থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ‘ক্ষ্যাপা’র নির্বাহী সম্পাদক কবি ও নাট্যকার অপু মেহেদী বলেন, “আমরা মুখে বিকেন্দ্রিকরণের কথা বললেও সবকিছু কেন্দ্রমুখি করে রেখেছি।”
Published : 25 Oct 2024, 09:12 AM
দেশের আট জেলায় শিল্পকলা একাডেমির অত্যাধুনিক ভবন নির্মিত হয়েছে। এসব ভবনে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্বলিত মিলনায়তন, এলইডি মনিটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকার পরও যে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হওয়ার কথা, তা খুব একটা দেখা যায় না।
এসব জেলার সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, ঢাকার চেয়েও বেশি ভাড়া গুনতে হয় বলে এসব আধুনিক মিলনায়তন ব্যবহারে অনাগ্রহ রয়েছে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর।
তাছাড়া আধুনিক লাইট, সাউন্ড, এলইডি সুবিধা থাকলেও দক্ষ অপরেটর না থাকায় কোনো কোনো জায়গায় সেসব সরঞ্জাম ব্যবহার নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।
২০২২ সালে কুষ্টিয়া, খুলনা, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও রংপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির আধুনিক ভবন উদ্বোধন করা হয়।
এসব জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অনুষ্ঠানই বেশি হয়। সেই তুলনায় স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে তেমন একটা মিলনায়তন ব্যবহার করত দেখা যায় না।
খুলনা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সুজিত কুমার সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখানে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো অনুষ্ঠান করছে। তবে তা নিয়মিত নয়।”
এর কারণ হিসেবে তিনি অবশ্য স্থানীয় নাট্যদল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ‘নিষ্ক্রিয়তাকে’ প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
সুজিত কুমার সাহা বলেন, “এখানে ৮/৯টি নাট্যদল আছে। তবে তাদের বেশিরভাগই এখন নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করে না। আবর্ত নাট্যদল গত সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের এখানে মিলনায়তন ভাড়া নিয়ে ‘মহুয়ার পালা’ নামে একটি নাটকের মঞ্চায়ন করেছে।”
নানা প্রতিবন্ধকতায় জেলার নাট্যচর্চা আগের মতো নেই উল্লেখ করে আবর্ত নাট্যদলের সভাপতি প্রতীক গোলদারও নিয়মিত নাটকের মঞ্চায়ন করতে না পারার কথা বললেন।
তিনি বলেন, “মোটা অংকের টাকা দিয়ে মিলনায়তন ভাড়া করে শো করলে যে খরচ হয়, তা বহন করা বেশ কঠিন। ঢাকার মতো তো আর টিকেট বিক্রি করতে পারি না আমরা।”
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা গ্রামে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিত নাট্যচর্চা করে আসছে মণিপুরি থিয়েটার। ‘কহে বীরাঙ্গনা’, ‘ইঙাল আধার পালা’সহ বেশ কিছু নাটক মঞ্চায়ন করে সারাদেশে প্রশংসিত হয়েছে এ নাট্যদলটি।
ঢাকায় এসে প্রায়ই নাটক মঞ্চায়ন করতে দেখা গেলেও নিজেদের জেলা শহরে খুব একটা মঞ্চায়ন করতে দেখা যায় না তাদের।
মণিপুরি থিয়েটারের সভাপতি শুভাশিস সিনহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের গ্রাম থেকে মৌলভীবাজার শহরে গিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করার চেয়েও সহজ মনে হয় ঢাকায় গিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করা। খরচও তুলনামূলকভাবে কম হয়। তাছাড়া জেলা শহরে যেহেতু নিয়মিত টিকেট কিনে নাটক দেখবে, এমন দর্শকশ্রেণি গড়ে উঠেনি। ফলে টিকেট বিক্রি করাটাও এখানে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।”
নিজ গ্রামেই ‘নটমণ্ডপ’ নামে একটি নিজস্ব মিলনায়তন গড়ে তুলেছে মণিপুরি থিয়েটার। এখানেই তারা নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি উৎসবের আয়োজনও করে।
জেলায় ভর্তুকি বাড়ানো উচিত উল্লেখ করে শুভাশিস সিনহা বলেন, “ঢাকায় তো নাটকের মঞ্চায়ন করলে টিকেট বিক্রি করে কিছু টাকা উঠে আসে, চাইলে স্পন্সরও পাওয়া যায়। কিন্তু জেলাতে এই সুযোগগুলো কম। ফলে জেলা শিল্পকলা একাডেমির ভাড়া কমানো উচিত এবং এর জন্য ভর্তুকি বাড়ানো উচিত। তখন হয়তো স্থানীয় নাট্যদলগুলো নিয়মিতভাবে মিলনায়তনগুলো ব্যবহার করতে উৎসাহী হবে।”
