বার বার বিতর্কে গায়ক নোবেল

সাবেক স্ত্রীর ভাষ্য: “নোবেল অনেক ভালো মানুষ ছিল, একটা চক্রের ফাঁদে পড়ে সে নেশা শুরু করে, এরপরই তার জীবনে চেইঞ্জ আসে।”

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2023, 12:19 PM
Updated : 21 May 2023, 12:19 PM

ওপার বাংলার রিয়েলিটি শোর মঞ্চে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিলেন বাংলাদেশের মাইনুল আহসান নোবেল, গানে গানে সবাইকে মুগ্ধ করে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন; কিন্তু উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের শুরুতেই জড়িয়েছেন একের পর এক বিতর্কে।

সবশেষ টাকা নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার অভিযোগে প্রতারণার এক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে একদিনের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।

এর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্কিত পোস্ট, মাদকাসক্তি আর স্ত্রীকে নির্যাতনের মতো অভিযোগ আসায় সমালোচিত হন এই তরুণ গায়ক।

নির্যাতনের অভিযোগ তুলে নোবেলের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান তার স্ত্রী সালসাবিল মাহমুদ। অবশ্য তার ভাষ্য, “নোবেল অনেক ভালো মানুষ ছিল, একটা চক্রের ফাঁদে পড়ে সে নেশা শুরু করে, এরপরই তার জীবনে চেইঞ্জ আসে।”

নোবেলকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন সালসাবিল। সেখানে প্রাক্তন স্বামীর কর্মকাণ্ডে শাস্তির বদলে সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেন তিনি। বিচ্ছেদের আগে তিনি সেটাই চেয়েছিলেন বলে সাংবাদিকদের জানান।

নোবেলের জন্মস্থান গোপালগঞ্জে হলেও শৈশব-কৈশোর কেটেছে ঢাকা-খুলনসহ বিভিন্ন জায়গায়। বাবা পরিবহন ব্যবসায়ী।

তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত গোপালগঞ্জের এস এম মডেল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়েছেন। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন ঢাকার একটি স্কুলে। পরে খুলনার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ শেষ করতে গিয়েই বারবার স্কুল পাল্টাতে হয়েছে তাকে।

নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন গোপালগঞ্জের একটি স্কুলে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন পড়া হয়নি। একবার মারামারির ঘটনায় তাকে সেখান থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। পরে নোবেলকে দার্জিলিংয়ে পাঠিয়ে দেন তার বাবা।

সেখানে কাশিয়াংয়ে হিমালি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হন। ক্লাস নাইনেই তিনবার পড়তে হয়েছে তাকে। হিমালি বোর্ডিং স্কুলে নাইন শেষ করেছেন। কিন্তু সেখানেও তার ভালো লাগেনি। পরে গিয়ে কলকাতার হাজরার একটি স্কুলে আবার নাইনে ভর্তি হন। পরে দ্য কেমব্রিজ স্কুলের শিক্ষার্থী হয়ে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পাস করেন।

এরপর ২০১৪ সালে ঢাকায় আসেন নোবেল। তখন গান নিয়েই তার সময় কাটছিল। পড়ালেখার চাইতে গানের প্রতি মনোযোগ ছিল বেশি।

সেই গানের হাত ধরেই আসে সফলতা। ২০১৯ সালে ভারতের জি-বাংলার রিয়েলিটি শো ‘সা রে গা মা পা’-তে অংশ নিলে তুমুল জনপ্রিয়তা পান। সেখানে তৃতীয় হন নোবেল, বাড়তে থাকে তার তারকাখ্যাতি।

ফেইসবুকে বিতর্ক

গান গেয়ে তারকাখ্যাতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং এর রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ফেইসবুকে কটূক্তি করে সমালোচিত হন নোবেল।

এছাড়া নগরবাউল-খ্যাত রকস্টার জেমসকে নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্য করেন। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নোবেলের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে।

২০২১ সালে এক সাংবাদিককে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সাধারণ ডায়েরি করা হয় তার নামে। একই বছর নির্যাতনের অভিযোগ এনে স্ত্রী সালসাবিল মাহমুদও তার বিরুদ্ধে বিচ্ছেদের আবেদন করেন।

কিছুদিন আগে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে গান গাওয়ার সময় ‘অসংলগ্ন’ আচরণের অভিযোগ ওঠে নোবেলের বিরুদ্ধে।

ক্ষুব্ধ দর্শকেরা তার দিকে পানির বোতল ও জুতা ছুড়ে মারেন। নোবেল ‘নেশাগ্রস্ত’ হয়ে মঞ্চে ওঠায় এমন হয়েছে বলে তখন জানিয়েছিলেন আয়োজকরা।

