প্রচণ্ডতা ও স্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করবে সমস্যা কতটা গুরুত্বর।
Published : 09 Jul 2024, 12:18 PM
সারাদিনের কাজের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে মাথাব্যথা।
সাথে যদি শুরু হয় হৃদপিণ্ডের ধুকধুকানি তাহলে বড় কোনো অসুখ হওয়ার দুশ্চিন্তাও কাজ করে।
“মাথাব্যথার সাথে বুক ধড়ফড় করার নানান কারণ থাকতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা গুরুত্বর নয়”- ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন ক্যালিফোর্নিয়া’র সান্টা মোনিকা’তে অবস্থিত ‘প্রভিডেন্স সেইন্ট জন’স হেল্থ সেন্টার’য়ের চিকিৎসক ডেভিড কাটলার।
এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কারণগুলো জানা থাকা প্রয়োজন।
মানসিক চাপ বা উৎকণ্ঠা
‘টেনশন’ বা স্নায়ুবিক চাপের বিষয়টা অনেক সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়।
তবে ডা. কাটলার বলছেন, “মানসিক চাপ থেকেও মাথাব্যথা হয় যাকে বলে ‘টেনশন হেডেকস’। পাশাপাশি উৎকণ্ঠার কারণে শুরু হয় বুক ধড়ফড় করা বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন।”
মার্কিন সংস্থা মায়ো ক্লিনিক জানাচ্ছে, উদ্বিগ্ন থাকার কারণে আরও কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন-
উৎকণ্ঠায় থাকার আরেকটি লক্ষণ হল অন্যদিকে মনোযোগ না থাকালে বা রাতে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি।
যা করা উচিত: ইয়োগা, ধ্যান বা ডায়রি লেখার মতো অভ্যাসগুলো মন শান্ত হতে সাহায্য করে। এগুলো দৈনিক অভ্যাসে পরিণত করার চেষ্টা করতে হবে। মানসিক চাপ কমালে দ্রুত হওয়া হৃদস্পন্দনও কমে আসবে।
পাশাপাশি মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শে বা কথা বলার মাধ্যমে থেরাপি নিয়ে, সাথে প্রয়োজন হলে ‘অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি’ ওষুধ সেবনের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করতে হবে।
পানিশূন্যতা
দেহে পর্যাপ্ত পানির অভাব হলে শুধু মাথাব্যথাই নয় সাথে হৃদস্পন্দনও বেড়ে যেতে পারে।
পানিশূন্যতার কারণে অবসাদ, মুখ শুকানো বা প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়ে যায়।
যা করা উচিত: স্বল্প মাত্রার পানিশূন্যতা সহজেই পূরণ করা যায়।
এই বিষয়ে নিউ ইয়র্ক’য়ের ‘ইন্টেগ্রেটিভ হেডেক মেডিসিনি’য়ের প্রতিষ্ঠাতা ডা. লরা ন্যাটবনি বলেন, “পানি বা ইলেক্ট্রোলাইট যুক্ত পানীয় পান করাতে হবে যতক্ষণ না দেহে পানির ঘাটতি পূরণ হয়।”
এছাড়া গরম আবহাওয়াতে থাকলে বা ঘাম হলে নিজেকে ঠাণ্ডা করার জন্য ছায়ার মধ্যে থাকতে হবে। ঠাণ্ডা ভেজা কাপড় দিয়ে গলা, ঘাড়, মাথা মুছে নিলে আরাম মিলবে- পরামর্শ দেন তিনি।
তবে মারাত্মক পানিশূন্যতা থেকে দ্বিধা, জ্ঞান হারানো বা দ্রুত নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
অতিরিক্ত ক্যাফিন গ্রহণ
অতিরিক্ত মাত্রায় কফি, চা বা এনার্জি ড্রিংকস পান করলে মাথাব্যথার সাথে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। ফলে দুর্বলতা বোধ ও স্নায়ুবিক চাপ তৈরি হয়। কারণ এসব পানীয়তে ক্যাফিন থাকে।
ডা. ন্যাটবনি বলেন, “উদ্দিপনা তৈরি করে ক্যাফিন, যা কেন্দ্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলে। কারও কারও ক্ষেত্রে ক্যাফিনের কারণে মস্তিষ্কের ধমনী চেপে আসে, ফলে দেখা দেয় মাথাব্যথা।”
এছাড়া অতিরিক্ত ক্যাফিন গ্রহণ থেকে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। যা থেকে বুক ধড়ফড় অনুভূত হয়।
