গাজীপুরের কালীগঞ্জে বাবার কবরের পাশে শায়িত হবেন এই অভিনেতা, সংসদ সদস্য।
Published : 16 May 2023, 03:26 PM
‘সুজনসখী’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র মত সাড়া জাগানো চলচ্চিত্রের নায়ক, ঢাকাই সিনেমার ‘মিয়া ভাই’ আকবর হোসেন পাঠান ফারুককে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ।
মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টায় উত্তরার বাসা থেকে ফারুকের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয়। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব।
প্রথমে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পক্ষে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ শ্রদ্ধা জানান ঢাকা-১৭ আসনের এই সংসদ সদস্যের কফিনে। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে কমোডর এমএম নাঈম রহমান পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
ওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও ফুল দেওয়া হয় ফারুকের কফিনে।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, "চিত্রনায়ক ফারুক বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে গেছেন। আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন অবিচল, অনড় ও আপসহীন।
"তার থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। বিশেষ করে আদর্শের প্রশ্নে তিনি সংকটেও দিশেহারা হননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১ বছর আমরা ক্ষমতায় ছিলাম না। নায়ক ফারুক তখনও ছিলেন জনপ্রিয় নায়ক। কিন্তু সে সময়ও তার পেশাজীবনে ক্ষতি হবে সেটা হতেও পারত, তারপরও তিনি বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আওয়ামী লীগের আদর্শ ধারণ করে গেছেন।"
কাদের বলেন, "তার লাইফ ছিল কালারফুল। একদিকে নায়ক, আরেক দিকে রাজনীতি। মাঠের সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। চিত্রনায়ক ফারুকের মত সরাসরি রাজনীতির মাঠে ছিলেন এভাবে কোনো নায়ককে দেখিনি।"
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার চাঁপা এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত ছিলেন ফারুকের ছেলে রওশন হোসেন পাঠান শরৎ।
তিনি বলেন, "আমার বাবা চলে গেলেন। আপনারা আমার বাবার প্রতি কোনো দাবি রাখবেন না। তার জন্য দোয়া রাখবেন। সারাজীবন বাবা মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। মৃত্যুর পর আপনারা সেই ভালোবাসা দিয়ে যাবেন। তার আত্মার জন্য দোয়া রাখবেন।"
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, ফেরদৌস, নিপুণ, জায়েদ খানসহ ঢাকাই সিনেমার নবীন প্রবীণ বহু মুখ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত ছিলেন।
জাসদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, জয় বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রয়াত এই অভিনয়শিল্পী ও সংসদ সদস্যের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।
সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকালে মৃত্যু হয় ফারুকের। রক্তে সংক্রমণজনিত জটিলতা নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
মঙ্গলবার সকালে ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছায় ফারুকের কফিন। সেখানে থেকে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরার বাসায়।
দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে বেলা পৌনে ১টার দিকে ফারুকের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে। সেখনে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান এক সময়ের সহকর্মী শিল্পী, কলা-কুশলীরা।
বেলা সাড়ে ৩টায় এফডিসিতে জানাজার পর ফারুকের মরদেহ নেওয়া হবে চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে। বিকাল ৫টায় গুলশানে আজাদ মসজিদে আরেক দফা জানাজা হবে।
পরে ফারুকের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে গাজীপুরের কালীগঞ্জের তুমুলিয়া দক্ষিণ সোম গ্রামে। সেখানে সোমটিওরী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরাস্থানে দাফন করা হবে চিত্রনায়ক ফরুককে।
আরও পড়ুন
বর্ণময় এক জীবন
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সাদা-কালো পর্দা থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিনয়, প্রযোজনা ও পরিচালনায় উজ্জ্বলএকটি নাম ‘ফারুক’। অভিনয় করেছেন ৬০টির বেশি সিনেমায়।
১৯৪৮ সালের ১৮ অগাস্ট পুরান ঢাকায় তার জন্ম। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু, বাবার নাম আজগার হোসেন পাঠান। পাঠান পরিবারের এই সন্তানের বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। ছাত্রবয়সেই জড়িয়ে পড়া ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। দেশ বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে ধরছিলেন অস্ত্রও।
তবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই সিনেমায় নাম লিখিয়েছিলেন এই নায়ক, ‘জলছবি’ নামের সেই সিনেমা মুক্তি পায় একাত্তরে। প্রথম সিনেমাতেও তার নায়িকা ‘সারেং বউ’ কবরী। যে জুটি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল ‘সুজনসখী’ নামে।
ক্যারিয়ারে প্রথম থেকে ফারুক নজর কেড়েছিলেন নির্মাতা খান আতাউর রহমানের। যার হাত ধরে একটু একটু করে এগিয়েছিলেন তিনি। এরপর আমজাদ হোসেন, নারায়ণ ঘোষ মিতা, প্রমোদ করের মত পরিচালকরা তাদের সিনেমায় বেছে নেন ফারুককে।
সারেং বউ, লাঠিয়াল, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, দিন যায় কথা থাকে, জনতা এক্সপ্রেস, সাহেব, মিয়াভাই, নাগরদোলা, সুজনসখী’, ঘরজামাই, ভাইভাই, বিরাজবৌ এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য জায়গায় নিজেকে নিয়ে যান খ্যাতিমান এই অভিনেতা।
ফারুক-কবরী, ফারুক-ববিতা জুটি সময়ে সাথে সাথে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয় দর্শক মনে। বিশেষ করে ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাদের পর্দারসায়ন এত চমৎকার ছিল যে পর্দার বাইরে তাদের প্রেম চলছে এমন গুঞ্জনও আশির দশকের ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হয়। যদিও তারা কেউই এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলেননি।
এছাড়া শাবানা, রোজিনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জনাও ফারুকের নায়িকা হয়েছেন বিভিন্ন সিনেমায়।
মুক্তিযুদ্ধের দুই সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এবং আলোর মিছিল’-এ ফারুক মূল ভূমিকায় না থাকলেও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই দুটি কাজকে তার টার্নিং পয়েন্ট ধরা হয়।
গ্রামের বেকার যুবক, পরিশ্রমী কৃষক, ট্রাকচালক, ট্রেনচালক, ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সাধারণ দর্শকের মনের নায়কে পরিণত হন। করেছেন বাণিজ্যিক সিনেসাও, এবং সেগুলো সফলও হয়েছিল।
তবে কবরীকে নায়িকা করে ‘সাংরেং বউ’, আর ‘সুজনসখী’ সিনেমা ফারুকের ক্যারিয়ের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়।
‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান। এছাড়া চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১৬ সালে এই অভিনেতাকে দেওয়া হয় আজীবন সম্মাননা।
সিনেমায় আসার আগে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন। অসংখ্য মামলায় ব্যাপক পুলিশি হয়রানিরে শিকার হন সেসময়।
উনসত্তরের গণ আন্দোলনেরও সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আবার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন।
অভিনয় থেকে অবসরের পর রাজনীতির মাঠে শোনা যায় ফারুকে নাম। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে ঢাকা-১৭ আসনের এমপি হন তিনি।