দশ কিলোমিটার ম্যারাথনে অংশ নিচ্ছেন কি শুধু মাত্র লোক দেখাতে? নাকি দেহ-মনের উন্নতিতে!
Published : 08 Apr 2025, 04:00 PM
ফোন ‘স্ক্রলিং’ করতে করতে হঠাৎ হয়ত চোখে পড়ল নতুন কোনো ‘ভাইরাল ট্রেন্ড’। কোনো এক ইনফ্লুয়েন্সার হয়ত দাবি করছেন যে, তার দেওয়া কঠোর ডায়েট অনুসরণ করলে চমকপ্রদ শারীরিক গঠন অর্জন করা সম্ভব।
অথবা দেখতে পেলেন একজন দৌড়বিদ বলছেন, কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই একটি ম্যারাথনে দৌড়াতে পারবেন ঠিক যেমনটা তারা করেছেন।
সক্রিয়ভাবে খুঁজে স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ না পেলেও, এ ধরনের ট্রেন্ডের হদিস পাওয়া কিন্তু দিন দিন আরও সহজ হয়ে উঠছে। তবে, এসব দাবির পেছনে কী কোনো সত্যি রয়েছে?
আর এসব নিয়ে ভাবলে প্রশ্ন আসতে পারে কেন মানুষ প্রায়শই এত তীব্র চ্যালেঞ্জের দিকে ঝুঁকে পড়ে? অথচ যথেষ্ট ঘুমানো বা আরও বেশি শাকসবজি খাওয়ার মতো অতি সহজ অভ্যাসও তাদের কাছে কঠিন বলে মনে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, “এখন অনেকেই প্রতিদিনের জীবনে কঠিন সব চ্যালেঞ্জে ঝাঁপিয়ে পড়েন কারণ মানুষ চরম পরিবর্তন চায়। যা হয়ত নিজেদের বা অন্যদের কাছে কিছু প্রমাণ করতে সাহায্য করবে।”
‘লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স’ এবং ‘পলিটিক্যাল সায়েন্স’য়ের মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক এবং পারফেকশনিজমের বিশেষজ্ঞ ডা. থমাস কারান বলেন, “সবসময় কঠোর ধরনের চ্যালেঞ্জগুলোকে আমরা নিজের বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে দেখি, বিশেষত যদি এমন একটি পর্যায়ে থাকি যেখানে নিজেদেরকে নিজেরাই অবহেলা করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের চিন্তা অতি সুস্থ থাকার তাগিদ অথবা সম্পর্ক ভাঙা বা জীবনযাত্রার বড় কোনো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে- এমন সময়ে বেশি আসে।”
‘পারফেকশনিজম’-এর ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা
পারফেকশনিজম এমন একটি মানসিকতা বা আচরণগত প্রবণতা, যেখানে একজন ব্যক্তি নিজের প্রতি অত্যন্ত উচ্চ বা নিখুঁত মানদণ্ড স্থাপন করে এবং সেগুলোর পূর্ণতা অর্জনে অত্যধিক চাপ অনুভব করে।
‘পারফেকশনিস্ট’ ব্যক্তি প্রায়ই মনে করেন যে- তারা যা কিছু করেন, তা সর্বোচ্চ মানের হতে হবে এবং তারা সর্বদা নিজের কাজের প্রতি নিখুঁত ফলাফল আশা করেন।
আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, এমন ‘পারফেকশনিজম’ বেশ জনপ্রিয় বিষয়। যেখানে সবাই নিজেদের শারীরিক এবং মানসিক শক্তির সেরা রূপটি প্রদর্শন করতে চায়।
সেখানে ফিটনেস বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোনো ইন্সটাগ্রামের পোস্টের মাধ্যমে সহজেই এই ধরনের তুলনা করা সম্ভব।
তবে, অন্যদের অর্জনগুলো দেখা প্রেরণাদায়ক হতে পারে, আবার যদি নিজের উন্নতি তাদের সঙ্গে না মেলে, তবে তা নিরাশাজনকও হতে পারে।
“যেহেতু প্রতিটি মানুষ নিজের আদর্শ বা ‘পারফেক্ট’ সংস্করণটি অর্জনের চেষ্টা করে, সেটা হতে পারে শারীরিক বা জীবনধারা সম্পর্কিত এবং অনেক সময়ে যা অসম্ভব বা ক্ষতিকরও হয়” বলেন কারান।
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের তুলনা একটি বিপজ্জনক চক্র তৈরি করে, যেখানে মানুষ সবসময় নিজের অগ্রগতির সঙ্গে অসন্তুষ্ট বোধ করেন।”
‘পারফেকশনিজম’য়ের এই সমস্যা নারীদের জন্য আরও ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষ করে যারা প্রায়শই অসম্ভব সৌন্দর্যমানদণ্ড এবং সামাজিক প্রত্যাশার সম্মুখীন হন।
ট্রেন্ডসের প্রতি সতর্কতা এবং গবেষণা
