সুজেয় শ্যাম বলেন, “আগে বিভিন্ন দিবসে যেমন ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এলে আমরা সময় পেতাম না। সব টিভি চ্যানেল ডাকত। এখন কেউ ডাকে না।”
Published : 24 Jul 2023, 05:45 PM
মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের গানের কথায়-সুরে মুক্তিকামী মানুষেরা হতেন উদ্দীপ্ত, তাদের একজন
একাত্তরের কণ্ঠসৈনিক সুজেয় শ্যাম। স্বাধীনতার অর্ধশতকের বেশি সময় পেরিয়ে এই সুরকারের ‘আক্ষেপ’, কাজের জন্য এখন কেউ আর তার খোঁজ করে না।
তার আক্ষেপের অন্যতম কারণ, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের সরকারি অনুষ্ঠানেও তিনি আমন্ত্রণ পাননি। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শেই জীবনের বাকি পথ চলতে চান এই সুরকার ও গীতিকার।
রোববার বিকেলে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী আয়োজিত ‘কথা-গানে ফকির আলমগীরকে স্মরণ' শীর্ষক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন ৭৭ বছর বয়সী সুজেয় শ্যাম। অনুষ্ঠানে তাকে ‘ফকির আলমগীর স্মৃতিপদক’ দিয়ে সম্মান জানানো হয়।
পদকপ্রাপ্তির অনুভূতি জানাতে গিয়ে সুজেয় শ্যাম বলেন, “বঙ্গবন্ধুর মত মহামানবের জন্মশতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত করা হয় নাই। যে কদিন বেঁচে আছি, দেশকে যেন ভালোবাসতে পারি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সাথে নিয়ে চলতে পারি।”
অনুষ্ঠানের পর গ্লিটজের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন সুজেয় শ্যামের। সেই আলাপেও একই ‘আক্ষেপ’ ঝরেছে তারা কথায়।
তিনি বলেন, “এখন আমাদের আর কেউ খবর নেই না। বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতার থেকে মাঝে মাঝে আমাকে ডাকে কাজ করার জন্য। আর কোনো টেলিভিশন আমাকে ডাকে না। আগে বিভিন্ন দিবসে যেমন ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এলে আমরা সময় পেতাম না। সব টিভি চ্যানেল ডাকত। এখন কেউ ডাকে না।”
কয়েক বছর ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত সুজেয় শ্যাম। তবে তিনি মনে করেন, এখনো কাজ করার সক্ষমতা রয়েছে তার। সুজেয় শ্যাম বলেন, “এখনও আমি কাজ করতে পারি। কিন্তু আমাকে ডাকে না।”
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থাকাকালে মোট নয়টি গানে সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম, যেগুলো একাত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গাওয়া হয়েছিল।
এর মধ্যে রয়েছে ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ’। ছিল বিশ্বপ্রিয়র লেখা ‘আহা ধন্য আমার’, কবি দিলওয়ারের লেখা ‘আয়রে চাষী মজুর কুলী’।
তার সুর করা গানের মধ্যে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’ এবং ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গান দুটি যে কোনো জাতীয় দিবসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
ফকির আলমগীরের প্রতি ভালোবাসার টানেই অনুষ্ঠানে ছুটে এসেছেন জানিয়ে সুজেয় শ্যাম বলেন, “অনুষ্ঠানে এসেছি, কারণ ফকির আলমগীর গণসংগীতকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার নামে স্মৃতিপদক আমাকে দেওয়া হয়েছে, এই ডাক উপেক্ষা করা যায় না।”
১৯৪৬ সালে সিলেটে জন্ম নেওয়া সুজেয় শ্যামকে সংগীতে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে একুশে পদক দেওয়া হয়। তার আগে ২০১৫ সালে শিল্পকলা পদক পান তিনি। কিন্তু এখনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পাননি।
সুজেয় শ্যামকে স্বাধীনতা পুরস্কার না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।
অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “বিজয় নিশান উড়ছে ঐ গানটি সুর করেছেন সুজেয় শ্যাম। আমি তো মনে করি, শুধুমাত্র এই একটি গানের জন্যই সুজেয় শ্যামের স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া উচিত। সুজেয় শ্যাম স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি, ফকির আলমগীরও স্বাধীনতা পুরস্কার পাননি। আমি দাবি জানাই এ দুজন গুণী শিল্পীকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হোক।"
তবে সুজেয় শ্যাম গ্লিটজকে বলেছেন, স্বাধীনতা পুরস্কার না পাওয়ার জন্য তার কোনো আক্ষেপ নেই।
এই সুরকার ও সংগীত পরিচালক বলেন, “দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেখানে আমি ভূমিকা রাখতে পেরেছি- এটাই আমার বড় পাওয়া। এই যে আমরা সবাই বাংলায় কথা বলতে পারি। এই আনন্দটুকুই বড় পাওয়া।”
তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে দাওয়াত না পাওয়ায় কিছুটা মর্মাহত হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে আমি চিনি বহু আগে থেকেই। আমার ভাইকে বঙ্গবন্ধু চিনতেন, সেই সূত্রে আমাকেও অনেক আগে থেকেই চিনতেন। দুঃখের ব্যাপার হল, বঙ্গবন্ধুর জন্মের ১০০ বছর পূর্তিতে অনেকেই চিঠি পেয়েছে, আমি হতভাগা পেলাম না।
“বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা হয়নি। বিটিভি আর বেতারে গান করেছি। কিন্তু বাইরের মঞ্চে সরকার যেসব অনুষ্ঠান করেছে, আমাকে সেখানে ডাকা হয়নি।”
সুজেয় শ্যামের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন ফকির আলমগীরের স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর।
ফকির আলমগীর স্মরণানুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সুরাইয়া আলমগীর বলেন, “সুজেয় শ্যামের চিকিৎসার দায়িত্ব যেন সরকার থেকে করা হয়, আমি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীকে অনুরোধ করব। তিনি যেন প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা করেন।"
বিজয়ের গানে সুজেয় শ্যাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে সুজেয় শ্যামের নাম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুজেয় শ্যামকে বলা হল, বিজয়ের গান করতে।
এরপর শহীদুল ইসলামের লেখা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই/ খুশির হাওয়ায় উড়ছে/ উড়ছে উড়ছে উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে’ গানটিতে সুর করেন সুজেয় শ্যাম।
এ গানটিই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান। গানটি ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর দিনভর বাজানো হয়েছিল।
মাত্র ১৫ মিনিট লেগেছিল গানটি লেখা ও সুর করতে; এরপর রেকর্ডিং। আর পুরো গানটার জন্ম হয়েছিল মাত্র এক ঘণ্টায়।
গিটার বাদক ও শিশুতোষ গানের পরিচালক হিসেবে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান চট্টগ্রাম বেতারে কর্মজীবন শুরু হয় সুজেয় শ্যামের। পরে তিনি ঢাকা বেতারে যোগ দেন।
১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন সুজেয় শ্যাম। ঢাকাই চলচ্চিত্র সংগীতে অবদানের জন্য তিনবার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
বাংলাদেশ বেতারের প্রধান সংগীত প্রযোজক পদ থেকে ২০০১ সালে অবসরে যান সুজেয় শ্যাম।
এরপর ২০০৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত ৪৬টি গানের সংকলন নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের গান’ শিরোনামে একটি অ্যালবামের সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।
এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে আরও ৫০টি গানের সংকলন নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের গান-২’ নামে আরেকটি অ্যালবামের সংগীত পরিচালনা করেন শিল্পী।
‘টুনাটুনি অডিও’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।