যে কারণে প্রতারণার মামলা

শরীয়তপুরের একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য প্রায় পৌনে দুই লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে শুক্রবার ঢাকার মতিঝিল থানায় মামলা হয় নোবেলের বিরুদ্ধে।

সেই মামলায় শনিবার ভোরে নোবেলকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান জানান।

পুলিশ জানায়, মতিঝিল থানায় মামলাটি করেন সাফায়েত ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। এতে অভিযোগ করা হয়, গত ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত শরীয়তপুর ভেদরগঞ্জ হেডকোয়ার্টার উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি ২০১৬ ব্যাচের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য নোবেলের সঙ্গে এক লাখ ৭৫ হাজার টাকার চুক্তি করেছিল আয়োজকরা। নোবেলকে কয়েক দফায় ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু তিনি অনুষ্ঠানে যাননি, যে কারণে অস্বস্তিতে পড়তে হয় আয়োজকদের।

‘মাদকের সরবরাহের পেছনে এয়ারহোস্টেজ’

নোবেলকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তার সাবেক স্ত্রী সালসাবিল। নোবেলের এতসব বিতর্কের পেছনে ‘মাদকাসক্তিকে’ কারণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি।

তবে তার মাদকাসক্তির পেছনে ‘একটি চক্র কাজ করছে’ মন্তব্য করে সালসাবিল বলেন, “কোনো একটা চক্রের মধ্যে পড়ে সে নেশাটা শুরু করে। এরপর সে প্রচণ্ড মাদকাসক্ত হয়ে যায়। এরপর তার ব্যবহারে চেইঞ্জ আসে এবং সে অন্য একটা অন্য মানুষে পরিণত হয়, মাদকাসক্ত একটা মানুষে পরিণত হয়। তারপর যা ঘটেছে তার নেশার কারণেই ঘটেছে।”

স্বামীর নির্যাতনের অভিযোগের ব্যাপারে সালসাবিল বলেন, “আমি গুলশান থানায় একটা জিডি করেছিলাম। আমাকে প্রচণ্ড মারধর করা হত; যখন সেটা প্রচণ্ড পরিমাণে চলে যায়, তখন আমি ৯৯৯- এ কল দিই। আমি আশা করিনি, কিন্তু খুব দ্রুত সেখানে পুলিশ চলে আসে। তখন তারা নোবেলকে ঠেকিয়ে (আমাকে) বাঁচায়।

“তারা তাকে (নোবেল) জিজ্ঞেস করে, কেন মারছেন। তখন সে (নোবেল) বলে, ‘আমি আসলে অনেক জিনিস নিই, খাই। তখন আসলে আমার মাথা ঠিক থাকে না, মারি’। এরপর ওখান থেকে উদ্ধার হওয়ার পর আমি গুলশান থানায় আমি জিডি করি।”

সালসাবিল বলেন, “আমি চাচ্ছিলাম, সে নেশাটা থেকে বের হয়ে একটা সুস্থ জীবন-যাপন করুক। আমার উদ্দেশ্য তাকে শাস্তি দেওয়া ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল সে সেখান থেকে বের হয়ে এসে একটা ভালো জীবন-যাপন করুক।

“কিন্তু তার আশেপাশের মহলটা, যাদের মাধ্যমে জিনিসগুলো পাচ্ছে বা যারা তাকে সাপোর্ট দিচ্ছে, ওইটা থেকে সে বের হয়ে আসতে পারে নাই, ওই জন্য তার এই অবস্থা “

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “(নোবেলের সঙ্গে) মেয়ের সম্পৃক্ততা আমি দেখি নাই। কিন্তু তাদের চক্রে একটি এয়ার হোস্টেজ চক্র কাজ করে, সেখান থেকে একজন তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এবং যত ধরনের মাদক, তাকে সাপ্লাই দেয়।

“ও ইন্টারন্যাশনাল এয়ার হোস্টেজ, আমি নামটা বলতে চাচ্ছি না।”

আরও পড়ুন-

Also Read: নোবেল প্রসঙ্গে সালসাবিল

Also Read: গ্রেপ্তার গায়ক নোবেল রিমান্ডে

Also Read: টাকা নিয়ে গান না গাওয়ায় মামলা, নোবেল গ্রেপ্তার

Also Read: কুড়িগ্রামের মঞ্চে ‘অসংলগ্ন’ নোবেল, জুতা ও বোতল ছুড়ল দর্শক