যা করা উচিত: যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন’য়ের তথ্যানুসারে, শরীর থেকে ক্যাফিন বের হয়ে গেলে ভালো বোধ হতে শুরু করে। এজন্য কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।
এই সময়ের মধ্যে আরও পানি পান করলে পানিশূন্যতায় ভোগার মাত্রা কমানো যায়। কারণ ক্যাফিন দেহ শুষ্ক করে দেয়।
আর ক্যাফিন থেকেই যদি মাথাব্যথা ও বুক ধড়ফড়-ভাব হয় তবে চা কফি পানের পরিমাণ কমাতে হবে।
যুক্তিরাষ্ট্রের ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেইশন’ জানাচ্ছে- বেশিরভাগ মানুষ দৈনিক ৪শ’ মি.লি. গ্রাম পর্যন্ত ক্যাফিন সহ্য করতে পারে। যা কিনা ৩২ আউন্স কফির সমপরিমাণ।
সংক্রমণ থেকে
‘ফ্লু’ বা জ্বর বা ঠাণ্ডা লাগার কারণে মাথাব্যথা ও হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।
ডা. কাটলার বলেন, “যে কোনো অসুস্থতার কারণে জ্বর আসলে মাথাব্যথা হতে পারে। সাথে পানিশূন্যতা হলে দেখা দেয় বুক ধড়ফড়-ভাব।
মার্কিন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক’য়ের তথ্যানুসারে- দেহের ভেতরের তাপমাত্রা বাড়লে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায়।
যা করা উচিত: প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণের মাধ্যমে দেহ আর্দ্র রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে জ্বর ও মাথাব্যথা কমানোর ওষুধ সেবন করতে হবে।
কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
‘ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়া’ জানাচ্ছে- নাক বন্ধ, ঠাণ্ডা-কাশির ওষুধ বা সিরাপ গ্রহণ থেকে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেতে পারে।
যদিও এই ধরনের ওষুধ মাথাব্যথা তৈরি করে না। তারপরও মাথার যন্ত্রণা হতে পারে ঠাণ্ডা লাগার অসুস্থতা থেকে।
যা করা উচিত: যদি স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ হন আর কোনো হৃদঘটিত সমস্যা না থাকে তবে এই ধরনের ওষুধ গ্রহণ বাদ দিলে সমস্যা কেটে যাবে।
তবে বুক ধড়ফড়-ভাব ৩০ মিনিটের বেশি থাকলে সাথে নিঃশ্বাসে সমস্যা ও মাথা হালকা লাগার অনুভূতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ঘুম ভালো না হওয়া
কম ঘুম হলে মাথাব্যথা হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। ‘ইউনিভার্সিটি অফ আইওয়া’ জানাচ্ছে- অল্প ঘুম মানসিক চাপ বাড়ায় যা থেকে বুক ধড়ফড় করা ও মাথাব্যথা দেখা দিতে পারে।
তাছাড়া হৃদস্বাস্থ্য ভালো রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি। ‘জন্স হপকিন্স মেডিসিন’য়ের তথ্যানুসারে- অপর্যাপ্ত ঘুম ‘হার্ট অ্যাটাক’ ও স্ট্রোক’য়ের মতো মরণঘাতি রোগের কারণ হয়।
যা করা উচিত: ব্যথা-নাশক ওষুধ সাময়িক আরাম দেয়। তবে সার্বিকভাবে সুস্থ হতে অবশ্যই সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার পরামর্শ অনুসারে পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য যা করা যেতে পারে-
অন্য কোনো সমস্যা
ডা. কাটলার বলেন, “মাথাব্যথার সাথে বুক ধড়ফড় করা অনেক সময় গুরুত্বর অসুস্থতার লক্ষণ হতে পারে। যেমন- থাইরয়েডের সমস্যা বা রক্তশূন্যতা।”
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক জানাচ্ছে- ‘পস্টুরাল অর্থস্ট্যাটিক ট্যাকিকার্ডিয়া সিন্ড্রম (পিওটিএস)’য়ের কারণে মাথাব্যথার সাথে বুক ধড়ফড় অনুভূত হয়। এই অবস্থার কারণে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসতে বা শুতে গেলে দ্রুত রক্তচাপের পরিবর্তন ঘটে।
আরেকটি দুর্লভ রোগ ‘কার্ডিয়াক হেডেক’ থেকেও এই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ‘কার্ডিয়াক সেফালালজিয়া’ নামে পরিচিত এই অসুস্থতা হার্ট অ্যাটাকের সময় দেখা দেয়। এরফলে মাথার এক বা দুদিকেই সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হয়, যা কিনা অনেকটা ‘মাথা ফেটে যাচ্ছে’ বা মাথার ভেতর বজ্রপাতের অনুভূতি দেয়।
