Published : 22 Oct 2023, 01:32 AM
আক্রান্ত ও মৃত্যু-দুই নিরিখেই ডেঙ্গু নিয়ে যে ভয়াবহ বছরের মুখোমুখি বাংলাদেশ; সেই ২০২৩ সালের শেষ ভাগে পরিস্থিতি উন্নতির আশা দেখছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যান দেখে তারা বলছেন, সম্প্রতি এইডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু কিছুটা কমেছে। নভেম্বরের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে থাকবে। তবে এর মধ্যে ঢিলেমি শুরু হলে পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে, সেই সতর্কতার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গুর সংক্রমণ চূড়ায় উঠেছিল সেপ্টেম্বর মাসে। তবে অক্টোবরে যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি কমবে- এমন না। তাই এখনও রিলাক্সড হওয়ার কোনো সুযোগ নাই। ডেঙ্গুর প্রকোপ নভেম্বরের দিকে কমবে।”
শনিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯৯০ জন। এ বছর মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে ১২৪৬ জন মারা গেছেন। বছর শেষ হতে আড়াই মাস বাকি থাকলেও এরইমধ্যে সর্বাধিক রোগী ও প্রাণহানি নথিবদ্ধ হয়েছে।
এর আগের পাঁচ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৯ সালে এক লাখ ডেঙ্গু রোগী দেখেছিল বাংলাদেশ; আর কোনো বছরেই এত রোগী হাসপাতাল ভর্তি হতে দেখা যায়নি। তিন বছর পর ২০২২ সালে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রাণ হারিয়েছিল ২৮১ জন, যেই সংখ্যার চারগুণ মৃত্যু গত সাড়ে ৯ মাসেই দেখেছে বাংলাদেশ।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতিবছর মশাবাহিত বিভিন্ন রোগে বিশ্বে সাত লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগ বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এ রোগের ব্যাপকতা ২০১৯ সালে দেখা যায়।
“অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। এরপর আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মৃত্যুও। অনেক পরিবার স্বজন ও উর্পাজনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। রোগে ভুগেও অনেকে বড় ধরনের কষ্ট শিকার করেছে। বছরের মাঝামাঝিতে জুলাইয়ে ৪৩ হাজার, অগাস্টে ৭১ হাজার এবং সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন।
অধিদপ্তরের সাত সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমতে দেখা গেছে। গত ৩ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক সপ্তাহে দেশে ১৭ হাজার ৬৪১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন।
পরের দুই সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা আরও কিছুটা বাড়ে; ১০ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯ হাজার ২২৭ জন এবং ১৭ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ হাজার ১৫৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হন।
এরপর থেকে রোগীর সংখ্যা কমছে। ২৪ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৮ হাজার ৬৮৯ জন, ১ থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৭ হাজার ৪১৬ জন।
৮ থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত সাত দিনে ১৬ হাজার ৪২৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সবশেষ ১৫ থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ১৫ হাজার ৭৩৯ জন ভর্তি হয়েছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভর্তি রোগী কমার হার ঢাকায় বেশি। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মোট ভর্তি রোগীর ৩৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল ঢাকা মহানগরে। পরের সপ্তাহগুলোতে এ হার ছিল যথাক্রমে ৩২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ২৭ শতাংশ, ২৫ শতাংশ ও ২৪ শতাংশ।
মৃত্যুর হিসাব বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৩ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশজুড়ে মারা যান ৯০ জন; ১০ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৮ জন; ১৭ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৯ জন; ২৪ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৬ জন; ১ থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ৯০ জন; ৮ থেকে ১৪ অক্টোবর ৭৯ জন এবং ১৫ থেকে ২১ পর্যন্ত সাত দিনে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ডেঙ্গু সারা বছরই?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. আহমেদুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সম্প্রতি বড় ধরনের এবৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়া এই সময়েও কিছু বৃষ্টি হবে, যা কমবে নভেম্বরের শুরুর দিকে। ওই সময় তাপমাত্রাও কমতে থাকায় মশাও কমবে; কমবে ডেঙ্গুর প্রকোপ।”
