বাউল সাধক সাইদুর রহমান বয়াতি বলেন, “এখন রাতেরবেলা হাঁটলে, মানুষ দেখলে ভয় লাগে। সমাজে মানুষরূপী অমানুষ বাড়তেছে। আমাদেরকে মানুষ-মূলে ফিরতে হবে।”
Published : 29 Oct 2024, 08:52 PM
মানবিক ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে ‘মানুষ মূলে’ ফেরার প্রত্যয় নিয়ে ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে দেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
মঙ্গলবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে লোকজ সুরের মূর্ছনাসহ নানা আয়োজনে সাজানো অনুষ্ঠানে ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার প্রত্যয়ের কথা জানানো হয়।
১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর নিপীড়িত মানুষের গান গাইবার অঙ্গীকার নিয়ে, মানুষের মুক্তির জন্য, সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যে একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালানোর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
'মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি' স্লোগান নিয়ে সাজনো হয় এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। শুরুতেই জাতীয় পতাকা ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি জাতীয় সঙ্গীত ও ‘উদীচী সঙ্গীত’ পরিবেশন করেন সংগঠনের শিল্পীরা।
এরপর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাউল সাধক শফি মণ্ডল। পরে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে শুরু হয় আলোচনা পর্ব।
বাউল সাধক শফি মণ্ডল বলেন, “আমরা মনের বৈষম্য দূর করব, এটাই প্রত্যাশা। এখানে বক্তারা মানুষ হওয়ার কথা বলেছেন। আমরা যেন মানুষ হওয়ার সাধনা করি।”
বাউল সাধক সাইদুর রহমান বয়াতি বলেন, “সাম্য নাই, ভালোবাসা নাই, প্রেম নাই- সেটাই তো বৈষম্য। এমন সমাজ তো আমরা চাই না। উদীচী সাম্যের গান করে, মানুষকে ভালোবাসার কথা শোনায়। বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করে।”
সমাজে অমানুষ বাড়ছে উল্লেখ করে এই বাউল সাধক বলেন, “আমরা ছোটবেলায় রাতে হাঁটছি, মানুষ দেখলে বল পাইতাম, সাহস পাইতাম। আর এখন রাতেরবেলা হাঁটলে, মানুষ দেখলে ভয় লাগে। সমাজে মানুষরূপী অমানুষ বাড়তেছে। আমাদেরকে মানুষ-মূলে ফিরতে হবে।”
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, “আমরা বার বার বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, বিজয়ী হয়েছি। আবার সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাওয়া বিজয় ছিনতাই হয়ে যেতেও দেখেছি। মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, মানুষসহ বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে আমরা উদীচীর ৫৬ বছর উদযাপনের প্রতিপাদ্য ঠিক করেছি- ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি’। মানুষকে ভালোবেসেই আমরা আগামি দিনের পৃথিবী শিশুদের বাসযোগ্য করার প্রত্যাশা করি।”
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে আমরা সংগ্রাম করে চলেছি। মানুষের অধিকার এই ভূখন্ডে বার বার ভুলন্ঠিত হয়েছে। ফসলের সাথে জমিনের যে সম্পর্ক, রাজনীতির সাথে সংস্কৃতির সম্পর্কটাও তেমন। সংস্কৃতিকর্মীরা মানুষের মনোজগত গঠনের জন্য কাজ করেন।”
জুলাই গণঅভ্যুথানে জীবন দেয়া শিক্ষার্থী ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া, মা, ফারহানা দিবা এবং বোন সাইমা ইসলাম ফারিনও এসেছিলেন অতিথি হয়ে। এছাড়া উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানাও বক্তব্য দেন।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, “আমরা যে ‘মানুষ মূল’ হারাচ্ছি, তা নিয়ে আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত। মায়ের বদনখানি মলিন হলে নয়নজলে ভাসি। কিন্তু আমাদের মায়ের বদন কেমন আছে? আমরা আন্দোলন করে স্বৈরাচার সরকারের পতন করেছি। আরেক সরকার এসেছে। সরকার পরিবর্তন মানেই তো রাষ্ট্রের পরিবর্তন নয়। বাংলাদেশের মূল চেতনা হলো মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি।”
আলোচনা পর্বের পর ‘মানুষ হারা ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি’ গানের সঙ্গে সমবেত নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচীর নৃত্যশিল্পীরা। এরপর সমবেত আবৃত্তি পরিবেশন করেন উদীচীর বাচিক শিল্পীরা। বাউল ও লোক গান পরিবেশন করেন উদীচীর সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা।
লালন সাঁই, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ দত্তের জনপ্রিয় কিছু গান পরিবেশন করেন তারা। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন উদীচীর সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেন।
একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন মাহমুদ সেলিম, হাবিবুল আলম, সূর্য লাল দাশ, পূর্ণ চন্দ্র মন্ডল, কল্পনা খান, শাহিনুর আলামিন, অবিনাশ বাউল, আনান বাউল, ফতেহ আলী খান আকাশ প্রমুখ।
এছাড়া সমবেত পরিবেশনা উপস্থাপন করে উদীচী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ, বাড্ডা শাখা, গেন্ডারিয়া শাখা, ডেমরা শাখা ও রায়েরবাজার শাখার শিল্পীরা।
আমন্ত্রিত শিল্পীদের মধ্যে একক গান পরিবেশন করেন বাউল সাধক সাইদুর রহমান বয়াতী ও শফি মন্ডল। এছাড়া, কিছুদিন আগে হামলার শিকার ফরিদপুরের লালন আনন্দ ধামের পক্ষে শিল্পী জাহিদ হাসান এবং বাংলাদেশ বাউল ও লোকশিল্পী সংস্থার পরিবেশনাও ছিল আয়োজনে।