জেলায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে বিনামূল্যে মিলনায়তন বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি নানা রকম প্রণোদনা থাকা উচিত বলে মনে করেন থিয়েটার বিষয়ক পত্রিকা ‘ক্ষ্যাপা’র নির্বাহী সম্পাদক কবি ও নাট্যকার অপু মেহেদী।
তিনি বলেন, “আমরা মুখে বিকেন্দ্রিকরণের কথা বললেও সবকিছু কেন্দ্রমুখি করে রেখেছি। যেখানে জেলায় মিলনায়তন ভাড়া কম হওয়ার কথা, সেখানে জেলায় ভাড়া বেশি দিতে হয়। সংস্কৃতিচর্চার রাজধানী নির্ভরতা কমাতে জেলায় ভর্তুকি বাড়াতে হবে। জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন বিনামূল্যে সাংস্কৃতিক সংগঠগুলোকে দেওয়া উচিত এবং নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পারফরম্যান্স করার জন্য স্থানীয় সংগঠনগুলোকে প্রণোদনা দেওয়া উচিত।”
চলতি বছর রংপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে যেসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে, তার বেশিরভাগই জেলা প্রশাসন বা বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার আয়োজনে হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরাও অংশ নিয়েছেন বলে জানান শিল্পকলা একাডেমির রংপুর জেলা কালচারাল অফিসার নুঝাত তাবাসসুম রিমু।
সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে মিলনায়তনের ভাড়া কম নেওয়া হয় বলে দাবি করেন তিনি।
নুঝাত বলেন, "স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিজেদের ব্যবস্থাপনায় খুব বেশি অনুষ্ঠান আয়োজন করেনি। আমরা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ক্ষেত্রে ভাড়া কম নিয়ে থাকি। অন্যদের ক্ষেত্রে একদিনে যে ভাড়া নেওয়া হয়, তার অর্ধেকেরও কম নেওয়া হয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে লাইট, সাউন্ড সুবিধা তো মিলনায়তনেই থাকে।"
ঢাকা ও জেলায় মিলনায়তন ভাড়া কত?
ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ৭৫০ আসনের প্রধান মিলনায়তন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ভাড়া দেওয়া হয় ৬ হাজার টাকায়। ৩৫০ আসনের পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন ভাড়া নিতে গুনতে হয় ৩ হাজার ৬০০ টাকা এবং স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনের জন্য ভাড়া দিতে হয় ২ হাজার ৪০০ টাকা।
অন্যদিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৫০১ থেকে ১ হাজার আসনের মিলনায়তনের জন্য প্রথম তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ৮ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। তবে যে আট জেলায় শিল্পকলা একাডেমির আধুনিক ভবন হয়েছে, সেসব জেলায় এলইডি সুবিধা ব্যবহার করতে হলে আলাদা টাকা গুনতে হয়। সেখানে মোট ১৪ হাজার টাকা ভাড়া গুণতে হয়।
এছাড়া তিন ঘণ্টার অতিরিক্ত ব্যবহার হলে প্রতি ঘণ্টায় (এসিসহ) বাড়তি ২,৫০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়।
কিন্তু ঢাকায় জাতীয় নাট্যশালায় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা এবং বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ব্যবহারে আলাদা কোনো টাকা দিতে হয় না।
ঢাকা ও জেলায় ভাড়ার বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তনে ভর্তুকি দেওয়া হয় বলে ভাড়া কিছুটা কম। জেলা শিল্পকলায় সেই ভর্তুকির ব্যবস্থাটা নেই। শিল্পকলায় নতুন পরিচালনা পরিষদ হয়েছে। আমরা পরিষদের সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করবে।”
জেলা শিল্পকলা একাডেমির গঠনতন্ত্র সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান জামিল আহমেদ।
“ধীরে ধীরে আমরা একটা শৃংখলা তৈরি চেষ্টা করছি। প্রশাসনিক, আর্থিক স্বচ্ছতার জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করছি। জেলা শিল্পকলাকে আরো গতিশীল করার জন্যও কিছু পরিকল্পনা করেছি। আমাদের একটু সময় দিতে হবে,” বলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্বে আসা শিল্পকলার এই মহাপরিচালক।