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পুষ্টিবিদ এবং ‘অ্যাথলেট পারফরম্যান্স’ বিশেষজ্ঞ রেনি ম্যাকগ্রেগর পরামর্শ দেন যে, “মানুষদের উচিত এসব নতুন ট্রেন্ড বিষয়ে তাদের আগ্রহ এবং সন্দেহ দুইটি নিয়েই চিন্তা করা। কারণ কিছু ইনফ্লুয়েন্সার বা সেলিব্রিটি এমন প্রোডাক্টও প্রোমোট করতে পারে, যেগুলো তারা শুধুমাত্র আর্থিক লাভের জন্য বিক্রি করতে চায়।”
ম্যাকগ্রেগর বলেন, “যে ব্যক্তির থেকে আপনি পরামর্শ নিচ্ছেন, এতে সেই ব্যক্তির কী লাভ হবে? এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে। যদি তারা আর্থিক লাভ পায়, তবে হয়ত তারা একটি ‘মিথ’ বা কল্পকাহিনীও বিক্রি করতে পারেন।”
তাই যদি নতুন কোনো ট্রেন্ড বা চ্যালেঞ্জ চেষ্টা করতে চান, তবে প্রথমেই গবেষণা করতে হবে এবং সে বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত চিকিৎসকদেরদের পরামর্শ নেওয়াই যথাযথ।
মাইন্ডফুল ওয়েলনেস চ্যালেঞ্জ
নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে নিজেকে পরীক্ষা করতে ভালোবাসার মানে এই নয় যে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সব ধরনের চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করতে হবে। বরং এর আগে নিজের লক্ষ্য স্পষ্ট করা এবং উদ্দেশ্য সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
ম্যাকগ্রেগর বলেন, “কিছু মানুষ এসব চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ করে কারণ তারা মনে করেন অনেক কিছুই তাদের জীবনে অনুপস্থিত এবং তারা এর মাধ্যমে নিজেদের মূল্য অথবা অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা পেতে চান।”
বরং নিজেকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার জন্য একটি ভালো উপায় হল, চ্যালেঞ্জটি কি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারে আসবে, নাকি এটি শুধুমাত্র সামাজিক মিডিয়ায় আপনার অর্জন প্রদর্শন করবে?- এভাবে চিন্তা করা।
টেকসই অভ্যাসের দিকে মনোযোগ দিন
অনেক প্রফুল্ল মনে হলেও সামাজিক মাধ্যমে দেখা সব চ্যালেঞ্জ দীর্ঘ সময়ের জন্য উপকারী নয়।
ম্যাকগ্রেগর এবং কারান দুজনেই পরামর্শ দেন যে, “এমন চ্যালেঞ্জ না নিয়ে বরং টেকসই স্বাস্থ্যগত অভ্যাস গড়ে তুলতে মনোযোগী হতে হবে।”
যতটা সম্ভব, ‘স্বাস্থ্যবান’ হওয়ার ধারণা না ধারণ করে আসল স্বাস্থ্যকর আচরণগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া এবং সেগুলো ছোট ছোট ভাবে শুরু করাই উপকারী।
যদি কোনো ব্যক্তিকে দিনের বেশির ভাগ সময় বসে বসে কাজ করতে হয় তবে শরীরে গতিবিধি আনতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাবারটি খাওয়া যায়।
এছাড়াও দৈনন্দিন রুটিনে ছোট ছোট হাঁটা চলা অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করা যায়।
ম্যাকগ্রেগর আরও কিছু ছোট ছোট পরিবর্তন সুপারিশ করেছেন। যেমন- প্রতিদিন শাকসবজি খাওয়া ও শস্যজাত খাবার ব্যবহার করা। বিশেষ করে যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা হয় এবং আধুনিক অতি প্রক্রিয়াজাত শস্যের তুলনায় স্বাস্থ্যকর।
সব শস্য সাধারণত অতিরিক্ত রাসায়নিক বা সিংহভাগ প্রক্রিয়াজাত না হওয়া খাবার হতে পারে। আবার হতে পারে প্রতিদিন এক মুঠো বাদাম খাওয়া।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে কোনো কিছুই নিজের কাছে আনন্দদায়ক হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে কোনো একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বা শরীরের আকারে মনোযোগ দেওয়া যাবে না।
ম্যাকগ্রেগর বলেন, “মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব এবং মনে রাখতে হবে যে তুলনা কখনই উপকারে আসবে না। সেটা না করাই উচিৎ।”
আরও পড়ুন
সহজে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস রপ্ত করতে