যা করা উচিত: যদি প্রায়ই মাথাব্যথার সাথে বুক ধড়ফড় দেখা দেয় তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তারা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারবেন, দেহে কোনো মারাত্মক অসুস্থতা চলছে কিনা।
‘জন্স হপকিন্স মেডিসিন’য়ের তথ্যানুসারে এই ধরনের সমস্যার চিকিৎসার পদ্ধতি ভিন্ন। যেমন- পিওটিএস’য়ের চিকিৎসায় সারাদিন ধরে তরল গ্রহণের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসে আরও লবণ যোগ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
খাওয়ার পর মাথাব্যথা ও বুক ধড়ফড় করার কারণ
ডা. ন্যাটবনি বলেন, “অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে দেহে চাপ পড়ে। যা রক্তচাপ বাড়ায়। ফলে একই সাথে মাথাব্যথা ও বুক ধড়ফড় করতে পারে।”
কারও কারও ক্ষেত্রে ঝাল ও মিষ্টি খাবার থেকে এরকম হতে পারে। এছাড়া ফাস্ট ফুড’য়ে ব্যবহার করা স্বাদবর্ধক উপাদান ‘এমএসজি’ এবং পনির ও প্রক্রিয়াজাত মাংস যেমন- সসেজে থাকা এক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড ‘টাইরামিন’য়ের প্রভাবেও মাথাব্যথার সাথে হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেতে পারে।
মাথাব্যথা ও বুক ধড়ফড় করা রোধ করতে
অসুস্থতার কারণ ছাড়া সাধারণ কিছু বিষয় পালন করার মাধ্যমে এই সমস্যা দূরে রাখা যায়।
ডা. ন্যাটবনির মতে সেগুলো হল-
আর্দ্র থাকা: পরিবেশ, কাজের ধরন, আবহাওয়া দেহের আকার ইত্যাদির ওপর পানি চাহিদা নির্ভর করে। তাই পরিস্থিতি বুঝে পর্যাপ্ত পানি পান নিশ্চিত করতে হবে। প্রস্রাবের রং স্বাভাবিকের চাইতে বেশি গাঢ় হওয়া মানে দেহে তরলের অভাব হচ্ছে।
ক্যাফিন গ্রহণে নজর দেওয়া: চা কফি গ্রহণের পরিমাণের দিকে নজর দেওয়া উচিত। এসব পানীয় কোন পরিমাণে পান করার পর মাথাব্যথা বা বুক ধড়ফড় করা শুরু হয় সেটা নির্ণয় করে গ্রহণের পরিমাণ কমাতে হবে।
সুষম খাবার খাওয়া: খাদ্যাভ্যাসে ফল, সবজি, চর্বিহীন প্রোটিন ও পূর্ণ শষ্য রাখতে হবে। পুষ্টিকর খাবার এই সমস্যাগুলো থেকে দূরে রাখতে পারে।
পাশাপাশি অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম করা: প্রতিদিন কর্মচঞ্চল থাকা উপকারী। তবে শরীরে অতি মাত্রায় চাপ দেওয়া যাবে না।
কঠিন ব্যায়াম করলে কারও কারও মাথাব্যথা হতে পারে।
মানসিক চাপ কমানো: গভীর শ্বাস, ইয়োগা, ধ্যান ইত্যাদির মাধ্যমে উৎকণ্ঠা দূর করা যায়। এ কারণে মানসিক চাপ কমানোর পন্থা খুঁজে বের করতে হবে।
যখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি
মাথাব্যথা ও বুক ধড়ফড়ের স্থায়িত্ব এবং প্রচণ্ডতার ওপর নির্ভর করবে আসলেই গুরুত্বর কোনো সমস্যা চলছে কিনা।
“হৃদ-সমস্যা ছাড়া স্বাস্থ্যবান মানুষের মাঝে মধ্যে হওয়া হৃদস্পন্দন ঘটিত সমস্যা নিয়ে সাধারণ ডাক্তারের সাথে আলোচনা করতে পারে। তবে যাদের হৃদরোগ আছে তাদের অবশ্যই হৃদ-বিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হতে হবে” পরামর্শ দেন ক্যালিফোর্নিয়া’র ‘মেমোরিয়ালকেয়ার স্যাডেলব্যাক মেডিকেল সেন্টার’য়ের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মার্ক টাব।
এছাড়া যে কোনো সময়ে হওয়া মাথাব্যথা, বুকে চাপ অনুভব, নিঃশ্বাসে সমস্যা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলা বুক ধড়ফড় করার সমস্যার জন্য অবশ্যই একবার হলেও চিকিৎসকের পরামর্শে দেহ পরীক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।
আরও পড়ুন
সাধারণ মাথাব্যথা নাকি মাইগ্রেইন- বোঝার উপায়