এক মানুষের নানান রূপ

শৈশব থেকেই গড়ে উঠতে পারে একাধিক সত্তা। অত্যাচার বা কোনো দুর্ঘটনা থেকে এরকম মানসিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

লাইফস্টাইল ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2022, 05:38 AM
Updated : 18 Oct 2022, 05:38 AM

মানসিকভাবে নানান চরিত্রের রূপ ধারণ করার কেতাবি নাম ‘ডিসোশিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার’।

শব্দটির অর্থ সর্ব সাধারনের কাছে অচেনা। তবে দেশ বিদেশের অসংখ্য নাটক সিনেমার বদৌলতে ‘মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার’য়ের সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত।

মানসিক অবস্থাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শৈশবে এই মানসিক স্থিতি তৈরি হয়, একই ব্যক্তির একক মানসিক সত্তা ভেঙে একাধিক মানসিক সত্তায় পরিণত হয়।

বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ওই ব্যক্তি এক মানসিক সত্তা থেকে আরেকটিতে পুরোপুরি বদলে যায়। বিশেষজ্ঞাদের দাবি বিশ্ব জনগোষ্ঠীর ১.৫ শতাংশ এই রোগে আক্রান্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড মেডিকাল সেন্টার’য়ের মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রিচার্ড লোয়েনস্টিন ‘দ্য ইনসাইডার ডটকম’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ডিসোশিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার’ বা ‘ডিআইডি’তে আক্রান্ত মানুষগুলোর সমস্যা শৈশব থেকেই দেখা দেয় ঠিক কিন্তু তখন রোগ শনাক্ত হয় না বললেই চলে।”

রোগ শনাক্ত না হওয়ার কারণে তাদের মানসিক সমস্যার চিকিৎসার জন্য গড়ে প্রায় সাত বছর এই মানুষগুলোকে মানসিক হাসপাতালে থাকতে হয়।

তিনি আরও বলেন, “১৯৮১ সাল থেকে এই ধরনের রোগী দেখছি। এই রোগে আক্রান্তদের গড়ে প্রায় চার বার ভুল রোগ শনাক্ত হয়, তারপর গিয়ে তাদের প্রকৃত রোগ ‘ডিআইডি’ ধরা পড়ে। এদের নিজের ক্ষতি করার এবং আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে প্রকট আকারে, যে কারণে কদিন পরপরই মানসিক হাসপাতালে আনা হয়।”

ডা. লোয়েনস্টিন ব্যাখ্যা করেন, “মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এই রোগ শনাক্ত করেন রোগীর সঙ্গে একাধিক গভীর আলোচনার পর। সেই আলোচনায় প্রধানত তাদের ‘অ্যামনিশা’ বা স্মৃতিভ্রংশের মাত্রা ও আত্মহত্যার ধারণাগুলোর তীব্রতা গণনায় ধরা হয়। কিন্তু প্রাপ্তবয়ষ্ক আর শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগের উপসর্গগুলো ভিন্ন।”

‘ডিআইডি’র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এই রোগ শনাক্ত করার কোনো নির্দিষ্ট বয়স ঠিক করেননি। তবে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক ও রোগীর বাবা-মা খুব অল্প বয়স থেকে এই রোগের উপসর্গ দেখছেন।

ফলে ছয় বছর বয়সেই ‘ডিআইডি’র ‘ডায়াগনোসিস’ দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

রোগের ঝুঁকি ও উপসর্গ

শৈশবে শিশুদের মনগড়া বন্ধু থাকাটা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্ত ‘ডিআইডি’তে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে সেই মনগড়া বন্ধু, শিশুর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তাদের ক্ষেত্রে সেই মনগড়া সত্তা শুধু বন্ধু নয়, তার সবসময়ের সঙ্গী।

আর একসময় মনগড়া সেই সঙ্গী তার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। শিশুর মনের মধ্যে সতন্ত্র একটি কণ্ঠ হিসেবে প্রকাশ পায় এই সঙ্গী, যেন তার মনের মধ্যে বসে থাকা আরেকটি সত্তা। আর তা এমন কিছু ধারণা তৈরি করে যা মুল সত্তার চিন্তাধারার বিপরীত।

ডা. লোয়েনস্টিন জানান, শিশুর মাঝে একাধিক মানসিক সত্তা জেগে উঠলেও তা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ন্যায় ভিন্ন মানসিক সত্তার মতো শক্তিশালী হয় না।

প্রাপ্তবয়স্কদের একাধিক মানসিক সত্তা প্রায়শই পরস্পরের বিপরীতধর্মী হয়। যেমন- একটি মানসিক সত্তা পুরুষ, আরেকটি নারী, একটি সহকামী, আরেকটি সেটিকে ঘৃণা করে।

কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে ভিন্ন মানসিক সত্তাগুলো তখনই গড়ে উঠছে, শুধু পরিণত হয়ে ওঠেনি।

শৈশবে অনবরত অত্যাচারের শিকার হওয়া থেকেই জন্ম নেয় ভিন্ন সত্তা

ডা, লোয়েনস্টিন বলেন, “শৈশবে অত্যাচার কিংবা ভয়ানক কোনো দুর্ঘটনার শিকার হওয়া সব শিশুর মাঝে এমন ভিন্ন সত্তা সৃষ্টি হবে ব্যাপারটা তেমন নয়। তবে একটি শিশু যদি ক্রমাগত অত্যাচারের শিকার হতে থাকে, নিঃসঙ্গতা ও নিরাপত্তাহীনতা ভোগে তবে সেই অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ভিন্ন সত্তা তার মাঝে তৈরি হয়। আর সেটাই পরিণত বয়স পর্যন্ত তার সঙ্গে থেকে যেতে পারে।”

অত্যাচার বা নিঃসঙ্গতার অনুভূতি বাবা-মা বাদে বাহ্যিক কোনো পরিবেশ থেকেও সৃষ্টি হতে পারে। এদের ক্ষেত্রে সমস্যা তখনই বেড়ে যায় যখন বাবা-মা কিংবা পরিবারের কাছেও তারা সহমর্মীতা পায় না।

“একাধিক ঘটনা আছে যেখানে শিশু, ওইটুকু বয়সে একাধিক অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে গেছে এবং তারপর তাকে সেরে ওঠার জন্য হাসপাতালে একা ফেলে রাখা হয়েছে। আবার অনবরত শারীরিক ও যৌন অত্যাচারের শিকার হওয়া শিশুদের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে। এই পরিস্থিতিগুলো শিশুর নিজের মস্তিষ্কের মাঝে লুকিয়ে ভিন্ন সত্তার মাঝে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর যেন কিছু করার থাকে না,” বলেন এই মনোবিজ্ঞানি।

বাবা-মায়েরও একই রোগ থাকা

১৯৮৭ সালে ‘ডিআইডি’ আছে এমন মায়েদের নিয়ে গবেষণা করা হয়। এতে দেখা যায়, তিনভাগের একভাগ মা ছিলেন অনেক অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণকারী, ১৬ শতাংশ মা খুব বাজেভাবে, নোংরাভাবে তার সন্তানদের ওপর অত্যাচার করতেন।

আর এর বাইরে সবাই মা হিসেবে ছিলেন অক্ষম। ‘ডিআইডি’তে আক্রান্ত বাবাদের নিয়ে কোনো গবেষণা নেই।

ডা. লোয়েনস্টিন বলেন, “আমার অভিজ্ঞতায় এই রোগে আক্রান্ত বাবা-মা নিজেদের অজান্তেই তাদের সন্তানের মানসিক স্থিতি তাদের মতোই করে ফেলেন। সন্তান আশপাশে থাকা অবস্থায় বাবা কিংবা মায়ের ভিন্ন মানসিক সত্তা যদি জেগে ওঠে তখন সেই সত্তা ওই শিশুকে সন্তান ভাবে না, বিপদ মনে করে। এক্ষেত্রে এই বাবা-মাকে সন্তান থেকে দূরে রাখাই হবে নিরাপদ।”

তিনি আরও বলেন, “চিকিৎসা করতে গিয়ে দেখেছি, মা তা স্কুল পড়ুয়া সন্তানকে নিয়ে এসেছেন। সন্তান যদি এমন কিছু করে যা মাকে রাগিয়ে দেয়, তখন মা বদলে যান প্রচণ্ড রাগি সত্তায়, আর তার প্রেক্ষিতে সন্তান বদলে যায় ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া একটি সত্তায়।”

“এই পরিস্থিতিতে দ্রুত তৃতীয় পক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হয় অত্যাচার ঠেকানো জন্য। অন্যথায় দেখেছি সন্তানের ওপর প্রচণ্ড প্রহারের পর তারা দুজনই যখন আবার তাদের মূল সত্তায় ফিরে আসেন তখন দুজনের কেউই মনে করতে পারেন না যে কী হয়েছিল তাদের মধ্যে।”

আর এই লক্ষণ ‘ডিআইডি’তে ভোগার ইঙ্গিত দেয় বলে মন্তব্য করেন ডা. লোয়েনস্টিন।

আরও পড়ুন