যে কেউ চাইলে এক বাক্যে ‘এটা কোনো সিনেমাই হয়নি’ বলতে পারেন; আবার আবার প্রতিটি ফ্রেম নিয়ে রাতভর আলোচনা চালিয়ে যেতে পারেন।
Published : 15 Jan 2023, 11:25 PM
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারি মিলনায়তনে ‘ঝরা পালক’ যখন শেষ হল, গ্যালারিভরতি দর্শকের চোখে মনে তখন যেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’! একসঙ্গে সবাই যেন ভাবছিলেন, তালি দেবেন কি দেবেন না। শেষে শিশিরের শব্দের মতো করতালিতে নেচে উঠল ৯০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত কবিতা দেখা দর্শক।
ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দ্বিতীয় দিন রোববার সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড ক্যাটাগরিতে দেখানো হয় কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনের অংশবিশেষ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ঝরা পালক’।
কলকাতার নির্মাতা সায়ন্তন মুখোপাধ্যায় বানিয়েছেন সিনেমাটি। কবির স্ত্রী লাবণ্য দাশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের জয়া আহসান। কবির পরিণত বয়সের ভূমিকা পর্দায় রূপায়ন ঘটিয়েছেন ব্রাত্য বসু, আর যুবক বয়সের চরিত্র করেছেন রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়।
জীবনানন্দের পাঠকদের সামনে কবিকে কীভাবে উপস্থাপন করবেন, তা নিয়ে হয়ত বিরাট ভাবনায় পড়তে হয়েছিল নির্মাতাকে। অথবা জীবনানন্দের মাথায় যেমন উটের গ্রীবার মতো উপমা কিংবা বেত ফলের ম্লান চোখের বর্ণনা চলে এসেছে অবলীলায়, সায়ন্তনের হাতেও তা তেমন অবলীলায় ভিজুয়ালাইজড হল।
যা তিনি বানিয়েছেন, দর্শক হিসেবে তা দেখতেই প্রচণ্ড ধৈর্য ও শিল্পীত মননের প্রয়োজন পড়ে, তখন সেই প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে- এটা করতে কী পরিমাণ মেধা খাটিয়ে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়েছে নির্মাতাকে।
জীবনানন্দের কবিতা তার সমকালীন নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়েছিলেন, কবিতার শুরু কিংবা শেষ সবটাই যেন বিক্ষিপ্ত। উপমায় বাহারি চমক, গল্প বা দৃশ্যের ধারাবাহিকতার গতি আটকে ধরে বিক্ষিপ্তভাবে ছুটে বেড়ানো সহজ সরল অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহারে লেখা কবিতা তৎকালীন পাঠক তো দূরে থাক, লেখক সমাজও ঠিক গ্রহণ করতে পারেননি।
একজন নির্মাতার উপর জীবনানন্দ ভর করলে তার সিনেমা ঠিক যেমন হতে পারে, ঝরা পালক তেমনই একটা সিনেমা হয়ে উঠল শেষ মেশ।
বিক্ষিপ্তভাবে ছুটে বেড়ানো গল্প, অধারাবাহিক শট ডিভিশন, একের পর এক জাম্প কাট, অনেক বেশি মন্তাজের ব্যবহার সিনেমাটিকে সিনেমা না বানিয়ে বানিয়ে দিল একটি কবিতা।
‘শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে...’ পড়তে পড়তে পাঠককে যেমন পড়তে হয় ‘চমৎকার, ধরা যাক দু একটা ইঁদুর এবার...’ তেমনি জীবনানন্দ রেডিওতে কোন কবিতা পড়বেন, সেই দোটানার ভেতর চলে আসে লাবণ্য দাশের অভাব-অভিযোগের দৃশ্যমালা।
হঠাৎ প্রেম, বিরহ, আকাঙ্ক্ষা, মিনতি, বিষণ্নতা, হতাশা, তো তার মাঝে হঠাৎ করে চলে আসে সৃষ্টির সুখ। কবির জীবন যদি এমনই হয়, কবির সিনেমা এমন হবে না? হয়েছেও তাই।
এইসব ক্যামেরার অস্থিরতার মধ্যে সারাক্ষণ আবহ সংগীতের মতো বেজে গেছে কবিতার অস্পষ্ট ক্যাওয়াজ। কবির মাথায় কবিতার শব্দরা ঠিক যেভাবে আসে, দর্শকের মাথার ভেতর শব্দগুলো সেভাবেই বসিয়ে দিয়েছেন নির্মাতা।
ঝরা পালক সিনেমাটা এমন ‘উদ্ভট’ না হয়ে যদি জন্ম, যাপন, মৃত্যুতে আটকে থাকত; তাহলে কি তাকে জীবনানন্দময় বলা যেত?
সিনেমাটাকে জীবনানন্দময় বলা যায় আরেকটা কারণে, জীবনানন্দের কবিতার বিমূর্ত ভাব এতটাই প্রবল যে, যে কেউ চাইলে এক বাক্যে কবিতাকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন; আবার কবিতার একটি লাইন নিয়ে রাতভর আলোচনা করতে পারেন।
সায়ন্তনের বানানো ঝরা পালক নিয়েও একই কথা বলা যায়। চাইলে এক বাক্যে ‘এটা কোনো সিনেমাই হয়নি’ বলে বাদ দিতে পারেন কেউ, আবার প্রতিটি ফ্রেম নিয়ে রাতভর আলোচনা চালিয়ে যেতে পারেন কেউ, তেমন রস ও রসদ এটিতে আছে।
জয়া আহসানকে এর আগেও এমন চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। বিসর্জনে পদ্মা, রাজকাহিনীর রুবিনা কিংবা বিনিসুতোয় শ্রাবণী- কলকাতায় জয়া আহসান দুঃখী, বিষন্ন নারীর চিরন্তন উপস্থাপন যেন। ঝরা পালকেও জয়াকে দেখা গেল কবির অতৃপ্ত, বিষণ্ন, দুঃখী ও জেদী স্ত্রীরূপে। চরিত্রের সঙ্গে শতভাগ মিশে গিয়ে অভিনয় করে গেলেও নতুন করে জয়াকে সেভাবে পাওয়া যায়নি।
জীবনানন্দ দাশের চরিত্রে রাহুল অরুণোদয় খুব কম সময় পেয়েছেন। যকটুকু সময় পেয়েছেন নিজেকে মেলে দিয়েছেন সোনালি ডানার চিলের মতো।
ব্রাত্য বসুকে কবির পরিণত বয়স হিসেবে একটু বেশিই স্বাস্থ্যবান ঠেকেছে। বিশেষত পাঠক কবির যে ছবি দেখে বড় হয়েছেন, সেই ছবির সঙ্গে মেলানো কঠিন। তবে চেহারার দিক দিয়ে ব্রাত্য অনেকটাই জীবনানন্দ হয়ে উঠেছেন। নির্মাতা পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক করেই তাকে নির্বাচন করেছেন বোঝা যায়।
ঝরা পালকের ক্যামেরা আর এডিটিং, নতুন ধারায় কাজ করতে চাওয়া নির্মাতাদের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ঝরা পালক এমন এক সিনেমা হয়ে রইল, যার ফ্রেমে ফ্রেমে মিশে গেছে জীবনানন্দের ঘ্রাণ।