বেসন মেখে থাকে ঠিক মতো।
কুমড়া বেসনের গোলাতে ডুবিয়ে তারপর ডুবো তেলে ভেজে নিতে হবে। ভাজার সময় চুলার আঁচ মাঝারি রাখতে হবে। এতে বেগুনির বাইরের দিক চট করে পুড়ে যাবে না এবং ভেতরেও ঠিক মতো ভাজা যাবে।
মিষ্টি কুমড়ার কুড়মুড়ে পেঁয়াজু
ডালের পেঁয়াজুর উপকরণে একটু কুমড়া কুচি যোগ করেই বানিয়ে ফেলা যায় মিষ্টি কুমড়ার কুড়মুড়ে পেঁয়াজু।
মুসুরের ডাল ভিজিয়ে রেখে বেটে নিতে হবে; এক কাপ পরিমাণ। এতে আধা কাপ বা সামান্য বেশি ঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ মেশাতে হবে। আরও দিতে হবে এক চামচ করে হলুদ গুঁড়া, লবণ, লাল মরিচ গুঁড়া, ধনে গুঁড়া, জিরা গুঁড়া। তারপর ধনে পাতা অথবা পুদিনা পাতা এবং তিন-চারটি কাঁচামরিচ কুচি করে।
কুমড়া গ্রেটারে ঝুরি করে নিতে হবে। কুমড়ায় পানি বের হলে তা চেপে ঝরিয়ে নিয়ে আধা কাপের একটু বেশি কুমড়া ঝুরি বাটা ডালে মেশাতে হবে। সব ভালো করে মেখে নিতে হবে।
কুমড়া-ডাল মাখা একটু একটু করে এবড়োথেবড়ো ভাবে তুলে তেলে ছেড়ে ভেজে নিতে হবে।
মিষ্টি কুমড়ার মোলায়েম পায়েস
এক লিটার দুধ জ্বাল দেওয়ার সময় তাতে আধা ইঞ্চি আকারের চার টুকরা দারুচিনি ও ১০-১২টি এলাচ ছেড়ে দিতে হবে। এলাচ সামান্য বেশি দিলে স্বাদও বেশি হবে।
দুধ যেন একটু দ্রুত হালকা ঘন হয়ে আসে তাই ৪ থেকে ৫ টেবিল-চামচ গুঁড়া দুধ মিশিয়ে দিতে হবে। দুধ মাঝারি আঁচে ক্রমাগত নাড়তে হবে।
এরপর তাতে আগে থেকে ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখা পোলাও অথবা সুগন্ধি চাল ছেড়ে দিতে হবে; এক কাপ পরিমাণ। চাল আধা সেদ্ধ হয়ে এলে এই মিশ্রণে গ্রেটারে কুড়ানো মিষ্টি কুমড়া এক কাপ পরিমাণ দিতে হবে।
এরপর তাতে চিনি মেশাতে হবে। চিনি এড়াতে চাইলে আখের গুঁড় মেশানো যায়; তবে খেজুরের গুড় দিলে পায়েসের স্বাদ যে তুলনাহীন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ চাইলে মধু অথবা বিকল্প চিনি দিয়েও এই পায়েস রান্না করতে পারেন।
এবারও মিশ্রণটি টানা নাড়তে হবে।
চাল ও মিষ্টি কুমড়া সেদ্ধ হয়ে এলে ও মিষ্টি স্বাদ ঠিক থাকলে এতে কয়েকটি কিশমিশ ও কিছু কাজু বাদাম কেটে মিশিয়ে দিতে হবে।
এরপর চুলার আঁচ বন্ধ করে দুয়েক ফোঁটা গোলাপ জল মেশাতে হবে। তারপর পরিবেশনের পাত্রে পায়েস ঢেলে নিয়ে উপরে কিশমিশ ও কাজু বাদাম দিয়ে সাজিয়ে দিতে হবে।
গরম ভাব কমে এলে পায়েসের বাটি ফ্রিজে রেখে দিন। এই গরমের দিনে মিষ্টি কুমড়ার পায়েস ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা খেতে খুব ভালো লাগবে।
আরও একটু
মিষ্টি কুমড়া দিয়ে এর বাইরেও হালুয়া, লাড্ডু, লাচ্ছি, পুডিং, মোরব্বা বানানো হয়। আর তরকারিতে তো মিষ্টি কুমড়া দিয়ে চিংড়ি ভুনা অনেকেই করেন।
রুই বা কাতল মাছের মাথা দিয়ে মিষ্টি কুমড়া ভুনা ভাতের সঙ্গে জমে ওঠে।
পু্ষ্টিকর মিষ্টি কুমড়া দিয়ে মজাদার সব রেসিপি নাস্তা থেকে দুপুর কিংবা রাতের টেবিল সাজানো তো যায়–ই; বিকেল ও সন্ধের সময়টাও চা-কফির সঙ্গে মুচমুচে করে তোলা যায়।