তবে ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বিদায় নেওয়ায় আপাতত তেমন বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছেন না আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ। তিনি সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৌসুমি বায়ু বিদায় নিয়েছে। তাই এখন নরমাল, মানে বৃষ্টির সম্ভাবনা নাই।”
যদিও একসময় বর্ষাকালকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হত; এখন সেই বাস্তবতা বদলেছে বলে মনে করেন আহমেদুল কবীর।
তিনি বলেন, “এখন বাংলাদেশে পিক সিজন বলে কিছু নাই। সারা বছরই কমবেশি ডেঙ্গু রোগী পাবেন। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, এখনও মশা নিয়ন্ত্রণসহ যত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সব নিতে হবে। সারা বছরই কাজ করতে হবে। ঢিলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নাই।”
ডা. আহমেদুলের বক্তব্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে এ বছরের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানেও। দেখা যাচ্ছে, বছরের সব সময়ই কম-বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
যেমন- এ বছরের জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন, মে মাসে এক হাজার ৩৬ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৭৬ জন, অগাস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৮ জন।
মাসওয়ারি মৃত্যু হয়েছে জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ২ জন, জুনে ৩৪ জন, জুলাইয়ে ২০৪ জন, অগাস্টে ৩৪২ জন এবং সেপ্টেম্বরে ৩৯৬ জন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিণত হয়েছে সারা বছরের রোগে। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গু এখন ঢাকা ছাড়িয়ে সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে; নগরায়নের ফলে গ্রামও মশাবাহিত রোগের ঝুঁকির বাইরে থাকছে না।
এ পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রশ্নে তিনি বলেন, এইডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনা; যাতে ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার’ বিষয়টিও থাকতে হবে।
সরকারের পদক্ষেপ কি কাজে আসছে?
ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য এইডিস মশা নিধনে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে ‘পর্যাপ্ত’ মনে করছেন না খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে তিনি বলেছেন, “খালি আমরা বড় বড় কথা বললে তো আর ডেঙ্গু কমবে না। ডেঙ্গুর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যে পদক্ষেপগুলো আমরা দেখছি এখনও তা পর্যাপ্ত নয়। এটা সত্যি কথা, এটা পর্যাপ্ত নয়।"
মশা নিধন কার্যক্রমে ঘাটতি দেখলেও ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি নেই বলে দাবি করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "দেশের সব জায়গায় যাতে যথেষ্ট পরিমাণে ফ্লুইড বা স্যালাইন থাকে সেই ব্যবস্থা করেছি। নিজেরা স্যালাইন আমদানি করেছি, প্রাইভেট সেক্টরকেও আমদানি করার অনুমোদন আমরা দিয়েছি, যাতে স্যালাইনের ঘাটতি না হয়।”
প্রায় একদশক ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলে আসা জাহিদ মালেক বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে একটা লম্বা পরিকল্পনা, সারা বছরের পরিকল্পনা পৌরসভা ও সিটি মেয়রদের নিতে হবে।”
দেশে মশা নিধন কার্যক্রম তদারক করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সঠিক পথে আছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো তা নিচ্ছে। সিটি করপোরেশনগুলো নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটাচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে নিয়মিত টিভিসি চালানো হচ্ছে।"
এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘জনসচেতনতা’কেই সমাধান হিসেবে দেখছেন চারবারের নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য।
তার ভাষ্য, “ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস মশা কিন্তু খালে, বিলে, জঙ্গলে বা ড্রেনে হয় না। এইডিস মশা হয় বাড়ির ভেতরে। এজন্য মশা নিধনে মানুষের সচেতন হওয়াটা খুব বেশি জরুরি। আমরাও মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছি।"
ডেঙ্গু রোধে পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর রেকর্ড 'অত্যন্ত বেদনাদায়ক’: স্থানীয় সরকারমন্ত্রী
ডেঙ্গু থাকছে সারা বছর, বাঁচতে চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: ড. কবিরুল বাশার